আতোয়ার রহমান : আমি এমন এক জায়গায় চোখ খুললাম যে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম “আমি এখানে কী করছি?” পুরোনো বাংলা সিনেমার সেই “আমি কোথায়?” প্রশ্নটি ফুটে উঠলো, আমার নীরব চোখে। হাসপাতালের ঘরটি নির্জন, আমার চোখের পলকের মতো মিটমিট করে আলো জ্বলছে। যন্ত্রপাতিগুলো কাজ করছে না, তাই আমি অস্বস্তি বোধ করা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে জানালাটি খুলে দিলাম। শার্সি দিয়ে উঁকি মেরে বাইরে তাকালাম। দেখতে পেলাম নরম রোদে হাসপাতালের করিডোরের চারপাশে যেন একটা কবরস্থান ধীর লয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। শক্ত মনের মানুষ হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এতদিনের অতি চেনা জগত আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল, আমাকে রেখে গেল একটা অতি দুরের গ্রহে, যেখানে কোনকিছুই কোন অর্থ তৈরি করে না। চারিদিক থেকে যেন একরাশ ঘন অন্ধকার ঘিরে ধরছে, নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা, অসহায়ত্ব গিলে ফেলছে।
গুরুগম্ভীর ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিশিপ্সনিস্টের জানালার কাছে গেলাম। সে আমাকে যা বলল তার অল্প কিছুই আমি শুনতে পেলাম বলে আমার মনে হল। রিসিপ্সনিস্ট আমার হেলথ কার্ড ফেরত দিল, আমি পকেটে রেখে দিলাম।
হ্যাভ আ নাইস ডে, মিস্টার রাহাত। কাঁচের জানালা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল, এবং সেই রিসিপ্সনিস্টের শুভ কামনা আমার জন্য পরিহাসপূর্ণ হওয়ায় হেসে ফেললাম।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। শেষ দুপুর। চমৎকার রোদের আলো। চারপাশের প্রকৃতি ছেয়েছে রঙের ছোঁয়াতে। গাছে গাছে শাখায় শাখায় পাতায় পাতায় যেন আগুন লেগেছে রঙের! সামার শেষ হলেও বেশ গরমের আমেজ আছে। লেক অন্টারিও থেকে উড়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস গরমকে সহনীয় করেছে। মানুষ ঘরের বাইরে বের হয়েছে। কেউ লন পরিস্কার করছে, শিশুরা বাইক চালাচ্ছে, একদল শিশু এবং বয়স্কলোক মাঠে বেসবল খেলছে, কিশোররা ড্রাইভওয়েতে বাস্কেট বল খেলছে।
আমার কর্মস্থল টরন্টোর এগলিন্টন ইস্ট সাবওয়ের কাছেই। কাজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। রেস্টুরেন্টে বিকেল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কাজ। বেশ কয়েক বছর ধরে হেলপার ও কুক হিসেবে কাজ করার পর সবে শেফ হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। প্রধান শেফ এন্ড্রু অন্য একটা রেস্টুরেন্টে স¤প্রতি ভাল অফার পেয়ে চলে না গেলে আমি ওর চেয়ে সিনিয়র ও মেধাবী হওয়া সত্বেও হয়তো এখনো কুক হিসেবেই থাকতে হতো। বেতন ও সুযোগসুবিধা বেড়েছে। তবে ভয়ানক ব্যস্ততা। চাকরির বাইরে কোনও জীবন নেই। এককথায় রোবটিক লাইফ।
আজকাল কাজে যেতে ভয় হয়। ট্রেনে বা বাসে চলাফেরার সময়ে চারদিকে একটু বিশেষ নজর রাখি। বাসে বা ট্রেনে অনেকেই আমার পাশে বসতে চায় না। বহুদিন এদেশে থাকার সুবাদে এখানকার আলো দেখেছি যেমন, আবার অন্ধকারও দেখেছি। পত্র পত্রিকায় প্রায়ই খুনখারাপির সংবাদ চোখে পড়ছে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন কোন বিপদ ঘাড়ে এসে পড়ে। তবে এখন অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করি। উটকো ঝামেলা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আশপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে আর অযথা মাথা ঘামাই না। জীবনের জটিলতা যত কম হয় ততই ভাল।
সার বেঁধে প্রায় নিঃশব্দে ছুটছে সুশৃংখল গাড়িঘোড়া, ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে। নজরে পড়ার সুবিধার জন্য চকচকে পোশাক পরা একজন সাইকেল আরোহী রাস্তা দিয়ে চলে গেল। একজন মধ্যবয়সী শ্বেতবর্ণের মহিলা বাস স্ট্যান্ডে এসে আমাকে দেখে তার হাতের মানিব্যাগটি শক্ত করে ধরে রাখল, একটু বাড়তি সাবধান হয়ে গেল। বিচিত্র টুপি পরা একটি শ্বেতাঙ্গ মেয়ে হাত নাড়িয়ে চলে গেল। সে আমার পরিচিত। উস্কুখুস্কু চেহারার জীর্ণ মলিন জিনস প্যান্ট পরিহিত এক ভবঘুরে আমার খুব কাছে এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে একটা সিগারেট চাইল, তাকে তা দিলাম। সে নিতান্ত অবহেলায় সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উত্তর দিকে চলে গেল।
একটু পরেই দুজন সাদা তরুন আমার পেছনে এসে লাইনে দাঁড়াল। লম্বা, ফরসা, সোনালী চুলের কালো জ্যাকেট পরা সুদর্শন এক শ্বেতাঙ্গ তরুন। আমি আমার জ্যাকেটের পকেটে হাত রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আমার আঙ্গুলগুলি দৃঢ়মুষ্টিতে আঁকড়িয়ে ধরছিলাম। তারা আমার কাছে এগিয়ে আসছিল এবং ভয় পাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে আমি মনের মধ্যে দুজনের জীবন সম্পর্কে বিশদ ছবি তৈরী করছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পরখ করলাম। একজন এক টুকরো চুইং গাম চিবিয়ে খাচ্ছিল। সে দেখতে বেশ মোটাসোটা এবং খিটখিটে। তার চোখে কালো ছোট্ট গোলাকার ফ্রেমের চশমা। নীল চোখ স্টিলের মতো চকচক করছে। সে ভাবলেশহীন মুখে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
অন্য লোকটির জন্য আমাকে বেশি কিছু আবিষ্কার করতে হয়নি। মধ্যবয়সী, ঢিলেঢোলা জিনসের প্যান্ট, উল্কিমারা কালো জ্যাকেট গায়ে, মাথায় কালো হ্যাট। তাকে পরিচিত মনে হলো, একটু পরে আমি বুঝতে পারলাম যে সে দেখতে এমন একজনের মতো যে আমাকে অন্য এক দিন আমার বাড়ির সামনে উত্যক্ত করেছিল, রেসিস্ট মন্তব্য করেছিল। বিরক্ত হয়ে আমি মোবাইলে লোকটার ছবি তুলেছিলাম। পরে সে পাঁচ সাত জন লোক নিয়ে আমার বাসার সামনে জটলা করেছিল। আমি নিরাপত্তাহীন বোধ করেছিলাম। তার গলায় ও হাতে উল্কি আঁকা। সে হাঁচলো, তারপর জামার হাতায় নাক মুছলো। আশপাশে তাকিয়েও দেখলনা কারো অসুবিধা হল কিনা। একজন আমাকে শুনিয়ে বলল,
অভিবাসীরা কফি কাপের মতো।
কিভাবে? আমি চোখে চোখ রেখে বললাম।
তোমার জানা উচিত। আচ্ছা বাসে ওঠো আগে। কিভাবে তা বলছি তোমাকে।
বাসে উঠে সিটে বসতে না বসতেই আচমকা এদের একজন বলে উঠলো “ফা.. অফ, গো ব্যাক টু ইওর সিট হোল কান্ট্রি”। এরকম পরিস্থিতিতে আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম।
প্যান্টের পকেট থেকে দ্রæত একটা চাপাতি বের করে আমাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সব ভয় ডর চলে যায়। তখন একপা দু’পা করে সামনে আগানো ছাড়া উপায় থাকে না। এসময় নিরীহ প্রাণীও প্রাণের দায়ে বেপরোয়া হয়। আমি আচমকা উড়ে গিয়ে ওর নাক বরাবর সজোরে একটা ঘুসি চালালাম। নাক দিয়ে ভলকে রক্ত বেরোতে লাগল। নাক চেপে ধপাস করে বসে পড়ল লোকটা। চাপাতিটা হাত থেকে পড়ে গেল। টল সামলাতে না পেরে ও এক যাত্রীর গায়ে গিয়ে পড়ল। কিন্তু তাতেও আমার রক্ষা হল না।
দ্বিতীয় জন স্পেনের ম্যাটাডোরের বুনো ষাঁড়ের মতো তেড়ে-ফুঁড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর, তারস্বরে চিৎকার করলো, “আই অ্যাম গোয়িং টু কিক ইন ইওর অ্যাস, বøাডি এশিয়ান”। বলেই আমার কোমরে এমন জোরে একটা উড়ন্ত লাথি দিল যেন পাহাড় থেকে একটা বড়ো পাথরখন্ড প্রচন্ডবেগে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কোমরের ওপর এসে পড়ল। লাথির চোট ষাড়ের শিঙের গুঁতোনোর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। অসহ্য ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তিখেউড় করে আমার থেঁতলে যাওয়া মুখে একদলা থুথু ছুড়ে মারলো…! নিজের আয়ত্তের মধ্যে বাগিয়ে নেওয়া শিকারের সাথে বিড়ালের মতো একটু একটু পা বাড়িয়ে অসাড়তা বোঝার চেষ্টা করল। হিংসায় গুই সাপের মতো হিস হিস করতে লাগল। সবার সামনে আমার গলার ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে বসল। অনুভব করতে পারছি, প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে আমার। অসহ্য যন্ত্রণায় মায়ের কথা মনে হলো, চিৎকার করে মাকে ডাকতে লাগলাম। আকুতি জানিয়ে বললাম আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার করুণ আর্তিতে ওর মন গললো না। মনে হল লোকটার খুনের স্পৃহা যেন আরও বেড়ে গেল। যেন ক্ষুদার্ত বাজপাখি হাতের নাগালে পেয়ে গেছে মোক্ষম শিকার। যাহোক কিছুক্ষণ পরে হাঁটু একটু আলগা করলে আমি আবার শ্বাস নিলাম। দেখলাম হাত আর পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। রুনার জন্য, বাচ্চা দু’টোর জন্য মনটা খারাপ হতে লাগল খুব। কান্না পাচ্ছিল হঠাৎ। বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
কতটা হিংস্রতা মানুষের মাঝে আসতে পারে, তাই ভাবছিলাম। ভেতরে একরাশ ঘৃণা নিয়ে ওর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কাটা মুরগির মতো ককিয়ে উঠলাম। চালক বাসের গতি কমিয়ে দিয়েছে। গাড়ি ধীর গতিতে এগোতে থাকল। সামনে রোজডেল স্ট্যান্ডে আসার সাথে সাথে পেছনের দরজা দিয়ে মুখ নিচু করে ওরা দ্রæত নেমে পড়ল। কী নিষ্ঠুর পরিতৃপ্তি ওদের মুখে। একজন যাত্রী ওদের পিছু নিল অনেকদুর পর্যন্ত। কিন্তু তারা এত বেশি জোরে হাঁটছিল যে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমি হুঁশ হারালাম, একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। তারপর কী হলো আর বলতে পারি না। যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন আমি হাসপাতালে। গাড়িতে অনেক যাত্রী, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি, তাদেরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেনি। সকলের সামনে আমাকে বেধড়ক পেটাল। ওই লোকগুলো আমার কিছুই করতে পারত না যদি যাত্রীরা নিখুঁত দর্শকের মত পর্যবেক্ষণ না করে তাদেরকে বাধা দিত।
তবে একজন যাত্রী তার মোবাইল ফোনে আমার ওপর জাত্যাভিমানীদের আক্রমণের দৃশ্য ভিডিয়ো করে। মোবাইলে তোলা আমার মার খাওয়ার দৃশ্যের ভিডিয়ো ফুটেজ আপলোড হতেই তা ব্যাপক হারে ভাইরাল হয়। নিজেদের ফুটেজ দেখতে পেয়ে তারা অবশেষে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। ট্যাক্সি নিলাম। বাসায় আমাকে দেখে স্ত্রী ও সন্তানরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলাম। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রচুর রেস্ট নিতে। শুয়ে-বসেই দিন কাটছে।
এর মধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি। তবে শরীর বেশ দুর্বল, এখনো সারা শরীরময় যেন বিষ ঢালছে। বুক ধড়ফড় করে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, শরীর ঘামতে থাকে, মাথা ঘোরে। মনের মধ্যে অস্থিরতা, কোনও কিছুতে মন বসে না, একটা অজানা আশঙ্কা ও ভয় সবসময় সাপের মত গলা পেচিয়ে থাকে। ঘুম আসে না। সারা রাত শুধু এপাশ ওপাশ। পুরো পৃথিবীটা যেন হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে গেছে আমার কাছে।
মাঝে মাঝে আমার বাসার সামনের রাস্তা পার হয়ে ছোট্ট পার্কে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ি। কোকরা মুরগির মতো ঝিম মেরে বসে থাকি। কিছুই করতে ভালো লাগে না। ভীষণ ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন টুঁটি চেপে ধরে। যতই মন থেকে এই ভয়ংকর জাতিঘৃণার ঘটনাকে মুছতে চাই, ততই সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে চেপে ধরে শক্ত আঠার মতো।
মনে হচ্ছে সকল বিষাদ আর দীর্ঘশ্বাসকে শোষণ করে বিকেলের রোদ মরে ঘন ম্যাপল পাতার আড়াল সরিয়ে অন্ধকার নামছে। শীত আসার আগে একটা ঠান্ডা হাওয়ার আমেজ আছে। ভাবছি কিছুদিন ঔষধ পথ্য খেলে হয়তো আমার শারীরিক অসুখের নিরাময় হবে, হুইল চেয়ার ছেড়ে হয়তো আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবো। কিন্তু আমাদের মনের ভেতর গেঁথে দেয়া বিভেদরেখার যে গভীর অসুখ শক্ত বাসা বেঁধেছে, যে ভাইরাস আমাদের সম্পর্কে ঢুকে আছে এতদিন ধরে, তার তো কোনও চিকিৎসাই নেই!