ফরিদ আহমেদ : ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজাটা ধার্মিকদের খুব প্রিয় একটা বিষয়। যদিও বিজ্ঞান এবং ধর্ম পুরোপুরি সাংঘর্ষিক দুটো বিষয়। বিজ্ঞানে চরম সত্য বলে কিছু নেই। সত্যের সন্ধানে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছে বিজ্ঞান। নিত্য নতুন পরীক্ষা, পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান এবং তথ্য প্রমাণ দিয়ে প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের অবস্থান। এখানে কেউ কিছু দাবী করলেই সেটাকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া হয় না, বরং সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় নিবিড়ভাবে নানা পরিবেশে। সেই সব পরীক্ষা অতিক্রম করতে পারলেই কেবল তা গ্রহণযোগ্য হয়, নতুবা তা বাতিল হয়ে যায়। এ নিয়ে কেউ গোস্বা-টোস্যা করে না। গোস্যা করলেও, সেটাকে অন্যেরা পাত্তা-টাত্তা দেয় না তেমন।
এর বিপরীতে ধর্মের সত্যিটা হচ্ছে ধ্রুব সত্যি। ধর্মগ্রন্থে যে কথাগুলোকে সত্য বলে লেখা হয়েছে, সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কিংবা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আসলেই সেটা সত্য কিনা তা করার সাহস কিংবা ইচ্ছা, কোনোটাই ধার্মিকদের নেই। ধরুন, ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে যে আমাদের এই পৃথিবী সমতল। কিংবা আদম হাওয়াকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে মর্তধামে ফেলে দেওয়া হয়েছে মাত্র ছয় হাজার বছর আগে। এখন, ধার্মিকরা এইসব বক্তব্যকে ভুল বক্তব্য বলে স্পষ্টভাবে বাতিল করে দিতে পারে না। দিতে গেলে তার ধর্ম বিশ্বাসটা নিয়েই টানাটানি পড়ে যায়। ঈশ্বর রচিত গ্রন্থে ভুল থাকলে পরম ঈশ্বরের ধারণাটাও ভুল হতে বাধ্য। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ভুল হতে পারে, এই ভাবনা ধার্মিকদের মস্তিষ্কে কখনোই প্রবেশ করবে না। কারণ, প্রবেশের সেই জায়গাটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায়ও নেই। তা না হলে একটু জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটলেই মানুষের ওই সমস্ত ধর্মগ্রন্থে কিংবা অলীক ঈশ্বরের বিশ্বাস রাখাটা একটু কষ্টকরই।
ধর্মগ্রন্থ গুলোর ইতিহাসের দিকে তাকান। দেখবেন, এই গ্রন্থগুলো লেখা হয়েছে বহু বছর আগে। সেই প্রাচীন সময়ে মানুষের বিজ্ঞানের উপর দখল এবং জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত ধরনের। সেই সীমিত জ্ঞানের সময়ে লেখা গ্রন্থে আপনি আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু খুঁজে পাবেন, এটা আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। আধুনিক বিজ্ঞান নয়, ওই সমস্ত বইগুলিতে আসলে প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার চালচিত্রই ফুটে উঠেছে, তৎকালীন সমাজের মানুষের ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস, আশা আকাঙ্ক্ষার কথাই শুধু প্রকাশ পেয়েছে। এর থেকে সামান্যতম বাড়তি কিছু সেখানে নেই। ধর্ম কিংবা ধর্মগ্রন্থগুলো ছোটবেলা থেকে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের একটা জায়গাকে বøক করে দেয়। ফলে, সেখানে খুব সাধারণ মানের যুক্তিও আর কার্যকর থাকে না। একই ব্যক্তির অন্য সব দিকেই হয়তো প্রখর যুক্তি জ্ঞান কাজ করছে, কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে গেলেই সেই যুক্তিটা খান খান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে।
এই যুক্তিটা কাজ করে না বলেই, ধার্মিকেরা ধর্মগ্রন্থের অভ্রান্ততায় স্থির বিশ্বাস নিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে। সমস্যা হয় তখনই, যখন ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্ব›দ্ব তৈরি হয়। এই দ্ব›দ্ব হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ, আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মগ্রন্থের যে ধ্যানধারণা তার থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করতে গেলে সেগুলো হাস্যকর রূপ ধারণ করে। এই হাস্যকর অবস্থা থেকে নিজেদের ধর্ম কিংবা ধর্মগ্রন্থকে বাঁচাতে রূপকের আশ্রয় নেওয়া হয়। দাবি করা শুরু হয় যে বিজ্ঞানের সবকিছুই ধর্মগ্রন্থে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা নতুন যা কিছু আবিষ্কার করেন, তার সবই যে ধর্মগ্রন্থে রয়েছে, সেটা ধার্মিক জ্ঞানীরা নানা যুক্তি-তর্ক দিয়ে, বই-টি লিখে প্রমাণ করে দেন। মজার বিষয় হচ্ছে, এই প্রমাণটা আসে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পরে। এতো বিজ্ঞান ভর্তি ধর্মগ্রন্থ থেকে নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ কিংবা আবিষ্কার আসে না। বিজ্ঞানকে আগে সেটা আবিষ্কার করতে হয়। আবিষ্কারের পরে ধর্মবিজ্ঞানীরা লাফ দিয়ে পড়ে বলে যে এটাতো আমার ধর্মগ্রন্থে সেই কোনো আমলেই লিখে রাখা হয়েছে। সেটার প্রমাণ হিসাবে তারা অব্যর্থ আয়াত বা শ্লোক খুঁজে এনে দেন।
আমাদের অনেকেরই ধারণা যে মুসলমানেরাই বোধহয় এই ধরনের দাবী সবচেয়ে বেশি করে। এটা ভুল। প্রতিটা ধর্মই এই ধরনের দাবী করে। কোরান কতোটা নির্ভুল, কতোখানি বিজ্ঞানসম্মত, সেটা নিয়ে যেমন অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, একইভাবে বৈদিক বিজ্ঞান নিয়েও অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। ধর্মগুলো তাই কেউ কারো থেকে পিছিয়ে আছে বলা যাবে না এক্ষেত্রে।
১৯৩৯ সালে মেঘনাদ সাহা শান্তিনিকেতনে ‘নতুন জীবনদর্শন’ নামে একটা বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতার কিছুটা অংশ এরকম :
“প্রাচীন চীনজাতির মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে কারিগররূপে কল্পনা করা হইয়াছে, তিনি হাতুড়ি পিটাইয়া ও কুঠার দ্বারা পাহাড় কাটিয়া সমস্ত পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন। সেইজন্য চীন দেশে খুব বড় বড় কারিগর ও স্থপতির সৃষ্টি হইয়াছে এবং চৈনিক সভ্যতায় শিল্পীর স্থান অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় অনেক উচ্চে। হিন্দুর সৃষ্টিকর্তা একজন দার্শনিক।
তিনি ধ্যানে বসিয়া প্রত্যক্ষ জগৎ, স্থাবর ও জঙ্গম, জীব এবং ধর্মশাস্ত্রাদি সমস্তই সৃষ্টি করিয়াছেন। সেইজন্য যাহারা মাথা খাটায়, অলস দার্শনিক তত্তে¡র আলোচনায় সময় নষ্ট করে এবং নানারূপ রহস্যের কুহেলিকা সৃষ্টি করে, হিন্দু সমাজে তাহাদিগকে খুব বড় স্থান দেওয়া হইয়াছে। শিল্পী, কারিগর ও স্থপতির স্থান এই সমাজে অতি নিম্নস্তরে এবং হিন্দু সমাজে হস্ত ও মস্তিষ্কের পরস্পর কোন যোগাযোগ নাই। তাহার ফল হইয়াছে এই যে, সহস্র বৎসর ধরিয়া হিন্দুগণ শিল্পে ও দ্রবোৎপাদনে একই ধারা অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে এবং তজ্জন্য বহুবার যান্ত্রিক বিজ্ঞানে উন্নততর বৈদেশিকের পদানত হইয়াছে।”
মেঘনাদ সাহার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো হিন্দু সমাজে। তাঁকে আক্রমণ করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু হলো প্রচুর পরিমাণে। ধর্মের সমালোচনা করলে এর বিরুদ্ধবাদীরা সাধারণত সবচেয়ে বড় যে যুক্তি নিয়ে আসে, সেটা হচ্ছে আপনি কি ধর্ম গ্রন্থের পুরোটা পড়েছেন? আগে ধর্ম সম্পর্কে জানেন, তারপর মন্তব্য করেন। মেঘনাদ সাহার এই সমালোচকরাও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। এদের কেউ কেউ এসে বললো, মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান নিয়ে আছেন, সেটা নিয়েই থাকুন না কেন। ধর্মে নাক গলানো কেন? যে বিষয় তিনি জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলাটা তাঁর অনুচিত হয়েছে। কেউ কেউ আবার লেখেন, “হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর ধর্ম, ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রকৃতি তথ্য জানিবার জন্য ডক্টর সাহা যদি কিছুমাত্র চেষ্টা করিতেন, শুধু পরের মুখেই ঝাল না খাইতেন, তাহা হইলেই তিনি বুঝিতে পারিতেন যে, এ বিষয়ে ঐরূপ মন্তব্য প্রকাশ করা তাঁহার ন্যায় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে উপযুক্ত হয় নাই।” একজন আবার দুম করে এই মন্তব্যও করে বসলো যে, “মেঘনাদ সাহা বা রবীন্দ্রনাথ কেহই কারিগর নহেন, তাই বলিয়া কি একজন নিপূণ তাঁতী না মুচির স্থান তাঁহাদের উর্ধে হইবে?”
মেঘনাদ সাহা সরব লোক ছিলেন। তাঁকে কেউ কিছু বলে যাবে, আর তিনি উত্তর দেবেন না, এমনটা তাঁর ক্ষেত্রে কখনোই হয় নাই। তিনি এর জবাবে বললেন, “কেন হবে না? একজন মূর্খ পুরোহিত যে সংস্কৃত মন্ত্রের অর্থ না জানিয়াই শ্রাদ্ধ বা বিবাহের মন্ত্র পড়ায়, তাহার সামাজিক সম্মান তাঁতী বা মুচীর অধিক হইবে না কেন? তাঁতী বা মুচী পরিশ্রম দিয়া সমাজের একটা বিশেষ কাজ করে, কিন্তু মূর্খ পুরোহিতকে প্রতারক ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে? বাটা বা লয়েড জর্জের মত মুচী বা মুচীর ছেলে প্রতিভা দেখাইলে সমাজে কেন শ্রেষ্ঠ স্থান পাইবে না?”
তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ খণ্ডন করতে মেঘনাদ সাহা এর পর চারটি প্রবন্ধ লেখেন। এগুলোতে ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই চারটি প্রবন্ধ দেখলেই বোঝা যায় যে হিন্দু ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিলো অত্যন্ত গভীর পর্যায়ের। শান্তি নিকেতনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটা ভাসাভাসা জ্ঞান বা পরের মুখে ঝাল খেয়ে ঝালের বর্ণনা দেওয়া ছিলো না। হিন্দু ধর্ম ও দর্শনের উপর ব্যাপক পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। কী কারণে তিনি এগুলো নিয়ে পড়েছিলেন, তার একটা অতীত ইতিহাস রয়েছে।
শান্তিনিকেতনে বক্তৃতা দেবার আগেই. মেঘনাদ সাহা মাসিক ভারতবর্ষ পত্রিকায় ‘একটি নতুন জীবন দর্শন’ (১৩ নভেম্বর, ১৯৩৮) শিরোনামের প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি কটাক্ষমূলক একটি উক্তি করেছিলেন। উক্তিটি হলো -‘সবই ব্যাদে আছ’! এই উক্তিটি নিয়ে অনিলবরণ রায় নামের এক হিন্দুত্ববাদী ব্যাপক জলঘোলা করা শুরু করলে তিনি ‘সবই ব্যাদে আছে’ নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন,
“প্রায় আঠারো বৎসর পূর্বেকার কথা। আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরবাসী লব্ধপ্রতিষ্ঠিত এক উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি উৎসাহভরে তাহাকে আমার প্রথম জীবনের তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দু-এক মিনিট পরপরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নতুন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদ-এ আছে”। আমি দু একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, ‘মহাশয় এ সব তত্ত¡ বেদের কোন অংশে আছে তাহা অনুগ্রহ পূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?’ তিনি বলিলেন, “আমি তো ব্যাদ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর, তাহা সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে”।
বেদের কোথায় এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লুকিয়ে আছে এটা জানতে পরের কুড়ি বছর মেঘনাদ সাহা বেদ, উপনিষদ, হিন্দু জ্যোতিষ আদ্যোপান্ত পড়ে ফেললেন। কিন্তু, এই বিজ্ঞান আর খুঁজে পেলেন না কোথাও। ‘সবই বেদে আছে’ এই কথাটা তখন তাঁর এবং তাঁর বন্ধুদের কাছে অজ্ঞতার নামান্তর হয়ে গেলো। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তাঁর বহু লেখায় ঠাট্টার ছলে এই কথাটি ব্যবহার করেছেন।
কাজেই, শুধু কোরান একাই যে বিজ্ঞানময় কিতাব, তা নয়। বেদের মধ্যেও বিজ্ঞানের সবকিছু পুরে দিয়েছে ভগবান আরো আগে থেকেই। আফসোস শুধু একটাই, বিজ্ঞানীরা সেই বিষয়ে কিছুই জানলো না। পৃথিবীর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই বিজ্ঞানে দিয়ে ঠাসা এই দুটো বিজ্ঞানগ্রন্থকে কিংবা অন্য বাইবেলসহ অন্য সব বিজ্ঞানময় ধর্মগ্রন্থকে পাঠ্য পুস্তক করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তকতো দূরের কথা, রেফারেন্স বই হিসাবেও এগুলো বিবেচিত হয় না।