ভজন সরকার : সময় থেমে থাকবে না। মানুষ না থাকলেও এ পৃথিবী থাকবে। এ কথা মর্মান্তিকভাবে সত্যি যে, এ পৃথিবীর বেঁচে থাকার উপর মানুষের থাকা কিংবা না-থাকা কিছুই নির্ভর করে না। পূর্বেও কোটি কোটি বছর এ পৃথিবী ছিল; তখন মানুষ ছিল না। হয়ত পরেও কোটি কোটি বছর এ পৃথিবী থাকবে মানুষ ছাড়াই।

এক সময় এই পৃথিবী এবং সৌরজগত থাকবে না। আমাদের সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র যার নাম সূর্য, সে সূর্যও একদিন নিস্প্রভ আলোহীন, উত্তাপহীন হয়ে পড়বে। এক হিমশীতল অন্ধকারের তলিয়ে যাবে সব। মহাবিশ্ব যেভাবে শূন্য বা সিংগুলারিটি থেকে উৎপত্তি হয়েছিল, এক সময় হয়ত সেই পূর্বাবস্থাতেই ফিরে যাবে। এমনও হ’তে পারে গঠিত হবে এরকম অসংখ্য পৃথিবীর কিংবা সৌরজগতের। এ সব কাল্পনিক কাহিনি নয়, বিজ্ঞানের থিওরি এবং হাইপোথিসিস দিয়ে প্রমানিত ও পরীক্ষিতও বটে।

তাই আমরা অর্থাৎ মানুষ এ পৃথিবীর জন্য কোনো অত্যাবশ্যকীয় বা প্রয়োজনীয় উপকরণ নই। বরং মানুষ না থাকলেই এ পৃথিবী তার স্বাভাবিক সত্বা ফিরে পাবে। সবুজে -শ্যামলে ভরে যাবে চারিদিক। পাতা রঙ ফিরে পাবে। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকবে চারিদিক। গাছেরা নির্ভয়ে-নির্বিরোধ বেড়ে উঠবে আনাচে-কানাচে।

মানুষ না থাকলে এ পৃথিবীতে পশুরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াবে। কীট-পতংগ ফড়িং রং-বাহারে উড়ে বেড়াবে। সমুদ্র থেকে বিশুদ্ধ বাষ্প হয়ে মেঘ জমবে নির্মল আকাশে। পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি পড়বে। ঝর্ণার জল বিশুদ্ধ উপত্যকা গড়িয়ে নদীতে ঢেউ তুলবে। মাছেরা কিলবিল করবে জলে। সমুদ্রে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বেড়ে উঠবে উপদ্রুপহীন। কার্বনহীন ধোঁয়াহীন পৃথিবী প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করবে নিরন্তর।

একবার ভেবে দেখুন, আসলেই কি মানুষের খুব বেশী প্রয়োজন এ পৃথিবীর? মহাবিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম। সমগ্র মহাবিশ্বে পৃথিবী নামের এ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহটির অবস্থান মাইক্রোস্কপিক। তাই পৃথিবী নামের গ্রহটির থাকা বা না-থাকা মহাবিশ্বের জন্যেও কিছু যায় বা আসে না।

পৃথিবীতে মানুষের যা প্রয়োজন, তা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যেই প্রয়োজন। আর মানুষ নিজেরা বেঁচে থাকতে এমন কোনো অপকর্ম বা নির্মমতা নেই, যা করছে না। উদ্ভিদ-প্রাণী সব মেরে কেটে মানুষ নিজেদের জীবন ধারণ করছে।

এ পৃথিবীকে আমাদের মায়ের আসনে বসিয়ে একবার ভাবুন তো। মায়ের কাছে যদি প্রতিটি সন্তান হয় সমান আদরের, সমান ভালোবাসার, তবে এ পৃথিবীর কাছে মানুষ আর অন্যান্য প্রাণী বা উদ্ভিদের মর্যাদা ও ভালোবাসা তো একই হবে। তাই নয় কি?

আমরা কতো না গর্বে-গৌরবে মানুষের জয়গান করি; মানুষের বুদ্ধিমত্তার তারিফ করি। নিজেদের অহংকারে নিজেরা ফুলে-ফেঁপে উঠি। অথচ আমরাই কি এ পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব? পায়ের নিচে পড়ে থাকা একটি তৃণও কি আমাদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান? প্রতিদিন পায়ে দ’লে যাওয়া দুর্বা ঘাস কিংবা মানুষের স্পর্শে আতঙ্কে আঁতকে ওঠা লজ্জাবতী লতাটি কি আমাদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান? বেঁচে থাকার কলা-কৌশল কি আমাদের চেয়ে তাদের কিছু কম?

চারপাশের প্রাণীক‚ল কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নিজেদের প্রতিরোধ করছে! কী অপূর্ব কৌশলে ভয়ানক মানুষের ভয়ঙ্কর হিংস্রতা থেকে বেঁচে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে! আর আমরা যারা মানুষ, তারা নির্বোধ আনন্দে নিজেদের জয়গান গাইছি! একবারও ভাবছি না আমাদের এই বেঁচে থাকাটাই অন্যান্য উদ্ভিদ-প্রাণীর চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ের ফল!
আজ থেকে অনেক বছর আগে আমার এক প্রিয় সাহিত্যিক এবং তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রসর এক মানুষ, কবি-প্রথাবিরোধী লেখক- ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এক প্রবন্ধে বলেছিলেন,
“খুব নরম, বেদনাতুর স্বরে ডেকে আজকাল জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, কেমন আছো, পৃথিবী? নিশ্চয়ই ভালো নেই…। অনেক শতাব্দী ধরেই, সম্ভবত মানুষের আবির্ভাবের সময় থেকেই কষ্টে আছে পৃথিবী ও তার সন্তানেরা”।

সত্যি তো, আজ এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ ও বুৎপত্তির যুগে এসেও সে কথাটিই জানতে ইচ্ছে করে। আসলেই কী পৃথিবী ভালো আছে? এই করোনা-আক্রান্ত সময়ে পৃথিবীর মানুষ ভালো নেই। কিন্তু গোটা পৃথিবী ও তার সন্তানেরা? আজ নয়, হয়ত অনাগত ভবিষ্যতই ব’লে দেবে এই অদৃশ্য করোনা নামের ভাইরাসটি আশীর্বাদ, না অভিশাপ হিসেবে এসেছিলো একবিংশ শতাব্দীতে জননী বসুন্ধরার বুকে।

একা একা যে এখন আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, সেটি আমরা ভুলেই বসেছিলাম। ‘করোনা’ ভাইরাস নামের মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, প্রতিটি মানুষের জীবন তাঁর পাশের মানুষটির ভালো থাকার উপর নির্ভর করে। পাশের মানুষটি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। পৃথিবীর অন্য সবার ভালো থাকার উপরও আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভরশীল।

‘করোনা’ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষ হারিয়ে গেছেন চিরকালের জন্য। কতো মানুষ প্রিয়জন হারিয়েছেন। কতো পরিবার বেঁচে থাকার শেষ ভরসাটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। সারা পৃথিবী মাসের পরে মাস স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষাসহ অর্থনীতির চাকা অচল।

কিন্তু ‘করোনা’ যা দিয়ে গেল, সেগুলোও কি কম? ‘করোনা’ -মুক্ত পৃথিবীতে মানুষের শিক্ষা নিতে হবে অনেক। মানুষকে মানবিক হতে হবে আরও। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র না বাঁচলে মানুষও বাঁচবে না। মানুষকে নিজের বাঁচার জন্যই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু সে শিক্ষা মানুষ নেবে কি ‘করোনা’ অতিক্রান্ত আগামী সময়ে?
ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা