ড: বাহারুল হক: বিবাহের ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের মতোই পুরানো। বিবাহ কী? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়- আইন অনুসরন করে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে কতগুলো শর্ত মেনে চলার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে দুই জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ পরস্পরের হাত ধরে এক সাথে জীবন পথ চলতে নামার ব্যবস্থাকে বলে বিবাহ। শর্তগুলো কী? শর্ত অনেক, তম্মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ কতেক হলো: (১) ঘনিষ্ঠতা (২) ভালোবাসা ও প্রতিজ্ঞা (৩) ধৈর্য্য ও ক্ষমা (৪) সততা ও বিশ্বাস (৫ ) বিনীততা বা বিনম্রতা, এবং (৬) নিঃস্বার্থপরতা।
বিবাহের বিভিন্ন প্রকার ভেদ আছে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে বিবাহের সে সব প্রকার ভেদ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বড় দাগে ভাগ করলে দেখা যায় বিবাহ দুই প্রকার- সিভিল বিবাহ ও রিলিজিয়াস বিবাহ। পাত্র-পাত্রী যে দেশে অবস্থান করছে সে দেশের বিদ্যমান আইন অনুসরন করে বিবাহ সম্পন্ন হলে সেটাকে সিভিল বিবাহ বলে গণ্য করা হয়। বিবাহ সম্পাদিত হওয়ার বিষয়টা রাষ্ট্রীয় নথিতে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। অপরদিকে রিলিজিয়াস বিবাহ পাত্র-পাত্রীর ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়। রিলিজিয়াস আর সিভিল বিবাহ কিন্তু একটা আরেকটার পরিপুরক নয়। সাধারণত একই জোড়া পাত্র-পাত্রী উভয় প্রকারে বিবাহ সম্পন্ন করে। যেহেতু ধর্মকে বাদ দেওয়া যায় না তাই রিলিজিয়াস পদ্ধতি অনুসরণ করে বিবাহ করতে হয় আবার একটা দেশের অধিবাসী বলে সে দেশের আইন বিধান মেনে চলার বাধ্য বাধকতা আছে বলে সিভিল বিবাহও সম্পন্ন করতে হয় এবং তা করা হয় রিলিজিয়াস বিবাহের আগে বা পরে বা সম্ভব হলে একসাথে। সিভিল বিবাহ হলে (ঐ দম্পত্তির বিবাহ রিলিজিয়াস বিবাহ না হলেও) বিবাহ পরবর্তি সমস্যা সমাধানে স্বামী-স্ত্রী আইনের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু বিবাহটি যদি শুধু রিলিজিয়াস হয় (বিবাহ রেজিস্ট্রেশন এবং সার্টিফিকেট বিহীন) তাহলে বিবাহ পরবর্তি জটিলতার সমাধান চেয়ে স্বামী-স্ত্রী আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার কোন সুযোগ পায় না।
কার সাথে কার বিবাহ হচ্ছে সেটার উপর ভিত্তি করেও বিবাহের নানা টাইপ নির্ধারণ করা হয়। এভাঙকুলেট বিবাহও এক ধরনের বিবাহ যেখানে বিবাহ সম্পন্ন হয় মামা খালার সাথে ভাগিনা ভাগিনীর। পাত্র যদি পাত্রীর মামা হয় বা পাত্রী যদি পাত্রের খালা হয় তাহলে সে বিবাহকে এভাঙকুলেট বিবাহ বলে গন্য করা হবে। এভাঙকুলেট বিবাহ প্রথা একটি স্বীকৃত প্রথা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে হাজার হাজার বছর আগে থেকে। প্রাচীন মিসর থেকে আধুনিক ভারতের বিবাহ প্রথা পর্যালোচনা করলে এই এভাঙকুলেট বিবাহের দেখা মিলবে। পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা ব্যাক্তির বিবাহ ছিল এভাঙকুলেট বিবাহ। খ্যাতনামা ব্যাক্তিদের মধ্যে আছেন প্রাচীন মিশরের ফারাও সম্রাজ্ঞী বিশ্বখ্যাত ক্লিওপ্যাট্রা। ক্লিওপ্যাট্রা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তার মামা ৮ম টলেমির সাথে। রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের ৪র্থ স্ত্রী এগ্রিপিনা ছিলেন তারই ভাগিনী। বাইজেন্টাইন সম্রাট হ্যারিক্লিয়াস বিবাহ করেছেন তার ভাগিনী মার্টিনাকে। জাপানের সম্রাট সুজাকু এবং প্রিন্সেস হিরোকোর বিবাহও ছিল এভাঙকুলেট বিবাহ। একই দেশের সম্রাট হরিকাওয়ার স্ত্রী প্রিন্সেস টুকুশি ছিলেন হরিকাওয়ার মায়ের চাচাতো বোন। পর্তুগালের সম্রাট ৫ম আফোনসো বিবাহ করেছেন নিজের ভাগিনী জোয়ান্না কে। এভাঙকুলেট বিবাহ যাদের তাদের মধ্যে আরো আছেন স্পেনের রাজা ২য় ফিলিপ, ৫ম ফিলিপ, রোমান সম্রাট ১ম লিওপোল্ড, বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার, এডলপ হিটলারের পিতা এলয়েস হিটলার, কম্বোডিয়ার শাসক প্রিন্স নরোদম সিহানুক।
এভাঙকুলেট বিবাহের উদাহরন মুসলিম সমাজে একদম নেই। কারণ ইসলাম ধর্মে এভাঙকুলেট বিবাহ নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরান-এর সুরা নিসার ২৩ নম্বর আয়াতে স্পস্টভাবে উল্লেখ আছে কাকে কাকে একজন মুসলমান পুরুষ স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করতে পারবে না। এই নিষিদ্ধদের তালিকায় আছে নিজের মা, মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাইয়ের মেয়ে, ভাগিনী, দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ি, নিজের পুত্রের স্ত্রী এবং স্ত্রী জীবিত অবস্থায় স্ত্রীর বোন।
হিন্দু ধর্ম হিন্দু বিবাহের বিষয়ে কি বিধান রেখেছে তা আমার বিস্তারিত জানা নাই। তবে জাতি ভেদে যে নিয়ম প্রথার হের ফের আছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যেমন, বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে এভাঙকুলেট বিবাহের প্রচলন নাই। বরং বাঙালী হিন্দুরা বিবাহ বিষয়ে মুসলিমদের চেয়েও বেশি কড়া। খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই বোনদের মধ্যে বিবাহ মুসলিম সমাজ অনুমোদন করে কিন্তু এ ধরনের ফার্স্ট কাজিনদের (কাকাতো, মামাতো, পিসিতো, মাসিতো ভাই বোন) মধ্যে বিবাহ বাঙালী হিন্দু সমাজে নিষিদ্ধ। বিবাহ বিষয়ে বাঙালী হিন্দুরা তাদের আদি গ্রন্থ বেদ (ঋগবেদ) এবং মনুসংহিতার বানী মেনে চলে। এসব গ্রন্থে উল্লেখ আছে ঘনিষ্ঠ রক্ত সম্পর্কে বিশেষত পিতৃকুলে বংশের সাত পুরুষ আর মাতৃকুলে বংশের পাঁচ পুরুষের ছেলে মেয়েদের মধ্যে বিবাহ হতে পারবে না। পিতৃকুলের সাত পুরুষ আর মাতৃকুলের পাঁচ পুরুষ চলে গেলে বিবাহ হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্র বলে মানবদেহে পুরুষানুক্রমে সপ্তমপুরুষ (সাতপুরুষ) পর্যন্ত একই রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই ঐ সাতপুরুষ পর্যন্ত ছেলে মেয়ের বিবাহ নিষিদ্ধ।
কিন্তু দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিঢ় হিন্দু সমাজে এভাঙকুলেট বিবাহ হর হামেশা হচ্ছে। বিশেষ করে কর্ণাটকা রাজ্যের ব্রাহ্মন সমাজে এভাঙকুলেট বিবাহই বিবাহের প্রধান প্রথা। কোন পাত্রীর জন্য মামা বা কোন পাত্রের জন্য ভাগিনী না মিললে তখন অন্য বিবাহের কথা ভাবা হয়।
জিন বিজ্ঞান, শারীর বিজ্ঞান, ও মানব প্রজনন বিজ্ঞান যৌথভাবে যে সত্য প্রকাশ করেছে তা হলো শারীরিক মানসিক ভাবে সুস্থ্য, সবল, ও জেনেটিক সমস্যা মুক্ত সন্তান হওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে সন্তানের পিতা মাতার মধ্যে রক্তের সম্পর্কের উপর। পিতা মাতা রক্তের সম্পর্কে যত বেশি কাছের হবেন তাদের ঘরে জেনেটিক নানা সমস্যা, যেমন, টার্নার সিনড্রোম, লাইনফেল্টার সিনড্রোম, ডাউন সিনড্রোম, ক্রাই ডু চ্যাট সিনড্রোম, মারফান সিনড্রোম, এঙ্গেলম্যান সিনড্রোম, এপার্ট সিনড্রোম, টোরেট সিনড্রোম, উইলিয়ামস সিনড্রোম, রেট সিনড্রোম, প্রেডার-উইলি সিনড্রোম, নুনান সিনড্রোম, এহলার্স-ডানলস সিনড্রোম ইত্যাদি নানা প্রকার সিনড্রোম যুক্ত সন্তান আসার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। কারণ রক্তের সম্পর্কে তারা যত বেশি ঘনিষ্ট হবেন তারা তত বেশি জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল (ডিএনএ) শেয়ার করবেন আর ডিএনএ যত বেশি শেয়ার করবেন ত্রæটিযুক্ত সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। পিতা মাতা যদি সম্পর্কে আপন ভাই বোন হয় (পুর্ণ সিবলিং) তাহলে তারা শেয়ার করবে তাদের জিন পুলের ৫০% ডিএনএ। পিতা মাতার মধ্যে যদি সম্পর্ক এমন হয় যে তারা ভাই বোন কিন্তু দুই জনের প্রত্যেকের হয় মাতা কিংবা পিতা আলাদা, অর্থাত তারা অর্ধ সিবলিং, সে ক্ষেত্রে তারা শেয়ার করবে ২৫% ডিএনএ। ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে অর্থাত চাচাতো মামাতো ফুফাতো খালাতো ভাই বোন দের মধ্যে যদি বিবাহ হয় স্বামী স্ত্রী হিসেবে তখন তারা শেয়ার করে ১২.৫০% ডিএনএ। বিবাহ যদি এভাঙকুলেট হয় সে ক্ষেত্রে জিন শেয়ারিং হবে ৩৭.৫০% (মামার ২৫% + ভাগিনীর ১২.৫০% = ৩৭.৫০%)।
তাহলে বিশ্লেষণে দেখা গেল ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে বিবাহের চেয়ে এভাঙকুলেট বিবাহ বেশি ক্ষতিকর, কারণ, এভাঙকুলেট বিবাহে জিন শেয়ারিং ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে বিবাহের জিন শেয়ারিং এর চেয়ে বেশি। এভাঙকুলেট ৩৭.৫০% অপরদিকে ফার্স্ট কাজিন ২৫%। তার অর্থ ডিফেক্টিভ শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনাও ফার্স্ট কাজিনের চেয়ে বেশি। বিবাহ বিষয়ে পাত্র পাত্রী নির্বাচনে বাঙালী হিন্দুরা খুবই সাবধানী এবং এই সাবধানতার সুফল তারা ভোগ করছে। বাঙালী হিন্দুরা মেধাবি এবং বাঙালী হিন্দু কমিউনিটিতে প্রতিবন্ধির সংখ্যা একেবারে কম। অপর দিকে ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে বিবাহ সম্পাদনে কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় মুসলিম কমিউনিটিতে প্রতিবন্ধিদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি। আগেই বলেছি কর্ণাটকের উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে এভাঙকুলেট বিবাহের খুব চল আর এর কুফলও তারা ভোগ করছে। সেখানে প্রায় ৩% মানুষ প্রতিবন্ধি।
আমি কর্ণাটক ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম দীর্ঘ চার বছর। ব্যাপারটা আমার দৃস্টি কেড়েছে। আমি সেখানকার আমার এক হিন্দু বন্ধুর সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছিলাম। তার ভাষায়- “আমাদের সমাজে নিজ বংশ বলতে শুধু পিতার বংশকে বুঝায় এবং সে বিচারে পিতার পক্ষের সবাই আপন। ফলে আমরা পিতার বংশের কারো সাথে বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ হইনা। অন্য দিকে এখানকার হিন্দু সমাজে মায়ের বংশ নিজ বংশ বলে বিবেচিত হয় না। ফলে মাতৃকুলে মা ছাড়া আর সবাই এখানে পর বলে বিবেচিত হয় এবং সে জন্য এখানে সমাজ পতি বা পুরোহিত কারো পক্ষ থেকে এভাঙকুলেট বিবাহের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয় না”। আমি বললাম- “বাঙালী হিন্দুদের প্রথায় বিজ্ঞানের ছাপ; তোমরাও তো হিন্দু তোমাদের প্রথায় কিন্তু আবেগের ছাপ”। আমার বন্ধু বললো- “ছেলে মেয়েরা যেভাবে আধুনিক শিক্ষা লাভ করছে এবং এভাঙ্কুলেট বিবাহের ডিমেরিটস গুলো বুঝতে পারছে তাতে,আমার বিশ্বাস, এভাঙকুলেট বিবাহ আমাদের সমাজে আর থাকবে না, এ প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবে”।