ফরিদ আহমেদ : মধ্যযুগের ইউরোপে সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদকে নিয়ে রক্ত ঝরেছিল। বিজ্ঞানীদের রক্তে লাল হয়েছিলো সেখানকার মাটি। বিজ্ঞানের গলাকে টিপে ধরার জন্য যত ধরনের হিংস্রতা দেখানো দরকার, তার সবটুকুই করেছিলো ধর্ম। অস্তিত্বের উপর হুমকি আসলে ধর্ম আর শান্তির ধর্ম থাকে না। নেকড়ের মতো হিংস্রতা প্রদর্শন করে তা। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ ধর্মের অস্তিত্বের ভিত্তিতে আঘাত হেনেছিল। সেই আঘাত রুখতেই পাল্টা আঘাত হেনেছিল খ্রিস্টান ধর্ম।
সেই রক্তাক্ত ইতিহাসকে বাদ দিলে, বিবর্তন ছাড়া বিজ্ঞানের আর কোনো মতবাদকে নিয়ে এমন বিতর্ক আর হয়নি। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ অনেক চড়াই পেরিয়ে এখন বিতর্কের বাইরে চলে গিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে এটাকে, এমনকি ধর্মও। সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসী দুই চারজন গোঁড়া লোক ছাড়া, বাকি সবাই জানে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে না, বরং উল্টোটা। কিন্তু, বিবর্তনবাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। এখনও বহু মানুষের ধারণা হচ্ছে যে এটা শুধুই একটা তত্ত¡ মাত্র, প্রমাণিত সত্য নয়। বিবর্তনকে তত্ত¡ বলে এটাকে হালকা করার একটা অপচেষ্টা প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। আমরা ধরে নেই যে তত্ত¡ হচ্ছে একটা অনুমান বা ধারণা মাত্র, প্রমাণিত কিছু না।
আমরা সাধারণ অর্থে থিওরি বলতে যা বুঝি, বিজ্ঞানে থিওরিকে সেই অর্থে ব্যবহার করা হয় না। বিজ্ঞানের ভাষায় থিওরি শব্দটার অর্থ হচ্ছে, প্রাকৃতিক বিশ্বের কোন বৈশিষ্ট্যে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। এটা গড়ে ওঠে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। কোনো ধারণাকে তত্ত¡ হিসেবে গ্রহণ করার আগে বিজ্ঞানীরা নানাভাবে সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত¡, আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’, এগুলোও তত্ত¡। কিন্তু এর মানে এই না যে এগুলো প্রমাণিত কিছু না।
বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ইউজিন কুনিন যেমন বলেছেন, “বেশিরভাগ মানুষ যারা ধর্মীয় অনুশাসনের নিচে থাকেন, তাঁরা এই কথাটা বারবার বলেন, থিওরি হলো এমন একটা ব্যাপার যা হয়তো এসেছে কোন ভিত্তিহীন ধারণা থেকে; বা কাকতালীয় ভাবে এবং এসব থিওরিকে গুরুত্ব সহকারে নেবার কিছুই নাই। এমন একটা ভাব যেন এটা কোনো গণ্য করার মত ব্যাপারই না। অথচ বিজ্ঞানে থিওরি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পোষণ করে।”
তাই বিবর্তনবাদকে যখন একটি তত্ত¡ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তখন এটা আর সাধারণ কোন বিষয় না থাকে না। অত্যন্ত শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক একটি বিষয় বলে পরিগণিত হয়। বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রতিনিয়তই পরীক্ষাগারে বা বাইরের পরিবেশে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আগেই বলেছি, এটা সবচাইতে বিতর্কিত একটি তত্ত¡। যখন কোনো তত্ত¡ বিতর্কিত হয় তখন সেটা নিয়ে আরও বেশি বেশি গবেষণা করা হয়। দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে বিবর্তনবাদ ক্রমাগতভাবে পরীক্ষিত হয়ে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে একটি পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ফলাফলও বিবর্তনবাদের বিপক্ষে যায়নি। যে কোনো তত্ত¡ যখন দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে, সেটাকে একটি অতি বিশেষ তত্ত¡ হিসাবে গুরুত্ব দিতেই হবে। মুখের কথায় এটাকে বাতিল করে দেওয়া সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই বিবর্তন তত্ত¡ ব্যবহার করে ওষুধ বানাচ্ছেন, বিভিন্ন জীবাণুর প্রতিষেধক বানাচ্ছেন। এই তত্ত¡ ব্যবহার করে মানুষসহ নানা প্রাণী এবং উদ্ভিদের জিনোমের তথ্য উদঘাটন করছেন। বর্তমান সময়ে গবেষণাকারীরা এক নতুন ধরনের জীনতত্ত¡ বা ইভো ডেভো টেকনিক ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অর্গানিজমের মধ্যে বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ট্রেস করা সম্ভব হয়। এই সব ব্যবহারিক দিকই হলো বিবর্তনের জন্য এক একটি পরীক্ষা। ব্যবহারিক দিকগুলো অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হলে বিবর্তনবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তো। কিন্তু, সেটা হয়নি। বিবর্তনবাদ একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী তত্ত¡ হিসাবে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
জীববিজ্ঞানের সবগুলি শাখার জন্য বিবর্তনবাদ হচ্ছে একটি মেলবন্ধন। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিবর্তনবাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে প্যালিওন্টোলজি, জিওলজি, মাইক্রো-বায়োলজি, জেনেটিকস, মলিকিউলার বায়োলজি, ইকোলজি, এবং অতি সা¤প্রতিককালের ইভ্যুলুশনারী ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি । থিওডেসিয়াস ডবঝনস্কি যেমন বলেছেন, “বিবর্তনবাদ ছাড়া জীববিজ্ঞানের কোনো কিছুই অর্থ বহন করে না।”
ডবঝনস্কি যাই বলুক না কেনো, তাতে অনেক মানুষেরই কিছু যায় আসে না। তারা বিবর্তনবাদকে মানে না। শুধু মানে না বললেও ভুল হবে। এই তত্তে¡র বিরুদ্ধে এক ধরনের আক্রোশী মনোভাব পোষণ করে। সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের বাইরে ধর্মের সবচেয়ে আক্রোশের জায়গা হচ্ছে বিবর্তনবাদ। সূর্যকেন্দ্রিক ধারণাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে চার্চ। আগে যে অন্যায় তারা করেছে সেজন্য ক্ষমাও চেয়েছে অফিসিয়ালি। কিন্তু, বিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি তারা। পারবেই বা কী করে? বিলিয়ন বছরের বিবর্তনে এককোষী প্রাণী থেকে বিবর্তিত হতে হতে আমরা আজকের মানুষে পরিণত হয়েছি, এটাকে স্বীকার করলে সৃষ্টিজগতে মানুষের আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকে না। ঈশ্বর নিজের হাতে অতি যতœ করে মানুষকে বানিয়েছেন, তারপর ছয় হাজার বছর আগে এই পৃথিবীতে এক জোড়া মানুষকে ছেড়ে দিয়েছেন, এই গল্প হাস্যকর এক ছেলেমানুষি গল্পে পরিণত হয়ে যায় বিবর্তনকে মানতে গেলে। যে কারণে এই তত্ত¡ যখন ডারউইন প্রথম প্রচার করেন, তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে ধার্মিকেরা। ডারউইন এবং তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত¡কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে, ঠাট্টা-তামাশা করতে কোনো ধরনের কুণ্ঠা তারা দেখায়নি। অথচ আজকে বিজ্ঞানের নানান শাখা, বিশেষ করে প্রত্নতত্ত¡ এবং জিনতত্তে¡র অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা জানি বিবর্তনবাদ শুধু তত্ত¡ই নয়, এটা ফ্যাক্ট। মানুষ বিবর্তিত একটা প্রাণী। শুধু মানুষ না, এই পৃথিবীর পুরো প্রাণীজগৎ এবং উদ্ভিদজগৎ, সবই বিবর্তনের ফসল। কাল্পনিক কোনো মহামতি ঈশ্বরের অলৌকিক হাত নেই সেখানে।
বিবর্তন কেনো সত্য সেটা নিয়ে জেরি কোয়েন তাঁর বই ‘হোয়াই ইভোলিউশন ইজ ট্রু’ বইতে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই বইতে তিনি বিবর্তনের পক্ষের নানা তথ্য প্রমাণকে হাজির করেছেন। ফসিল রেকর্ড থেকে থেকে তিনি বিভিন্ন প্রমাণ দেখিয়েছেন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ফসিল কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সেটা দেখিয়েছেন তিনি। যেমন, প্রিক্যাম্ব্রিয়ান রকে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল পাওয়া যায়নি। তিনি ভেস্টিজেজ, এমব্রায়োজ এবং ব্যাড ডিজাইন থেকে উদাহরণ টেনেছেন। দেখিয়েছেন, মানব ভ্রূণে লেজের অস্তিত্ব রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার হাতে তৈরি হলে সবকিছু নিখুঁত হবার কথা। বাস্তবে আমরা অসংখ্য ব্যাড ডিজাইন দেখি। বায়োজিওগ্রাফি থেকেও প্রমাণ দেখিয়েছেন তিনি। সহজ, সরল এবং আকর্ষণীয় ভাষায় বিবর্তনের স্বপক্ষের অস্তিত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে জেরি কোয়েনের বইয়ের চেয়ে ভালো বই আর হয় না। সৃষ্টিবাদীরা যখন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে আমেরিকাতে বিবর্তনের পাল্টা তত্ত¡ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, সেই সময়ে জেরি কোয়েন এই বইটা লেখেন। ফলে, এই বইতে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের পক্ষের লোকদের অনেক যুক্তিকেই খণ্ডন করা হয়েছে।
যুক্তি খণ্ডন করা হলেই কি বিবর্তনকে সবাই সত্য বলে মেনে নেবে? জেরি কয়েনের বই পড়েই কি সবাই বিবর্তন সত্য বলে স্বীকার করে নেবে? এর উত্তর নিশ্চিতভাবেই নেতিবাচক। আগেই বলেছি, বিবর্তনের বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়ে রেখেছে, তাদের অবস্থানের পক্ষের একটা মূল কারণ হচ্ছে ধর্ম বা বিশ্বাস। সেটাকে আসলে যুক্তি দিয়ে নড়ানো খুব কঠিন একটা কাজ। জেরি কোয়েন নিজেও বিষয়টা জানতেন। যে কারণে তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন, “এই বইটা বিবর্তনের প্রধান বিষয়গুলোকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যাঁরা ডারউইনবাদকে শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে বিরোধিতা করেন, তাঁদেরকে নড়ানোর জন্য কোনো প্রমাণই যথেষ্ট নয়। কারণ, তাঁদের ধারণা যুক্তির উপরে গড়ে ওঠে নাই, গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। তবে, অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁরা কিছুটা অনিশ্চিত, অনেকেই আছেন বিবর্তনকে মেনে নেন, কিন্তু জানেন না কীভাবে এর স্বপক্ষে যুক্তি সাজাতে হয়, তাঁদের জন্য এই বইটা কেনো আধুনিক বিজ্ঞান বিবর্তনকে সত্য বলে মেনে নেয় তার একটা সারসংক্ষেপ দেবে।”
বিশ্বাসীরা যুক্তি বুঝলেও, সেটাকে সহজে মেনে নিতে পারে না, তার একটা উদাহরণ তিনি তাঁর লেখা ‘ফেইথ ভার্সেস ফ্যাক্ট’ বইতে দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন শিকাগোর একদল ব্যবসায়ী একবার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিবর্তনের উপরে লেকচার দেবার জন্য। লাঞ্চ টাইমে সেই লেকচার দেন তিনি। সেই লেকচারে ট্রানজিশনাল ফসিল রেকর্ড, ভেস্টিজিয়াল অর্গানের ছবি দেখান, ডলফিনের ভ্রূণের বিকাশের সময়ে পায়ের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলীন হবার বিশৃঙ্খলা দেখান। তাঁর লেকচার শুনে বেশ মুগ্ধ হন ব্যবসায়ীরা। প্রশংসা করেন সবাই।
এদের মধ্যে একজন তাঁর কাছে এগিয়ে আসেন। করমর্দন করে বলেন, “ডঃ কোয়েন আপনার দেওয়া প্রমাণগুলো খুবই বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু তারপরেও আমি এগুলোকে বিশ্বাস করি না।”
ভদ্রলোকের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন জেরি কয়েন। প্রমাণগুলো সব বিশ্বাসযোগ্য বলার পরেও কীভাবে সেগুলোতে কেউ বিশ্বাস করে না, এটা শুনে হতভম্ব হবারই কথা। তবে, এর উত্তর তিনি নিজেই পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, “তাঁর ধর্ম তাঁকে আমার প্রমাণ গ্রহণ করতে বাধা দিয়েছে।”
বিশ্বাস মানুষের যৌক্তিক মানসকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত করে।