ফরিদ আহমেদ : বহুকাল আগে পৃথিবীতে এক মহা বিপর্যয় নেমে এসেছিলো। হিসাব করে বললে সেটা ছিলো ছেষট্টি মিলিয়ন বা ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে। পৃথিবীর প্রাণীজগতে ভয়ংকর এক ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করেছিলো সেটা। অনেক প্রাণীই পুরো প্রজাতিসহ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো চিরতরে এই ধরণী থেকে। সেই বিপর্যয়ে অবশ্য হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হবার কোনো কারণও ছিলো না। আধুনিক মানুষের তখন জন্মই হয়নি এই পৃথিবীতে। এর বহু বহু কাল পরে, এখন থেকে মাত্র দুই লক্ষ বছর আগে অন্য প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মানুষ জন্ম নিয়েছে ধরণীতে। সময়ের মাপকাঠিতে, পৃথিবীতে প্রাণের ইতিহাসে, বলতে গেলে মানুষ একেবারেই নতুন এক প্রজাতি এই ধরাতে।
ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগের সেই বিপর্যয়টা ঘটেছিলো বিশাল এক উল্কার আঘাতে। এখন যেটা মেক্সিকো, সেই অঞ্চলে ঘটেছিলো এই উল্কাপাত। আকস্মিক সেই উল্কাপাত সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছিলো সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীদের। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলো ডাইনোসর। বিশালাকৃতির ডাইনোসররা রাজত্ব করতো পৃথিবীতে তখন। মানুষ তখনও দূর ভবিষ্যতের এক প্রাণী। উল্কাপাতের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর জলবায়ুতে যে বিশাল পরিবর্তন দেখা দেয়, সেটাতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে নাই ডাইনোসররা। ফলে, সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যায় তারা। শুধু ডাইনোসর নয়, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আড়াই কেজি ওজনের চেয়ে বড় সকল ধরনের চারপেয়ে প্রাণী অদৃশ্য হয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। দুই একটা ব্যতিক্রম যে ছিলো না, তা নয়। সে রকম একটা হচ্ছে লেদারব্যাক টার্টল বা কচ্ছপ।
প্রশ্ন হচ্ছে, উল্কাপাতটা যে ঠিক ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে ঘটেছিলো, সেটা বিজ্ঞানীরা জানলো কীভাবে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, ডাইনোসরের যে ফসিলগুলো পাওয়া যায়, তার সবগুলোই ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছরের বেশি পুরনো। এই সময়কালের চেয়ে কম সময়কালের ডাইনোসরের কোনো ফসিল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হুট করে এসে ওই সময়কালটাতে ডাইনোসরের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এ কারণে, অনুমান করা সহজ যে উল্কাপাতের বিপর্যয়টা ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে কোনো এক সময়ে ঘটেছিলো। যে কারণে ওই সময়ের পরের ডাইনোসরের কোনো ফসিল আর পাওয়া যায়নি।
ধ্বংসের ছাই থেকে যেমন ফিনিক্স পাখি উঠে এসেছিলো, পৃথিবীর এই মহা বিপর্যয়ের সময়ে সমস্ত বড় আকৃতির প্রাণীর বিলুপ্তির সুযোগে একদল প্রাণী চলে আসে সামনের সারিতে। ডাইনোসররা বেঁচে থাকতে এরা ছিলো আড়ালে। তাদের আধিপত্যের সম্মুখে এরা ছিলো অসহায়। ডাইনোসরবিহীন নতুন পৃথিবী এদের জন্য নিয়ে আসে অফুরন্ত সম্ভাবনা। নানা সক্ষমতা জন্ম নেয় তাদের মধ্যে, জন্ম হতে থাকে নানা ধরনের প্রজাতিও। এদের মধ্যে কেউ ছিলো মাংসাশী, কেউ ছিলো তৃণভোজী। কেউ ছিলো শিকারি, কেউ বা শিকার। কেউ পানিতে নেমে যায়, হয়ে ওঠে সাঁতারু প্রাণী, কেউ আকৃতিতে বড় হতে থাকে, আর কেউ বা হয়ে ওঠে ভয়ংকর হিংস্র।
এর মধ্যে জন্ম নেয় এক প্রজাতি। ডানা বিকশিত হয় তাদের। পরিচিত হয় পাখি নামে। এই পাখিদের মধ্যে একটা হচ্ছে তোতাপাখি। ক্রমে ক্রমে এরা হয়ে ওঠে দারুণ বুদ্ধিমান। তাদের জীবনকাল বৃদ্ধি পায়, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া হয়ে ওঠে জটিল। শুরুতে সংখ্যায় কম ছিলো তারা। সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের কারণে টিকে থাকার সম্পদ খুঁজতে গিয়ে এরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যে মহাদেশে জন্মেছিলো এরা, সেই মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশগুলোতে যাবার রাস্তা খুঁজে পায় তারা। অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তারা সব মহাদেশে। সারা বিশ্বে বসতি গড়ে তোলে বুদ্ধিমান তোতাপাখিরা।
পাঁচ কোটি বছর আগে তোতাপাখিরা যে কাজটা করেছিলো, সেই একই কাজটা করে আরেকটা প্রজাতি। নতুন এই প্রজাতির নাম হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষ জাতি। তারাও হুট করেই বুদ্ধিমান হিয়ে ওঠে। নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলে জটিল এক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া। আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া এই প্রজাতিটি একটা সময়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় অজানা পৃথিবীটাকে অন্বেষণ করার। আফ্রিকার তটভূমি ধরে হেঁটে হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় ইউরোপ আর এশিয়ার সংযোগ বিন্দুতে। সেখান থেকে দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় তারা। এক ভাগ রওনা দেয় ইউরোপের দিকে। আরেক ভাগ যাত্রা শুরু করে এশিয়ার দিকে। ইউরোপে তখন রাজত্ব করছিলো হোমো স্যাপিয়েন্সদের নিকটতম কাজিন নিয়ান্ডারথালরা। মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার বছরের মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলে তারা। দখন নেয় ইউরোপের। এশিয়া-গামী অংশটাও এর মধ্যেই এশিয়া দখল করে সেখান থেকে পা ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া এবং দুই আমেরিকাতে। সব ক’টি মহাদেশই তাদের করায়ত্তে।
মানুষের প্রিয় পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টিয়া পাখি। প্রিয় হবার কারণটা সহজবোধ্য। পাখিটা দেখতে দারুণ সুশ্রী, বর্ণে সুশোভিত আর সদা আমোদী। এর চেহারা আর আচার-আচরণের সাথে মানুষের একটা অস্পষ্ট মিল আছে। স্পষ্ট একটা মিলও আছে। এরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে। যদিও সেই কথা বলাটা মানুষের মতো বুঝে শুনে করা অর্থবোধক কিছু নয়। তারা যেটা করে সেটা হচ্ছে অন্ধ অনুকরণ করা। মানুষের কথাকে স্পষ্ট উচ্চারণে অনুকরণ করে তারা শুধু।
এর বাইরে তাদের সাথে আমাদের একটা অদ্ভুত জায়গায় মিল রয়েছে। এদের সাথে আমাদের বিবর্তনীয় সম্পর্কটা বেশ দূরের। মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসাবে যেটুকু সম্পর্ক, ঠিক সেই দূর সম্পর্কীয় সম্পর্কটা রয়েছে তাদের সাথে আমাদের। এর চেয়ে বেশি কিছু থাকার কথাও না। অথচ, বাস্তবে আমাদের নিকটবর্তী প্রজাতিগুলোর চেয়েও এদের সাথে আমাদের মিল রয়েছে বেশি পরিমাণে। তাদের বিবর্তনীয় ইতিহাস আর আমাদের বিবর্তনীয় ইতিহাস প্রায় একই রকম।
মানুষ মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণী। আরও স্পষ্ট করে বললে আমরা হচ্ছি প্রাইমেট। এটা স্তন্যপায়ীদের একটা উন্নত বুদ্ধিমত্তার বর্গ। এদের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। নানা ধরনের বানর প্রজাতি, বেবুন এবং গ্রেট এপরা প্রাইমেটদের অন্তর্ভুক্ত। শিম্পাঞ্জি, বনোবোস, গরিলা, ওরাং-উটান আর আমরা হচ্ছি গ্রেট এপ। সব প্রাইমেটদের বৃদ্ধাঙ্গুলি রয়েছে। আমাদের চুল এবং শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি স্তন্যপায়ীদের মতোই মোটামুটি একই রকমের।
আমরা কোনোভাবেই পাখিদের কাছাকাছি প্রজাতি নই। দেখতেও আমরা তাদের মতো নই। আমাদের শরীর, আমাদের চোখ, আমাদের ত্বক, আমাদের চুল, আমাদের রক্ত, আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং আমাদের উৎপত্তির ইতিহাস পাখিদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন।
এই ইতিহাস ভিন্ন হলেও মানুষের সঙ্গে পাখিদের প্রচুর সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে। পাখিরা তাদের যে জীবনযাপন প্রণালী ‘উদ্ভাবন’ করেছিলো, সেটা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চেয়ে ভিন্ন ছিলো। আমরা নিজেরাও স্তন্যপায়ী প্রাণী। সেই হিসাবে পাখিদের সঙ্গে আমাদের জীবনযাপন প্রণালীও ভিন্ন হবার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে সেটা হয়নি। আমরা তাদের মিরর ইমেজ হয়েছি। পাখিরা যখন আকাশে ওড়া শিখেছিলো, প্রকৃতিতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের একটা সুবিধা দিয়েছিলো। উড়তে জানলে বা উড়তে পারলে বেশিরভাগ শিকারির হাত থেকেই বেঁচে যাওয়া সম্ভব। যেহেতু এরা এখন শিকারির পেটে সহজে যাচ্ছে না, স্বাভাবিকভাবে তারা বেশিদিন বাঁচবে এবং বেশি সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেবে। দীর্ঘ জীবনটা সুযোগ হয়ে আসে। একই সাথে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় অধিকতর বুদ্ধিমত্তার। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী প্রাণীদের জন্য বুদ্ধিমত্তা সুবিধা প্রদান করে। এটা তাদের দীর্ঘকাল টিকে থাকতে সহায়তা করে। আর দীর্ঘকাল টিকে থাকার অর্থ হচ্ছে বাচ্চা-কাচ্চাদের যতœ করে পূর্ণ বয়স্ক করে গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া।
বুদ্ধিমান বাচ্চা জন্ম দিতে গেলে পাখিদের ডিমের আকার এবং এর ভিতরের কুসুম বিশাল হবার প্রয়োজন ছিলো। সমস্যা হচ্ছে ডিম অতো বড় হলে মা পাখির পক্ষে ওড়া সম্ভব নয়। ফলে, বেশিরভাগ পাখির ডিমই হয় তুলনামূলকভাবে ছোট। ছোট ডিম হবার কারণে বাচ্চা জন্ম নেয় অপরিণত অবস্থায়। অপরিণত বাচ্চারা থাকে পুরোপুরি অসহায়। খাওয়া থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, সবকিছুর জন্যই তাদের নির্ভর করতে হয় মায়ের উপর। মায়ের একার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না বলেই পাখিদের মধ্যে জোড়া সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অনেক সময় জোড়া সম্পর্কেও এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না, স¤প্রদায়গত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
আমাদের বিবর্তনীয় ইতিহাসও একই রকমের। তবে, পাখিদের মতো উড়ার সুবিধা অবশ্য আমরা পাইনি। তার বদলে পেয়েছি স¤প্রদায়গত আচরণের সুবিধা। মানুষ শুরু থেকেই থেকেছে দল বেঁধে। দল বেঁধে থাকার কারণে এড়ানো গিয়েছে শিকারি প্রাণীদের। ফলে, বেশিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা আবার বুদ্ধিমত্তার বিকাশে সহযোগিতা করেছে। মস্তিষ্ক বৃদ্ধির কারণে মানুষের মাথার আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশাল মাথার সন্তান জন্ম দেবার জন্য মায়ের যোনিপথ পর্যাপ্ত প্রশস্ত ছিলো না। পরিণত বাচ্চার জন্ম মানে মায়ের মৃত্যু সুনিশ্চিত। যে কারণে মানুষের বাচ্চা জন্ম নিতে থাকে অপরিণত অবস্থায়। অপরিণত বাচ্চার যতœ নেবার জন্য প্রয়োজন পড়ে দাম্পত্য সম্পর্কের এবং স¤প্রদায়গত সহযোগিতার।
পাখিরা তাদের সমস্যা সমাধান করার জন্য যে ধরনের স্ট্রাটেজি নিয়েছিল, একই ধরনের সমস্যার সমাধানে মানুষও সেই একই পথ ধরেছে। আমরাও পাখির আচরণই করেছি।
এটাকে বলে কনভারজেন্ট ইভল্যুশন বা এক-কেন্দ্রাভিমুখী বিবর্তন। এ ক্ষেত্রে টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণ পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে না এসে ভিন্ন কোনো একটা প্রজাতির কাছ থেকে আসছে যাদের দৈহিক গঠনতন্ত্র এবং বিবর্তনীয় পটভূমিকা একেবারে আলাদা। মানুষের উৎপত্তির ষাট লক্ষ বছর আগে তোতাপাখি এসেছে এই ধরণীতে। সম্পূর্ণই এক ভিন্ন প্রজাতি সেটা। অথচ, ওটার মতো করে একই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে মানুষও একই সমাধানের রাস্তায় গিয়েছে, একইভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তন তার খুব কাছের প্রজাতিগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন।
বিবর্তনের আয়নায় আমরা তাই টিয়া পাখির প্রতিবিম্ব। অদ্ভুত এক ধরনের পাখি আমরা। যাকে বলে ‘পালক বিহীন’ পাখি। গায়ে যে শুধু পালক নেই আমাদের, তা নয়। উড়বার জন্য ডানাও নেই আমাদের। অথচ নিদারুণ মিল রয়েছে পাখির সাথে।