জিন্নাতুন নূর : করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত দেশের পর্যটন খাত। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে এ খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। আর টানা কয়েক মাসে এ খাতের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়। গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। খাতটি কবে নাগাদ চাঙ্গা বা স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত।
পর্যটন খাত নিয়ে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, ‘আমরা টোয়াবে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মচারীকে ছাঁটাই করিনি। তবে কোনো কাজও আমরা করতে পারছি না। কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।’
পর্যটন খাতের সঙ্গে ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল-মোটেল ছাড়াও পর্যটন স্থানকেন্দ্রিক নানা ব্যবসা জড়িত। আর এ মানুষদের সামনে এখন ঘোর অমানিশা। স্থানীয় ১ কোটি পর্যটক ছাড়াও বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বর্তমানে দেশের পর্যটন স্পটগুলোয় নেই পর্যটকের আনাগোনা। মার্চে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে পর্যটন কেন্দ্রগুলো একরকম বন্ধ রয়েছে।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে সার্বিক পর্যটন শিল্পে ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ জন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ হিসাব করোনা সংক্রমণের আগে থেকে হওয়ায় টোয়াবের পরিমাণের থেকে কিছুটা বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পর্যটননগর সিলেটে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১০ হাজার মানুষ করোনার জন্য বর্তমানে বেকার জীবন যাপন করছেন। সেখানে অবস্থিত ১০০-এরও বেশি হোটেল, মোটেল এখন পর্যটনশূন্য। সিলেট ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণে পর্যটক না থাকায় গত কয়েক মাসে আমাদের প্রায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলকে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত প্রান্তিক মানুষগুলোকে তৎক্ষণাৎ সহযোগিতা প্রদানের কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা তাদের দেওয়া হয়নি।’ ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি ইলিশ পার্কের উদ্যোক্তা রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, মার্চের পর থেকে সেখানকার ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন তাদের লোকসান হচ্ছে অর্ধ কোটি টাকা আর তিন মাসে অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কুয়াকাটার হোটেল-মোটেলগুলোয় অন্তত ২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক আরও খরচ আছে কয়েক লাখ টাকা।
ভালো নেই দেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট কক্সবাজারের হোটেল মালিক ও কর্মচারীরাও। করোনা সংক্রমণের পর কক্সবাজারে পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান কক্সবাজার হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম সিকদার। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, পর্যটনের সঙ্গে জড়িত এ মানুষগুলোর পক্ষে অন্য কোনো পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়। পর্যটক না আসায় অনেক হোটেলের অব্যবহৃত দামি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নষ্ট হতে শুরু করেছে। আবার একটি টু স্টার মানের হোটেলে গড়ে প্রতিদিন কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৩ লাখ আর পাঁচ তারকা মানের হোটেলের খরচ ১০ লাখ টাকা। কিন্তু পর্যটক না থাকলে এ খরচ হোটেলগুলোর পক্ষে দীর্ঘদিন বহন করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও সংসদ সদস্যের উদ্যোগে শিগগির যদি হোটেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে এ বিপদে তাদের বাঁচানো যাবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, ‘আমরা হোটেল-মোটেলের সব মালিকের কাছে সংকটের এই সময়ে কর্মী ছাঁটাই না করার জন্য অনুরোধ করেছি। সরকার সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। এই বিপদের সময় পর্যটন খাত কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তার জন্য চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আমরা করণীয় বিষয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছি।’
এর বাইরে পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারী ট্যুর অপারেটরসহ আরও ২০০ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন, তাদের প্রতিদিন লোকসান হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। লকডাউনের সময় বাড়লে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। আর পর্যটন খাতের এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় প্রয়োজন দাবি করে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি প্রত্যাশা করছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা।