ফরিদ আহমেদ : ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক দিন।
ক্রিসমাসের ছুটি চলছে তখন। শীতের গভীর রাত। পুরো কোলকাতা শহর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। তালতলা লেনের একটা বাড়ির ছোট্ট এক কামরায় জেগে রয়েছে ঝাঁকড়া চুলের এক একুশ বছরের তরুণ। পেন্সিল হাতে নিয়ে সাদা কাগজে দ্রæত গতিতে কবিতা লিখে চলেছেন তিনি। কলম দিয়ে লিখতে পারতেন। কিন্তু, কলম বার বার কালির দোয়াতে চোবাতে গেলে ঝড়ো গতিতে আসা শব্দগুলো গতি হারাতে পারে ভেবে পেন্সিল তুলে নিয়েছেন তিনি হাতে।

রাত শেষ হবার আগেই কবিতাটা শেষ করে ফেলেন তিনি। জানতেন অসাধারণ কিছু লিখেছেন তিনি, কিন্তু জানতেন না যে শীতের এই রাতে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিটাকে তিনি কাগজের পটভূমিকায় এঁকে দিয়েছেন। তাঁর জীবনেরই শ্রেষ্ঠতম কবিতা না, যে কবিতাটা তিনি সেই রাতে রচনা করেছিলেন, সেটি এখনও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম দ্রোহের কবিতা। পাঠক এতক্ষণে ধরে ফেলার কথা। হ্যাঁ, আমি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কথা বলছি।

কাজী নজরুল ইসলামের সাথে একই বাড়িতে তখন থাকতেন কমরেড মুজফফর আহমদ। তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠলে কবিতাটা পড়ে শোনানো হয় তাঁকে। এই কবিতা শুনে বিস্ময়ে ঝিম মেরে যান তিনি। মন্তব্য করারও ভাষা হারিয়ে ফেলেন। বেলা কিছুটা বাড়তেই ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সাহেব এলেন। সৃষ্টিগর্বে উচ্ছ¡সিত তরুণ কবি তাঁকেও কবিতাটা পাঠ করে শোনালেন তাঁর দরাজ কণ্ঠে। কবিতা শুনে মুজফফর আহমদের মতো ঝিম মেরে গেলেন না তিনি, বরং হইচই শুরু করে দিলেন। কবিকে দিয়ে কবিতাটা তক্ষুনি কপি করিয়ে সেটাকে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপানোর জন্য।

একই দিনে অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য এসে হাজির। তিনিও কবিতাটা শুনলেন। জানলেন এটা কপি করে নিয়ে গিয়েছেন আফজালুল হক সাহেব মোসলেম ভারতে ছাপানোর জন্য। তিনি অস্থির চিত্তে বললেন, ‘তুমি পাগল হয়েছো নজরুল। আফজালের পত্রিকা কবে বের হবে তার কোনো ঠিক নেই। কপি করে দাও, ‘বিজলী’-তে ছেপে দেই আগে।

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যও কবিকে দিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কপি করিয়ে নিলেন। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাপার হরফে বের হয়ে এলো ‘বিজলী’ পত্রিকার মাধ্যমে। বিজলী সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিলো। এই কবিতার কারণে ওই সংখ্যার পত্রিকা এতো বেশি বিক্রি হয়েছিলো যে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো তা সপ্তাহ শেষ হবার অনেক আগেই। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে দ্বিতীয়বার ছাপতে হয়েছিলো এই সংখ্যাকে একই সপ্তাহের মধ্যে। ‘বিদ্রোহী’ অবশ্য শুধু ‘বিজলী’-তেই আবদ্ধ থাকলো না। আরো অনেক পত্রিকা এখান থেকে কপি করে তা ছাপিয়ে দিতে থাকলো। সহজ কথা হচ্ছে, বিদ্রোহের দাবানলের মতো বিদ্রোহী কবিতা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।

ঠিক এই সময়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিরুদ্ধে অদ্ভুত এক অভিযোগ নিয়ে এলেন মোহিতলাল মজুমদার। তিনি মুখে মুখে দাবি করা শুরু করলেন যে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটা ‘মানসী’-তে প্রকাশিত তাঁর গদ্য ‘আমি’-র ভাব চুরি করে লেখা হয়েছে। তাঁর এই দাবির সাথে আরো বেশ লোককে জড়ো করে ফেললেন তিনি।

এই ঘটনার আগ পর্যন্ত মোহিতলাল মজুমদারের সাথে নজরুলের সম্পর্ক ছিলো মোটামুটি গুরু-শিষ্যের মতো। ১৯২০ সালের দিকে দুজনের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। কিন্তু, সেই সম্পর্ক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো না। নজরুলের চেয়ে এগারো-বারো বছরের বড় হবার কারণে বন্ধুত্বের চেয়ে গুরু-শিষ্যে পর্যবসিত হয়। মোহিতলাল নিজেকে নজরুলের অভিভাবক ভেবে নিয়ে কর্তৃত্ব করা শুরু করেন। এই কর্তৃত্বের কারণেই এক পর্যায়ে তাঁদের সম্পর্ক উষ্ণ থেকে শীতল হয়ে পড়ে। সম্পর্ক যখন উষ্ণ ছিলো, মোহিতলাল মজুমদার সেই সময়ে নজরুলকে তাঁর ‘আমি’ প্রবন্ধটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেই প্রবন্ধের ভাব নকল করে বিদ্রোহী লেখা হয়েছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়নি, এটাই ছিলো তাঁর মূল অভিযোগ।
মোহিতলাল মজুমদারের দাবী কতোখানি সঠিক ছিলো, সেটা বুঝতে গেলে তাঁর ‘আমি’ প্রবন্ধটা পড়া উচিত। এই লেখায় অতো বিশাল প্রবন্ধ তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি কয়েকটা অনুচ্ছেদ থেকে টুকরো টুকরো কিছু লাইন তুলে দিচ্ছি এখানে কিছুটা ধারণা দেবার জন্য।
মোহিতলাল মজুমদার লিখেছেন,
“আমি বিরাট। আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভো-নীলিমার ন্যায় সর্ব্বব্যাপী। চন্দ্রই আমার মৌলিশোভা, ছায়াপথ আমার ললাটিকা, অরুণিমা আমার দিগন্তসীমান্তের সিন্দুরচ্ছটা, সূর্য্য আমার তৃতীয় নয়ন এবং সন্ধ্যারাগ আমার ললাটচন্দন।
আমি ভীষণ- অমানিশার সমুদ্র, শ্মশানের চিতাগ্নি, সৃষ্টি নেপথ্যের ছিন্নমস্তা, কালবৈশাখীর বজ্রাগ্নি, হত্যাকারীর স্বপ্নবিভীষিকা, ব্রাহ্মণের অভিশাপ, দম্ভান্ধ পিতৃরোষ।

আমি রহস্যময়, আমি দুর্জ্ঞেয়। অন্ধকার চারিদিক আচ্ছন্ন করিয়াছে, উর্দ্ধে আকাশ ও নিম্নে জলস্থল আমার সত্ত¡ায় স্তম্ভিত হইয়া আছে। দিগন্তে মৃত্যুর চক্রনেমী সুষুপ্তির রাজ্য।
আমি উন্মাদ। পর্ণকুটীরে হোমাগ্নি জ্বালিয়াছি, সাগর বালুকায় গৃহরচনা করিয়াছি, আমি নিদাঘ ঝটিকায় তুলসীমূলে সন্ধ্যাদীপ জ্বালিয়াছি – আমি ভালবাসিয়াছি। হায় উন্মাদ!”
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এবং মোহিতলালের ‘আমি’-কে পাশাপাশি রেখে পড়লে দুটোর সাদৃশ্যতা এড়ানো খানিকটা অসম্ভবই। তবে, এটাও স্বীকার্য যে দুটো সম্পূর্ণ দুই ধরনের রচনা। মোহিতলাল যেখানে ভোঁতা গদ্য লিখেছেন, সেখানে নজরুলের কবিতা তীক্ষ্ণ ফলার এক ধারালো ছুরি যেনো। মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ গদ্য নিস্তরঙ্গ এক জলাশয়ের মতো স্থির এবং নিষ্কম্প।। এর বিপরীতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাহাড়ি ঝর্নার মতো খরস্রোতা এবং গতিশীল। শব্দ ও ছন্দের এক প্রলয়নাচন সেখানে রয়েছে, যেটা মোহিতলাল মজুমদারের লেখায় নেই।

রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন, “মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ (জীবন জিজ্ঞাসার অন্তর্গত) প্রবন্ধের ভাববস্তুর সঙ্গে নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কবিতার রচনার বেশ কয়েক বছর আগে মোহিতলালের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। মোহিতলাল মনে করেন তাঁর রচনাকেই নজরুল আত্মসাৎ করেছেন, অথচ কোথাও তার উল্লেখ মাত্র নেই। বলা বাহুল্য, ‘আমি’ প্রবন্ধের বীজ ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে গ্রন্থটি থেকে গৃহীত, আধ্যাত্মিক রূপকার্যের মূল্যেই সেটি উল্লেখ্য, সাহিত্যগুণে নয়। পরন্তু নজরুলের কবিতাটি যে একান্ত আত্মগত প্রেরণার ফল, তা কাব্যরসিক মাত্রেই স্বীকার করবেন। নতুবা রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্যাহ্ন দীপ্তিতে বিরাজমান, তখনই নজরুলের আকস্মিক আবির্ভাব দলগোষ্ঠী নির্বিশেষে এমন সম্বর্ধিত হত না।”

রবীন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধটার ভাবও মৌলিক ভাব না। এটা নেওয়া হয়েছে ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থ থেকে। সেটা আবার তিনি ‘আমি’ প্রবন্ধে স্বীকার করেন নাই। ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বইটার প্রভাবে মোহিতলাল মজুমদার ‘আমি’ লিখেছিলেন সেটার নাম ‘অভয়ের কথা’।

কমরেড মুজফফর আহমদের মতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে সুর সেটা মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’-র মধ্যে অনুপস্থিত। কাজেই, ‘বিদ্রোহী’-র জন্য মোহিতলাল মজুমদারের কাছে ঋণ স্বীকারের কোনো প্রশ্নই আসে না। এটা নজরুলের আপন প্রেরণায় রচিত কবিতা।
নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও নজরুলের প্রতি মোহিতলালের বিরূপতা বন্ধ হয় না। এই সময় হঠাৎ করেই তিনি পাশে পেয়ে যান সজনীকান্ত দাসকে। সজনীকান্ত দাসের অভ্যাস ছিলো সব কবি সাহিত্যিকদেরই আক্রমণ করা। তাদের কবিতার প্যারোডি তৈরি করতেন তিনি। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি করে তিনি ‘আমি ব্যাঙ’ নামে একটা কবিতা লিখলেন। সেই কবিতার কয়েক লাইন এ’রকমঃ

“আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং।
ভৈরব রসে বরষা আসিলে,
ডাকি যে ঘ্যাঙর ঘাং।
আমি ব্যাঙ।”

এই কবিতা প্রকাশিত হবার আগেই মোহিতলাল মজুমদারের হাতে গিয়ে পড়লো। তিনি মহা উৎসাহে নানা জায়গায় এই কবিতা পড়ে মনের ঝাল মেটাতে লাগলেন। এর কিছুদিন পরে সজনীকান্ত দাস যোগ দেন ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায়। সেখানে এই কবিতা ছাপা হয়। কবিতা ছাপা হলো সজনীকান্ত দাসের নামে। কিন্তু, সমস্যা দাঁড়ালো অন্য জায়গায়। মোহিতলাল মজুমদার এই কবিতাটা এতো বেশি জায়গায় পড়েছেন যে এটা ছাপা হবার আগে থেকেই অনেকের কাছে পরিচিত ছিলো। নজরুলের বন্ধুরা মনে করতেন যে এটা মোহিতলাল মজুমদারেরই লেখা। ফলে, তারা নজরুলকে চাপ দিতে লাগলো এর একটা উত্তর দেবার জন্য। একদিন কল্লোল অফিসে তাঁকে আটকে ফেলে এর জবার আদায় করে নিলো তারা নজরুলের কাছ থেকে। তাদের চাপে পড়ে নজরুল লিখলেন ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ নামের কবিতা।

সর্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতার শেষ কয়েক লাইন ছিলো এমনঃ
“যত বিদ্রূপই কর গুরু তুমি জান এ সত্য-বাণী,
কারুর পা চেটে মরিব না, কোন প্রভু পেটে লাথি হানি
ফাটাবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মত,
ধরা-মা’র বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত!
আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস
ততদিন গুরু সকলের সাথে করে নাও পরিহাস।”

নজরুল তাঁর কবিতাতে মোহিতলাল মজুমদারকে দ্রোণাচার্য্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। ফলে, মোহিতলাল মজুমদার এর জবাবে পালটা কবিতা লেখেন ‘দ্রোণ-গুরু’ নামে। এটাকে অবশ্য কবিতা না বলে গালি আর অভিসম্পাত বলাটাই শ্রেয়। এখনকার যুগ হলে হয়তো প্রচলিত গালিই দিতেন তিনি। আগেকার যুগে বলে সংস্কৃত শব্দের আড়ালে গিয়ে গালি দিয়েছেন, এই যা। মোহিতলাল মজুমদারের ‘দ্রোণ-গুরু’ থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি এখানে।

“উন্মাদ- তুই উন্মাদ! তাই পতনের কালে আজ
বিষ-বিদ্বেষ উথলি’ উঠেছে, নাই তোর ভয় লাজ!
আমারে করেছে কুরু-সেনাপতি কৌরব নৃপমণি,
তাই হিংসায় পুরীষ-ভাণ্ডে মাছি ওঠে ভন ভনি’!
তাই তাড়াতাড়ি পার্থের নামে কুৎসার ছল ধরে’
তারি নামে লিপি পাঠালি আমারে কুৎসিত গালি ভরে’
আমি ব্রাহ্মণ, দিব্যচক্ষে দুর্গতি হেরি তোরে-
অধঃপাতের দেরী নাই আর, ওরে হীন জাতি-চোর।”