হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
খবরটা শুনে ও দেখে একটু অবাকই হলাম। অনেকটা দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে আমার সীমিত জ্ঞান আর খানিকটা আমার ব্যক্তিগত প্রেজুডিসের কারণে। আশির দশক থেকেই কোরিয়া থেকে কর্মী হিসেবে ফিরে আসা মহল্লার অনেকেই কুকুরের গোশত খেয়েছে বলে শুনতাম।
তবে এখনকার আর আশির দশকের কোরিয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। শিল্প-সংগীত-সংস্কৃতি ও সাহিত্যে তারা ইর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। আমি দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলছি। আইএ পড়ার সময় ভূগোলে পড়েছিলাম দ. কোরিয়াকে বলা হয় ‘শান্ত সকালের দেশ।’ ‘Land of Morning Calm.’
শান্ত সকালের দেশ তো পৃথিবীতে একটাই। এটা কোরিয়ার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এর সাথে কোরীয়রা যোগ করেছে মজবুত সাংস্কৃতিক খুঁটি।
৫৩ বছর বয়সী কোরীয় মেয়ে হান কাং এবছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যদিও আমি হান বা অন্য কোনো কোরীয় লেখকের লেখা পড়িনি। তবে হানের নোবেল প্রাপ্তিতে আমার আগ্রহ জেগে উঠল তাঁর কোনো বই পড়ার।
বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি সবেগে ধাবিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কারণে পোশাক-পরিচ্ছেদ, রন্ধন, বাসস্থান ইত্যাদিতে জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন হয়েছে, আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার আধুনিক সংস্কৃতি। কোরিয়ার সংস্কৃতি এশিয়া ও বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে বলে একে বলা হয় কোরীয় ঢেউ। সেই উত্তাল ঢেউ জাগিয়ে তুলল নতুন এক কোরিয়াকে।
আমার জানা মতে, বিশেষত সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কমবয়সীদের মধ্যে অন্যতম হান। সাহিত্যে নারী বিজয়ীদের সংখ্যাও বেশ কম। সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জেতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং। ১৯০৭ সালে যখন তিনি তাঁর ‘দি জাঙ্গল বুক’ বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার জেতেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর।
সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এ পুরস্কারের জন্য হান কাং-কে মনোনীত করার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছে, হান কাংয়ের গদ্য তীক্ষè ও কাব্যময়। তাতে ইতিহাসের যন্ত্রণাবিদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টা আছে। তাঁর গদ্যে আছে মানবজীবনের ভঙ্গুরতার বিষয়টিও।
৫৩ বছর বয়সী হান কাংয়ের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সাময়িকীতে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে তাঁর একটি ছোটোগল্প সংকলন বের হয়। আর সেটির মধ্য দিয়েই তাঁর গদ্য পাঠকের সামনে আসে।
পরে হান কাং দীর্ঘাকার গদ্য লিখতে শুরু করেন। ‘দি ভেজেটারিয়ান’ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইয়ের একটি। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালে ম্যানবুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এই উপন্যাসে হান কাং মানুষের নিষ্ঠুরতায় আতংকিত এক তরুণীর ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন।
নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে পুরস্কার দিয়ে আসছে। হান কাংকে নিয়ে ১৮তম বারের মতো একজন নারী পুরস্কারটি পেলেন।
প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান হিসেবেও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং। নোবেল পুরস্কার বোর্ড তাঁর পরিচিতি দিতে গিয়ে বলেছে, তিনি এমন একজন যিনি সংগীত ও শিল্পকলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
নোবেল কমিটি আরও বলেছে, মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে এগিয়েছে হান কাংয়ের অনুসন্ধিৎসু মন। তাই তাঁর কাজকে কোনো সীমানায় আটকে ফেলা যায় না। সহিংসতা, দুঃখকষ্ট ও পিতৃতন্ত্রের মতো নানা বিষয় উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত হলেও হান কাংয়ের উপন্যাস ‘দি ভেজেটারিয়ান’ ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ। পরের বছরই উপন্যাসটি ম্যানবুকার পুরস্কার পেলে লেখক হিসেবে হান কাংয়ের জীবন পাল্টে যায়। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ’দি হোয়াইট বুক’, ’হিউম্যান অ্যাক্টস’ ও ’গ্রিক লেসনস’।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস মাম বলেন, শরীরের সঙ্গে আত্মার, জীবিতের সঙ্গে মৃতের যোগাযোগ নিয়ে হান কাংয়ের সচেতনতা অসাধারণ। তাঁর গদ্য কাব্যিক ও নিরীক্ষাময়। সমসাময়িক গদ্যসাহিত্যে তিনি একজন উদ্ভাবকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন-এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি অনায়াসে।