হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
বাংলাদেশের বিখ্যাত অনেকের বিচ্যুতি লক্ষ করে আমি বিস্মিত হয়েছি। আহত হয়েছি, বিভ্রান্ত হয়েছি। সেসব প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। তবে মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার ব্যবহারের পার্থক্যের একটি নজির তুলে ধরছি।
টমাস অ্যান্সেলের কথা অনেকের জানা আছে। জাতকবি এবং জাতে ব্রিটিশ। কী এক অভিমান করে নিজ দেশ ছেড়ে এই হতভাগ্য বাংলাদেশে এসে হাজির হন তিনি একদা। তিনি অবজারভারে চাকরি করতেন এবং ‘ইয়ং অবজারভার’ পাতার দায়িত্বে ছিলেন। আমি একজনের লেখা টমাস অ্যান্সেলের কাছে পৌঁছে দিতাম। শামীম করিম রঞ্জন- শিশুসাহিত্যিক সাজেদুল করিমের পুত্র। তিনি গোপিবাগে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। শা. ক. রঞ্জন মহল্লায় আমার সিনিয়র ভাই। তার অনুরোধে তার লেখা অবজারভারে নিয়ে যেতাম। বিষয়টা আব্বা জানতেন না। জানাতাম না।
কী জানি, অন্যের লেখা নিয়ে যাই-এটা যদি আব্বা পছন্দ না করেন। শামীমের লেখা অবজারভারে নিয়ে যাবার পথে আমার মধ্যে ইংরেজিতে লেখার ইচ্ছে চাড়া দিয়ে উঠল। ইয়ং অবজারভারে অন্যের লেখা দেখে শখ জাগত, আমার লেখা যদি ছাপা হতো! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার সুবাদে টুকটাক ইংরেজি বলে যাই আর ইংরেজিতে লেখার জন্য মনটাকে চাঙ্গা করতে থাকি।
যেদিন আমি ইংরেজিতে লেখাটা লিখলাম, সেদিন কিন্তু আমার লেখাটা দেখে দেবার জন্য আব্বা আর বেঁচে নেই! আব্বা অবজারভারে কর্মরত অবস্থাতেই মারা যান। (এর আগে তিনি সংবাদ, দৈনিক বাংলা-তৎকালিন দৈনিক পাকিস্তানে ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি পুনরায় অবজারভার পত্রিকায় যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন)।
আমি কোনো লেখা লিখলে আব্বা তা সংশোধন করে ঠিকঠাক করে দিতেন। সেসব লেখা বাংলাতেই ছিল। কিন্তু এবারের বিষয়টি তো ভিন্ন রকমের। আব্বা বেঁচে নেই। আমি নিঃস্ব অবস্থায় অবজারভার ভবনে ঢুকলাম। দুরুদুরু বুকে অ্যান্সেল সাহেবের কামরায় এলাম। টগবগে লাল তার গায়ের রং, জাতে ইংরেজ হলেও দেখতে পাতলা ও ছোটখাটো। আমার ইংরেজির বহর সবটুকু ঢেলে হাতের লেখাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি উৎসাহের সাথে লেখাটা নিলেন, একনজর দেখলেন, আমার দিকে তাকালেন। তার চেহারায় একটা আগ্রহ ফুটে উঠতে দেখলাম। ক্রিস্টোফার মারলো তার দেশেরই নাট্যকার বলে তিনি হয়তো প্রীত হয়েছিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
লেখাটা রেখে চলে এসেছিলাম। লেখাটা ছিল ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলো’র গুণকীর্তন করে। তার ড. ফস্টাস পড়ে আমি মুগ্ধ, সে বিষয়ে। তারপর তো অপেক্ষা, দুই তিনটি উইকএন্ডের ইয়ং অবজারভারে চোখ বুলালাম। কিন্তু মারলো’র টিকিটিরও নাগাল পেলাম না।
এরমধ্যে আমার এক বান্ধবী পারভীন (এর আগের একটি এপিসোড পারভীনকে নিয়ে লিখেছি)। একদিন সাতসকালে আমার বাসায় হাজির হলো। সে একটা লেখা নিয়ে এসেছে আমাকে দেখাতে। আমি বাথরুমে ছুটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পারভীনের মুখোমুখি বসতেই পারভীন ইয়ং অবজারভারে একটা লেখা দেখাল- ‘দি জিনিয়াস অব মারলো’। (জগৎখ্যাত ‘ড. ফস্টাস’ নাটকের রচয়িতা ক্রিস্টোফার মারলো সম্পর্কে প্রবন্ধ)। সেদিন রোববার ছিল, সেটা আমার খেয়াল ছিল না আর ততদিনে আগ্রহও কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। লেখাটা দেখার পর কী যে আনন্দ হলো! পরপর ক’দিন বিছানায় শুয়ে নিজের লেখাই পড়লাম।
সেদিন পারভীন আর আমি একটা রেস্তরাঁয় বসে খাবার খেলাম। এরপর কয়েকটি লেখা আমার ছাপা হলো ইয়ং অবজারভারে।
এবার আসব আসল প্রসঙ্গে। আমি একদিন লেখা নিয়ে গিয়ে হোঁচট খেলাম। অ্যান্সেল সাহেবের রুম তালাবদ্ধ! তিনি অফিসে আসছেন না। খুব সম্ভব অসুস্থ। ইয়ং অবজারভার কে দেখেন একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দেখিয়ে দিলেন। বলাই বাহুল্য, অবজারভারের সম্পাদকীয় এবং নিউজ সেকশনের প্রায় সবাইকেই আমি চিনতাম। আমাকেও তারা চিনতেন ‘হাইভাই’-এর ছেলে হিসেবে। আজ তাদের অনেকের কথা মনে পড়ছে।
যাইহোক, যিনি তখন ইয়ং অবজারভার দেখছিলেন, তিনি একজন নামকরা সাংবাদিকের ছেলে। তার কাছে লেখা দিয়ে, আমার পরিচয় দিয়ে এবং আমার লেখা সেই পাতায় ছাপা হয়েছে জানিয়ে লেখাটা সাবমিট করলাম। এরপর দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেও দেখলাম আমার লেখা ছাপা হলো না! কেন! আমি এরপরে ক’দিন ফলোআপ করেছি, জিজ্ঞেস করেছি লেখা ছাপা হবে কিনা, তিনি বলেছেন হবে। কিন্তু হয়নি। আমার লেখা মানসম্মত না হলে বা সংশোধনের প্রয়োজন হলে তিনি বলতে পারতেন। তা তিনি বলেননি। একজন বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে তার এখতিয়ার ছিল আমার লেখা এডিট করে তা ছাপাতে, তিনি তা-ও করেননি।
টমাস অ্যান্সেল সেই কাজটি করতেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো সেই ‘নামকরা সাংবাদিক’-এর ‘নামকরা ছেলে’ কি টমাস অ্যান্সেলের চাইতে বিজ্ঞ ছিলেন? একজন উচ্চশিক্ষিত খাস বিলেতির চেয়েও তিনি বেশি ইংরেজি জানতেন? জ্ঞান-গরিমায় পোক্ত ছিলেন? এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, সেই ভদ্রলোকের কোনো লেখা বা কোনো কীর্তির কথা কখনও শুনিনি। কিন্তু আমার কিছু কীর্তি অবশ্যই ছিল।
একে একে প্রায় সব ক’টি দৈনিক পত্রিকায় আমার গল্প/সাহিত্য সমালোচনা ও প্রবন্ধ ছাপা হতে লাগল। সেই ১৯৯৭ সালে ডেইলি স্টারে আমার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। তারপর অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন ইংরেজি/বাংলা দৈনিকে এবং স্টার উইকএন্ড ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল।
টমাস অ্যান্সেল সম্ভবত ২০০১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচে থাকতে তার এক বোন ইংল্যান্ড থেকে এসে তার দেখাশোনা করতেন, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইতেন। ইত্তেফাকের তৎকালিন চিফ রিপোর্টার শফিকুল কবির তার ‘টিকাটুলি থেকে পিকাডেলি’ বইতে টমাস অ্যান্সেল সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘তিনি (টমাস অ্যান্সেল) কিছু একটা খুঁজতে এসেছিলেন। কী, সেটা অস্পষ্ট।’ সম্ভবত প্রেমঘটিত।
‘টিকাটুলি থেকে পিকাডেলি’ বইটির সমালোচনা করেছিলাম আমি এবং সেটি ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী আমাকে সমালোচনার দায়িত্বটা দিয়েছিলেন।
এরপর আমার মনের আকাশে অনেকদিন মেঘের আনাগোনা ছিল। ইয়ং অবজারভারে আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে না-এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি ঢাবি’র ইংরেজি বিভাগে অনার্সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম। শামিম করিম রঞ্জনও (প্রয়াত) কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন ইয়ং অবজারভারে আমি লিখছি না কেন। আমি এড়িয়ে যেতাম।
এরপর একদিন একটা মজার বিষয় ঘটল। আমি জানতাম. ওই ভদ্রলোক সম্পাদকের পুত্র হিসেবে অবজারভারে চাকরি পেয়েছিলেন। তার যে যোগ্যতা ছিল না সেটা তার ব্যবহার দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কনকর্ডের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দি নিউ নেশন পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম নিজ যোগ্যতায়। শিফট ইন চার্জও হয়েছিলাম। ছেড়েও দিলাম নিজ যোগ্যতায়। পরে যোগ দিয়েছিলাম সরকারি দপ্তরে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার হিসেবে।
আমার অনার্স পড়াকালিন একটা ঘটনা ঘটল। সাফ সাংস্কৃতিক উৎসবে শ্রীলংকা দলের দলনেতা মি. ফোনসেকার সাথে আমার এক বন্ধু’র মাধ্যমে দারুণ খাতির হয়ে যায়। আগের দিন ক্যামেরা নিয়ে এক কেলেংকারি ঘটে যায়। কোনো এক ফোটোগ্রাফার অনুমতি ছাড়াই লংকান এক সুন্দরীর ছবি তুলে ফেলে। সে নিয়ে তুলকালাম কান্ড। লংকান মহিলা অভিযোগ করে দেন। এরপর ক্যামেরার বিষয়ে কিছু রেস্ট্রিকশনস দেয়া হয়।
আমি জানতাম না। আমার কাঁধে ইয়াশিকা ক্যামেরা ঝুলছে। হোটেল পূবার্ণীর এলিভেটরের দিকে আমি আর ফোনসিকা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এসময় একজন গার্ড এসে বলল, ক্যামেরা নিষিদ্ধ। ফোনসিকা আমাকে দেখিয়ে বললেন, ও আমার লোক। ব্যস। ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেলাম।
সেইসময় লিফটে ওঠার সময় দেখা হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের সাথে। আমার কাঁধে ক্যামেরা, সাথে বিদেশি ডেলিগেশনের লিডার। তার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড় হলো। আমার তারুণ্যের টগবগে রক্ত লোকটাকে নিতান্ত হেলায় ঠেলে দিল। এরপর আরেকবার তার সাথে দেখা হয়েছিল একটি নতুন প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকায়। আমি কী একটা কাজে যেন গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সেই লোক সাব এডিটরের পদে এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার মানে হলো, অবজারভারে তার পিতার চাকরি ছিল না। অতএব তার চাকরিও ছিল না।