হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
বালুকা বেলার গত কয়েকটি পর্বে মূলত ভ্রমণ বিষয়েই টুকরো কিছু স্মৃতির কথামালা গেঁথেছিলাম। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটছে না।
আশির দশকের শেষের কথা। আমি তখন কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রকাশন লি.এ নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। আমার লেখালেখি তখন বহতা নদীর মতো প্রবহমান ছিল। মূলত আমার সাহিত্যজগত ও সংগীত সাধনার সাথে আমার চাকরির ধরনের কোনো মিলই ছিল না। আমার মন ও মননের গাঁথা বুঝাবার বা শুনাবার মতো কলিগ কেউ আমার ছিল না। যে দুজন কলিগের সাথে আমার মন ও মতের মিল হলো সে দুজন কলিগের সাথে মূলত আমার চাকরিস্থল, অফিসিয়াল দায়িত্ব আর এক ধরনের স্মার্ট-চটপটে জীবনের ভাব বিনিময় হতো। ফলে, আমার সংগীত ও সাহিত্যচর্চা সহসাই কোনো গভীর অতলে যেন হারিয়ে যেতে বসলো। আমার এক কলিগ ও আমি নিয়মিত লাঞ্চ করতাম গুলশান এর রেস্তরাঁয় আর লাঞ্চ শেষে আমরা গানের ক্যাসেট কিনতাম, স্পিকার ও যাবতীয় ইলেক্ট্রোনিকস-এর ওপর আমাদের দুজনেরই নেশা ধরানো আগ্রহ ছিল। সেসব আমরা কিনতাম। শপিং ও কেনাকাটার সময় আমার ভেতরের লুকোনো আগ্রহটা বেরিয়ে পড়তো। আমি অ্যান্টিকস-এর প্রতি আগ্রহশীল ছিলাম। সেসব সংগ্রহ করতাম। একধরনের বিলাসিতায় আমার লাইফস্টাইল যেন পাল্টে গেল।
তবে আমার ভেতরের সাহিত্য-সংগীত মনটা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে যেত। অফিস থেকে পিকনিকে গিয়ে আমি গান গেয়ে পিকনিকের সদস্যদের মন মাতিয়েছিলাম। সুযোগ পেলে আমার সাহিত্যচর্চা, বিশেষত গল্প লিখিয়ে পরিচয়টা উন্মোচনের প্রয়াস নিতাম।
সেইসময় মনে মনে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল রাজশাহী বেড়াতে যাবার। আগ্রহটা হঠাৎ জাগেনি; যুক্তি ছিল এরকম ইচ্ছে জাগবার অন্তরালে। বিক্রমপুর হাউসে থাকি তখন। পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতির সাথে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। ভাই, ভাবি ও তাদের ছোট্ট মেয়ে জুঁইয়ের সাথে গল্প করতাম। তারাও যথেষ্ট সময় দিতেন আমাকে।
সময় গড়িয়ে গেলো। ভাই চাকরিসূত্রে বদলি হলেন রাজশাহীতে। ঘটনাক্রমে রাজশাহী শহরের ঝাউতলাতে ভাবিদের বাড়ি। তিনি যাবার সময় আমাকে খুব করে বলে গেলেন রাজশাহীতে একবার বেড়িয়ে আসবার জন্য।
কনকর্ডে চাকরি করে হাঁপিয়ে উঠলাম। একবার চাকরি ছেড়ে দিলাম সম্পূর্ণ দেনা-পাওনা মিটিয়ে। প্রথমবার চেয়ারম্যান সাহেব আমার রেজিগনেশন গ্রহণ করেননি। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় অব্যাহতি পেলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। কনকর্ডের এক পরিচালক সাহেব কী একটা জরুরি দরকারে আমার খোঁজ করে আমাকে না পেয়ে জানলেন যে আমি চাকরি ছেড়ে চলে গেছি। আমি একবার তাকে রাজউক থেকে তার একটা বিশাল কাজ সম্পন্ন করে দিয়েছিলাম। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ কলিগের কাছ থেকে আমার বাসার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে বাসায় ফোন করে তার সাথে যোগাযোগ করতে বললেন।
তিনি কোনো ভূমিকা না করে সোজা আমাকে আবার কনকর্ডে যোগ দিতে বললেন। আমি তো রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম। ততোদিনে আমি ধানমন্ডিতে ড. মালিকা সায়ান্স ইনস্টিটিউশনে যোগ দিলাম ইংরেজির লেকচারার হিসেবে। সেখানে ক্লাস নেবার আগেই আমি কেটে পড়লাম ড. আলীম আল রাজি’র স্ত্রী ড. মালিকার সাথে অনেকটা ছল-চাতুরি করে। লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে ব্যর্থতার কারণ কনকর্ডের সেই পরিচালকের (যিনি কনকর্ডের একটি সিস্টার কনসার্ন-এর এমডি ছিলেন) অনুরোধ-উপরোধে আমি সেই সিস্টার কনসার্ন-এ যোগ দেবার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কনকর্ডে আবার যোগদানে নিজকে পিছিয়ে নিতে শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি বললাম যে, চেয়ারম্যান সাহেব হয়তো আমাকে নেবেন না। পরিচালক জানালেন যে, সেটা নাকি আমার মাথাব্যথা না। সেই বিষয়টি তিনি তার ওপর ছেড়ে দিতে বললেন। বিষয়টি আমি তার ওপর ছেড়ে দিয়ে আবার যোগ দিলাম মূল কনকর্ডের এক সিস্টার কনসার্নে।
কিছুদিন পর মন আবার বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। আমাকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে, তার কোনোটিরই প্রাপ্তিযোগ না ঘটায় আমি আবার পলায়ন করলাম। সম্ভবত সেই নতুন যোগদান ও ফের চাকরি ত্যাগ করার মাঝামাঝি সময়টাতে আমি ক’দিনের ছুটি নিয়ে রাজশাহী যাবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলাম। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকেট কেটে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। তখন বোধহয় ঢাকা-রাজশাহী বিমান চলাচলের প্রারম্ভিক সময়।
আমার পোড়া কপাল রাজশাহী ভ্রমণের ভার বইতে পারেনি। পরিকল্পনা অনেককিছুই করেছিলাম। কিন্তু সবকিছু মাঠে মারা যাবে এমনভাবে তা ভাবতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল সাঁওতালদের এলাকায় যাবার। ইচ্ছে ছিল জীবনানন্দের বনলতা সেনের বাসস্থান নাটোরে যাবার। সেসব ভাগ্যে জুটলো না। জুটলো জ¦র। সে যেমন তেমন জ¦র নয়। ধুম জ¦র। জ¦র একটু সারতেই রিটার্ন টিকেটের সুবাদে রাজশাহী বিমানবন্দরে এসে শুনলাম বিমান আমাকে রেখে চলে গেছে। কী ব্যাপার! খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার টিকেটের গায়ে বিমান ছাড়ার যে সময় দেয়া হয়েছিলো তার একঘন্টা পরে আমি পৌঁছেছি! আমি হয়তো জ¦রের ঘোরে ভুল সময় দেখেছিলাম। অগত্যা ভগ্নমনোরথে ফিরে এলাম ফের ভাবিদের বাসায়। ফেরার সময় পরের দিনের টিকেট নিয়ে ফিরলাম।
তবে দুইতিন দিনে আমি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, চিড়িয়াখানা, পদ্মার পাড়, হযরত শাহ মখদুমের মাজার, নিউমার্কেট প্রভৃতি ঘুরলাম।
সেটা পদ্মা নদীর তীরের ঘটনা।
রাজশাহীর পদ্মার তীরে, নভেম্বরের নিস্তরঙ্গ জলের কিনারায় দাঁড়িয়ে কোনো এক অজানালোকে যেন পাড়ি দিয়েছিল আমার ইহজাগতিক মন। আমার ভেতরে ‘মাইন্ড বগলিং জোন’ কথাটা খেলে যাচ্ছিল। সেটা থেকে একটা আইডিয়া পেলাম। একটা গল্প লিখে ফেললাম। গল্পটার নাম দিলাম ‘পরপারে।’ গল্পটা ছাপা হয়েছিল ইত্তেফাকে। বিপুল প্রশংসিত হয়েছিল গল্পটা আর এক সাহিত্য আড্ডায় গল্পটি নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল।
একটা আক্ষেপ-অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে এলাম ঢাকায়। কনকর্ডের নতুন অফিসের ব্যস্ততা আর সেই কারণে আমার স্বাধীনচেতা মন এবং সাহিত্যচর্চা হালে পানি পাচ্ছিলো না। ফলে, আমি নতুন চাকরির সন্ধানে রত হলাম। আসলে ভেতর থেকে একটা তাগাদা তৈরি হয়েছিল এমন কোনো চাকরি জোগাড়ের, যা নাকি আমার সাহিত্য-সংগীত চর্চার সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। পেয়েও গেলাম তেমন একটি চাকরি। দি নিউ নেশন পত্রিকায় যোগ দিলাম সাব এডিটর হিসেবে। মন ভরে গেলো খুশিতে, যদিও কনকর্ডের তুলনায় এখানে বেতন ছিল নগণ্য। অবশ্যি চাকরির ধরনটাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই বনে গেলাম শিফট ইনচার্জ। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। এতো দায়িত্ব, এতো খাটূনি আগে থেকে বুঝতেই পারিনি। কনকর্ডে চাকরি করতাম রকেটের বেগে, এখানে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিলো বিদ্যুৎগতিতে। তবে একটা দিকে লাভ হলো। বাসা ও অফিস কাছাকাছি। আর বাড়তি পাওনা ছিল সাপ্তাহিক রোববার-ইত্তেফাক কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডা ও আলোচনা এবং গল্প-নিবন্ধ প্রকাশ। সেইসাথে সাপ্তাহিক পূর্ণিমা পত্রিকা ঘিরে সাহিত্য আলোচনা, গল্প তৈরি ও প্রকাশ।
দি নিউ নেশন পত্রিকাও ছেড়ে দিলাম, এই চাকরিটি আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যাওয়া সত্তে¡ও। ছাড়তে হলো এই কারণে যে ততোদিনে আমার ভাগ্যে ‘সব চাকরির সেরা চাকরি’ সরকারি চাকরি জুটলো। অনেকের মতে, সরকারি চাকরি সেরা চাকরি হলেও আমি ভিন্নমত পোষণ করি এ বিষয়ে। কেন করি, সেটা সামনের কোনো এক পর্বে আমি বিস্তারিত বয়ান করবো।
আজ এতোটুকুই বিচরণ বালুকা বেলায়।