হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
এটা কোনো ভ্রমণ কাহিনি নয়। ব্যাকপ্যাকিং নিয়ে ঘোরা, বা সলো ভ্রমণ, কিংবা শিক্ষাসফর। কোনোটিই নয়। আমরা দিনে দুপুরে কল্পনায় পরির দেশে যাই। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি। এসবের কোনোকিছুই নয়।
এটি একটি স্বপ্ন পূরণ। অনেককাল যাবত লালিত স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র নামের একটি দেশে যাব। এটি কি ভিনগ্রহের দেশ, বা পৃথিবী থেকে বাইরে? না। যদিও এই কিছুকাল আগেও অনেক অ্যামেরিকান নিজেদের দেশটাকেই গোটা দুনিয়া বলে ভাবত। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কোনো দেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা বা আগ্রহ ছিল না। এখন অবশ্যি অবস্থা পাল্টে গেছে।
স্বপ্নটা যেন অনেকটা আকস্মিকভাবেই ধরা দিল। এরকম একটি স্বপ্ন বহু আগে থেকেই লালন করে আসছিলামÑÑঅ্যামেরিকা দর্শনের স্বপ্ন। কোনো লালিত স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনতে অনেক সাধ্য সাধনা করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়; তবে কিছু স্বপ্নের নাগাল পাওয়া যায়। দূরকে কাছে পেতে এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে যেতে হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র গমনের আগে ক্যানেডায় আগমন করে দূরকে বেশ কাছেই এগিয়ে নিয়েছিলাম।
২৪ এপ্রিল ২০১৫ পাড়ি দিলাম ইউনাইটেড স্টেটস অব অ্যামেরিকায়। পাড়ি দিলাম বলছি, কারণ অনেক কষ্টে এই পাড়ি দেবার কাজটি করেছি।
সবচেয়ে ছোটোবোন, শোভা থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পম্পানো বিচে। আমার সিটিজেনশিপ হবার প্রাক্কালে ওকে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম ওকে দেখতে যাব। তারপর সিটিজেনশিপ হলো, পাসপোর্ট হলো।
টিডি ব্যাংকে গিয়ে তিনশ’ ক্যানেডিয়ান ডলার দিয়ে পেলাম দুইশ’ চল্লিশ ইউএস ডলার! বাকি ক্যানেডিয়ান ডলার রাখলাম লাগেজ বাবদ অর্থ প্রদানের জন্য। ইউএস এয়ারওয়েজের টিকেটে লাগেজের দাম ধরা হয়নি।
২৪ এপ্রিল ২০১৫ বিকেল সাড়ে তিনটায় ফ্লাইট। বিশাল অংকের ভাড়া গুনে ট্যাক্সিক্যাবে এয়ারপোর্টে যাওয়াটা সমীচীন হবে না ভেবে সাবওয়েতেই এয়ারপোর্ট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু একটা অনিশ্চয়তা গ্রাস করল আমাকে। বিশাল লাগেজ নিয়ে দূরের সফর, তদুপরি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আগে কখনও সাবওয়েতে যাইনি। তবু সিদ্ধান্তটা বহাল রাখলাম; টাকাপয়সার টানাটানি না থাকলে ক্যাবেই যেতাম। সোয়া বারোটায় বাসা থেকে রওনা দিলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে একঘন্টা তো লাগবেই।
আমার ছেলে শাহদিব আমার তেইশ কেজি’র বড় লাগেজটা সাবওয়ে পর্যন্ত এগিয়ে দিল। তারপর দীর্ঘ ভ্রমণের পর শেষ স্টেশন কিপলিংয়ে নামলাম। এরপর দেখলাম ১৯২ রকেট বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেতে হবে তিন নাম্বার টার্মিনালে। বিশাল ও রাজকীয় বাস। উঠে পড়লাম, আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিলাম যে, বাসটা যখন পিয়ারসন এয়াপোর্টেই যাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই যথাক্রমে এক, দুই ও তিন নাম্বার টার্মিনালে থামবে। লাগেজসমেত উঠে পড়লাম বাসে। কিপলিং থেকে অনেকটা পথ। প্রায় বিশ মিনিট। তারপর একে একে এক-দুই টার্মিনাল পেরিয়ে বাসটা চলতে লাগল। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে তিন নান্বার টার্মিনাল দেখাতেই স্টপ রিকোয়েস্ট করলাম।
প্রথমবারের মতো ম্যাশিন রিডেবল পাসপোর্ট নিজেই ম্যাশিনে দিয়ে সমস্ত তথ্য দিলাম। ইমিগ্রেশনে একটা মামুলি প্রশ্ন করা হলো, কতদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকব। বললাম একসপ্তাহ। ব্যস পার হয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন। এরপর চড়লাম ইউএস এয়ারওয়েজের ছোটোখাটো একটা প্লেনে। এটা প্রথমে যাবে ফিলাডেলফিয়াতে, সেখানে তিনঘন্টার বিরতির পর সেখান থেকে ফোর্ট লডারডেল।
রওনা দেবার দু’দিন আগে ইটন সেন্টার ও স্কারবরো টাউন সেন্টার চষে বেড়ালাম। ইটন সেন্টারের বানানা রিপাবলিক থেকে আগে একটা প্যান্ট কিনেছিলাম। মাপ ও দামে ভালোই ছিল প্যান্টটা। সেখানে আবার গেলাম, কিন্তু মনের মতো দামে ও পছন্দের প্যান্ট মিলল না। অন্যান্য স্টোরও ঘুরে দেখলাম কিন্তু মনের মতো পেলাম না। শেষে ইটন সেন্টারের একটা উইন্ড বুদ থেকে আমার সেলফোনে ইউএস রোমিং করিয়ে নিলাম। সেদিনই ইটন সেন্টার থেকে গেলাম স্কারবরো টাউন সেন্টারে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে প্যান্ট পছন্দ হলো না, মল বন্ধ হবার সময় হয়ে গিয়েছিল। তাই গ্যাপ থেকে একটা বেল্ট কিনে বাসায় ফিরলাম। পরদিন ফের গেলাম স্কারবরো টাউন সেন্টারে, ঘুরাঘুরির পর অবশেষে কেলভিন ক্লাইন থেকে দু’টো প্যান্ট কিনলাম একশ’ সত্তর ডলারে।
ফিলাডেলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামলাম বিকেল ছ’টায়। তিনঘন্টা সময় হাতে। এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে সেলফোনে দেখলাম ‘ওয়েলকাম টু ইউএসএ’ এবং ‘আনলিমিটেড ইউএস রোমিং’ ম্যাসেজ! কল দিয়ে বসলাম শোভাকে।
শোভা ফোন ধরতেই জানালাম, ফিলাডেলফিয়াতে এসেছি এবং এখানে অল্প সময় ঘুরব। তারপর একটা ক্যাব ডেকে ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, আমাকে আধঘন্টা শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে ঠিক যেখান থেকে উঠেছি, সেখানে নামিয়ে দিতে। তো ক্যাবে খানিকক্ষণ ঘুরে শহর দেখলাম, ডলারের শ্রাদ্ধ হলেও অ্যামেরিকার একটা শহর তো দেখলাম! জলজ্যান্ত আশি ডলার খরচা করে ফেললাম ক্যাবের পেছনে।
তারপর এয়ারপোর্টে এসে নতুনভাবে সিকিউরিটি চেকিংয়ের পাল্লায় পড়লাম। তাতে কোনো সমস্যা হয়নি, এয়ারপোর্টের লোকজনের কাছে ভালো ব্যবহার পেলাম, বোধহয় ক্যানেডীয় পাসপোর্টের কারণে। ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টের ভেতরে একটা মার্কেট প্লেস আছে। কিছুটা সময় মার্কেট প্লেসে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর একটা রেস্তরাঁয় ঢুকে স্যান্ডুইচ ও বিয়ার খেলাম। বিল হলো সতেরো ডলার। তিন ডলার টিপস দিয়ে বের হয়ে গেলাম রেস্তরাঁ থেকে।
…ইউএস এয়ারওয়েজের মাঝারি আকারের একটা বিমানে সোয়া দুইঘন্টা উড়বার পর নামলাম ফোর্ট লডারডেলে। ফোর্ট লডারডেল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট! এখান থেকে মিনিট পঁচিশের গাড়ির রাস্তার দূরত্বে থাকে আমার সবচেয়ে ছোটোবোন। ওর সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ঢাকায় ২০০৫ সালে। আমি তখন চাকরিসূত্রে খুলনায়। শোভা বাংলাদেশে আগমনের দুই তিন দিন পরই আমি এক সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসি। তারপর ফিরে যাই খুলনায়, আবার এলাম দিনতিনেকের জন্য, ফিরেও গেলাম ফের। তাই শোভার ফিরে যাবার সময় আমি বিদায় জানাতে উপস্থিত থাকতে পারিনি। শোভা এসেছিল ওর মেয়ে মানতাশাকে সাথে নিয়ে। সেবার ওর হাজব্যান্ড আসতে পারেনি। মানতাশার বয়স তখন দুইবছর। কিউট মানতাশা আমার জন্য দারুণ এক বিনোদন হয়ে উঠেছিল।
ফোর্ট লডারডেলে দেখলাম ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুই ভদ্রমহিলা! একজন আমার শোভা ও অন্যজন্য কিউট ছোটো লেডি মানতাশা। সুদীর্ঘ দশটি বছর পর দেখা। সেই কিউট তুলতুলে মানতাশা এখন ইয়ং লেডি! চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, লম্বা ছড়ানো চুলের মানতাশা!
এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখলাম গাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ টুটু। আমরা গাড়িতে উঠে প্রথমেই বাসায় গেলাম না। শোভা প্রস্তাব করল গাড়িতে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারপর বাসায় যাব। আমি তেমন টায়ার্ড ছিলাম না। গাড়িতে করে ওয়েস্ট পাম বিচ/ফোর্ট লডারডেল এলাকায় অনেকরাত অব্দি ঘুরলাম। এবং এই ঘুরাটা সার্থক হলো। রাতের আলো আঁধারিতে এমন মাইন্ড বেøায়িং দৃশ্যাবলি দেখে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলো।
রাতের রহস্যময় আলো আঁধারিতে পাম গাছ, নারকেল গাছ ও অন্যান্য ট্র্রপিক্যাল গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পেলাম ইনল্যান্ড সী ঘেঁষে মিলিয়ন ডলারের বাড়িগুলো ও বোট ইয়ার্ড। ফোর্ট লডারডেল আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। সাগর ও ট্রপিক্যাল ওয়েদার আর অসংখ্য সীবিচের কারণে গোটা ফ্লোরিডাকে স্বর্গরাজ্য বলা যায়।
পরদিন গেলাম মায়ামি ও ওয়েস্ট পাম বিচে। আমি, শোভা, মানতাশা ও টুটু। যাবার পথে ওরা আমাকে দেখাল হলিউডের কিংবদন্তি নায়ক লী মেজরস-এর বাড়িটা। ‘সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান’ ও ‘দি ফল গাই’ খ্যাত লী মেজরস ১৯৯১ সাল থেকে ফোর্ট লডারডেলে বাস করছেন। প্রথমদিন আমরা মায়ামি বিচে ঘুরলাম, দ্বিতীয় দিন মূল (সাউথ) মায়ামি বিচে গেলাম। ফেরার পথে সুবিশাল এলাকাজুড়ে বে-সাইড নামের জাঁকজমকপূর্ণ মার্কেটে কেনাকাটা করলাম। বোট রাইড করলাম আর খেলাম।
বে-সাইডে এক জায়গায় দুইটি বিশাল ম্যাকাউ (Macaw, order: Psittaciformes-রেইন ফরেস্টের বিশাল টিয়ে প্রজাতির বহুবর্ণিল পাখি) দুই কাঁধে নিয়ে ছবি তুললাম। এখানে দক্ষিণার বিনিময়ে আরও অনেক প্রজাতি, যেমন-অ্যালিগেটর (আমাজন ও ফ্লোরিডার কুমির), পাইথন প্রভৃতি জীবজন্তুর সাথে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। বে-সাইডের বিলাসী দোকানগুলোতে ঘুরবার সময় শোভা আমাকে বিখ্যাত বাথ অ্যান্ড বডি ওয়র্কস-এর পুরুষদের বডি লোশন, মিডনাইট ব্র্যান্ডের কোলোন ও বিশ্ববিখ্যাত গুচি ব্র্যান্ডের পারফিউম কিনে দিল। পরপর দুইদিন আমরা মায়ামিতে গেলাম।
পম্পানো বিচের ফর্টি ফিফথ স্ট্রিটের শোভার বাসাটা আর ওই এলাকাটা ছবির মতো সুন্দর। মাঝখানে কালো-মসৃণ প্রশস্ত রাস্তা, দুইধারে প্রায় একই রঙের ও ধাঁচের নিচু একতলা সারি সারি বাসাগুলো দেখতে যেন কোনো বিশেষ এলাকার আর্কিটেকচারাল মডেল। বাসার একধারে গ্যারাজ ও সামনে ঘাসের লন, সেখানে নানা ট্রপিক্যাল গাছ, নারকেল গাছ, পাম গাছ ও ফুলের বাগান।
২৭, ২৮ ও ২৯ এপ্রিল পরপর তিনদিন আমাদের রুটিন প্রায় একইরকম দাঁড়াল। শোভা ওর বিশাল ফোর-রানার গাড়িতে করে আমাকে মানতাশাকে নিয়ে বেরুল। মানতাশাকে ওর স্কুলে পৌঁছে দিয়ে শোভা ও আমি কেনাকটা করতে ও ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। পার্ক, বিভিন্ন শপিং মল, অ্যান্টিকস-এর দোকান, সব ঘুরলাম। তারপর চারটায় মানতাশার ছুটি হলে মানতাশাকে নিয়ে আমরা রেস্তরাঁয় খেয়ে বেড়ালাম। শোভার কাণ্ডকীর্তি আমাকে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত করল। আমার পায়ের দুরবস্থা সে কখন খেয়াল করেছিল, বলতে পারব না। ও আমাকে নিয়ে গিয়ে পেডিকিউর করিয়ে দিল; আমার পায়ের অবস্থা করুণ ছিল। টো এবং গোড়ালি সাদা হয়ে গিয়েছিল, নখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এক ভিয়েতনামি মহিলা যথেষ্ট যতœ ও সময় নিয়ে আমার পা দু’খানা তকতকে করে দিল। এই দোকানের মহিলারা শোভাকে চেনে এবং সম্মান করে শোভা নিয়মিত আসে বলে।
সবচেয়ে উত্তেজনাকর বিষয় হলো ডিজনি ওয়র্ল্ড পরিদর্শন। আমি ও শোভা, এমনকি মানতাশা পরিকল্পনা করছিলাম কীভাবে ডিজনি ওয়র্ল্ড দেখা যায়। ফ্লোরিডায় গমন করে ডিজনি ওয়র্ল্ড ভ্রমণ না করে ফিরে আসার অর্থ হলো ফ্লোরিডা, তথা যুক্তরাষ্ট্র সফর এক অর্থে বৃথা যাওয়া। তবে একটি সুখকর বিষয় হলো, মেজোপা তখন সান ফ্রান্সিস্কোতে তার ছেলে বাবুর বাসায় অবস্থান করছিল। আমার ফ্লোরিডায় আগমন উপলক্ষে মেজোপাও সেখানে আসার সিদ্ধান্ত নিল। ভাগ্নে বাবু তখন পেরুতে ভ্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাবুকে পেরু যাত্রা করিয়ে মেজোপা ফ্লোরিডার প্লেনের টিকেট করে জানাল যে, তার আসার পর যেন আমরা অরল্যান্ডোতে প্রোগ্রাম করি।
আমার হাতে সময় নিতান্তই কম ছিল। কেননা, প্লেসমেন্ট রিপোর্ট দাখিল করা নিয়ে ঝামেলায় ছিলাম এবং ফিরে এসে এই কাজটা সম্পন্ন করার কথা। আমার প্লেসমেন্ট কোর্ডিনেটরের কাছ থেকে মে’র ৮ তারিখ পর্যন্ত সময় নিয়েছিলাম, যদিও জানতাম না কীভাবে তা সম্ভব করব।
যাইহোক মেজোপা এলো। আমি, শোভা, মানতাশা ও টুটু গিয়ে মেজোপাকে ফোর্ট লডারডেল বিমানবন্দরে রিসিভ করলাম। সেখান থেকেই আমরা সবাই মায়ামি বিচে রওনা দিলাম। বিচ সংলগ্ন দোকান ও মার্কেটে ঘুরলাম, বিচে এসে দোলনায় চড়লাম এবং ছবি তুললাম। অনেকরাতে বাসায় ফিরে পরদিন ওরল্যান্ডো যাবার পরিকল্পনা করে সবাই ঘুমোতে গেলাম।
পরদিন দুপুরে আমরা রওনা দিলাম ওরল্যান্ডোর উদ্দেশে। পম্পানো বিচ থেকে যেতে হবে কিসিমি, যার দূরত্ব ৩২৫ কি.মি., এবং গাড়িতে তিনঘন্টার ভ্রমণ। ড্রাইভ করবে টুটু, আমরা সাথে খাবার নিলাম। টুটু সাধারণত ওর নিজের স্টোরে কাজ করে অনেকরাতে বাসায় ফেরে। সে গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার তন্দ্রায় ঢুলে পড়ছিল। কয়েকবার বোধহয় মাইক্রো¯িøপেও চলে গিয়েছিল। আমি টুটুর পাশে বসা ছিলাম। কথা বলে বলে ওকে সচেতন রাখছিলাম।
মাইক্রোস্লিপ হলো এক প্রকারের জেগে জেগে ঘুমোনো- চোখ খোলা থাকে কিন্তু মস্তিষ্ক ক্ষণিকের জন্য কার্র্যক্রম বন্ধ করে ফেলে। মেজোপা বা শোভা কিংবা মানতাশার মাইক্রো¯িøপ দুর্ঘটনার বিষয়টি ধারণায় ছিল না; আমার ছিল। কারণ আমার জার্নালিজমের পড়াশোনায় মাইক্রোস্লিপ সম্পর্কে পড়েছিলাম আর তাই আমি ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত ছিলাম, কিন্তু সেটা প্রকাশ করিনি সবাই ভয় পেয়ে যাবে বলে। মাইলের পর মাইল একই গতিতে-ভঙ্গিতে গাড়ি চলছিল, কারণ সেটা হাইওয়ে- শুধু অটোস্পিড দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা।
একসময় আমরা কিসিমিতে পৌঁছুলাম। তখন সন্ধ্যে সাতটা। তারপর আমরা গেলাম রিসেপশনে, সেখানে অনেক সময় ব্যয় করে ইউনিভার্সেল স্টুডিয়োতে গমন এবং রিসোর্টের টিকেট কাটলাম। আমরা ওরল্যান্ডোর রিসোর্টের দুই কামরার বিলাসী স্যুইটে রাত কাটালাম। ভেতরের রুমে ঘুমোল শোভা, মেজোপা ও মানতাশা আর বাইরের রুমে ঘুমালাম আমি ও টুটু। তবে সারাদিনের ভ্রমণ এবং ওরল্যান্ডোতে ইনফরমেশন সেন্টার থেকে রিসোর্ট পর্যন্ত কয়েকবার ভ্রমণ এবং রাতে খাওয়া ও গল্পগুজবে অনেকরাত হয়ে গেল। পরদিন খুব ভোরে উঠলাম। আমরা রিসোর্ট স্যুইট ছেড়ে দিয়ে রিসোর্টের ওয়েস্টগেইট ভিলা ও টাউন সেন্টারে কুপন দাখিল করে সকালের নাশতা সারলাম।
তারপর রওনা হলাম ইউনিভার্সেল স্টুডিয়োর উদ্দেশে। একবার পথ ভুল করলাম আমরা এবং ঘুরপথে অবশেষে পৌঁছুলাম ইউনিভার্সেল স্টুডিয়োতে। স্থানটাকে স্বপ্নের দেশ বললে অত্যুক্তি হয় না। কড়া সিকিউরিটি চেকের পর আমরা প্রবেশ করলাম সেখানে। আমরা বিভিন্ন রাইডে চরে এবং ঘুরে ঘুরে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করতে লাগলাম। দেখার, চড়ার আর উপলব্ধি করার অজ¯্র উপাদান, আর এক দুইদিনে সেটা দেখা দেখে ও উপভোগ করে শেষ করা যাবে না।
আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে বিচরণ করতে লাগলাম, একদলে মেজোপা, শোভা ও আমি আর অন্য দলে টুটু ও মানতাশা। আমি কোনো রাইডে চড়লাম না, মনে হলো দেখেই আমার মন ও চোখের তৃষ্ণা মিটে গেছে। আরও একটা কারণ ছিল, সেখানে আগমনের পর থেকে শাহদিব এবং তার মা’র কথা মনে পড়ছিল। তাই আমি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিলাম। আরেকটা কারণে টেনশনে ছিলাম। ওয়েষ্ট পাম বিচে অবস্থিত লায়ন কান্ট্রি সাফারি আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছিল। মেজপা আমাদের সাথে যোগ দেবার পরের দিন আমরা মায়ামি ঘুরে ওয়েস্ট পাম বিচে গিয়েছিলাম, তবে গিয়ে শুনলাম চারটায় সাফারির ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যায়। আমরা পৌঁছেছিলাম চারটার সামান্য আগে। তাই খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিলাম আমি। সবাইকে বলে-কয়ে একটু তাড়াতাড়ি ফের রওনা দিলাম। ইউনিভার্সেল স্টুডিয়ো থেকে বের হবার পথে আমরা একটা মুক্তো বিক্রির দোকানে থামলাম। একটা মুক্তো কিনলাম আমি, একেবারে ঝিনুকের ভেতরের মুক্তো। এটা স্ত্রী’র উদ্দেশ্যেই কিনলাম। মায়ামি বিচে শপিংয়ের সময় পারফিউম, লোশন, গিফট প্রভৃতি নানা জিনিস কেনার সময় স্ত্রী’র জন্য এডি বসানো একটা আংটিও কিনেছিলাম।
যাইহোক, আবারও দীর্ঘ যাত্রা শুরু করলাম ফিরে আসার জন্য। আমার ভেতরে চলছিল টেনশন, বারবার সময় দেখছিলাম আর পথ কতটা বাকি আছে হিসেব করছিলাম। চারটার আগে, মানে অন্তত তিনটার মধ্যে পৌঁছুতে পারলেও লায়ন সাফারিটা দেখতে পাব। আমরা যখন মাঝপথে তখন দেড়টা বেজে গেল। টুটু জানাল, এখনও প্রায় দুইঘন্টার পথ। আমি যুক্তি দেখালাম, দুইঘন্টার পথ তো বাসায় যেতে। লায়ন কান্ট্রি সাফারি তো পথে পড়বে (সামান্য পথ অন্যদিকে ঘুরে) ওয়েস্ট পাম বিচে, আর সেখান থেকে বাসায় যাবার পথ চল্লিশ মিনিট। সুতরাং আশা করছি, অন্তত একঘন্টা আগেই পৌঁছুতে পারব।
একঘন্টা আগে নয়, ঠিক আধঘন্টা আগে পৌঁছুলাম। টিকেটের মহিলা বলল, জলদি ঢুকে যাও, আধাঘন্টা পর বের হয়ে এসো। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম ‘আগে ঢুকি তো, তারপর আধাঘন্টা না একঘন্টায় বের হবো সেটা পরে দেখা যাবে।’
তারপর আমরা ঢুকলাম সাফারিতে, মানে আমার প্রিয় হিং¯্র-নিরীহ জীবজন্তুর জগতে। ওয়েস্ট পাম বিচে অবস্থিত লায়ন কান্ট্রি সাফারি মূলত আফ্রিকার সাভানা (Savannah) অঞ্চলের প্রাণী দিয়ে সাজানো। তারা খোলামেলা পরিবেশে বিরাজ করে। আর যেহেতু ওয়েস্ট পাম বিচ, তথা গোটা ফ্লোরিডার জলবায়ু ট্রপিক্যাল, সেহেতু এই স্থান সাভানা অঞ্চলের পরিবেশ সহায়ক। সাভানার সাথে এই অঞ্চলটার অনেক পার্থক্য আছে, তবে মূল পার্থক্য হলো জীবজন্তু ও বৃক্ষের প্রজাতি। ফ্লোরিডায় যেমন ঘনঘন বৃষ্টি হয়, সাভানায় তা হয় না। আর সাভানা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো গোটাটাই একটা উষ্ণমণ্ডলীয় তৃণভূমি। পক্ষান্তরে ফ্লোরিডা ঘন বৃক্ষরাজিতে ঠাসা।
সাভানার জীবজন্তুদের মধ্যে প্রধান হলো সিংহ, চিতাবাঘ, চিতা, গ্যাজেল ও এরকম নানাজাতের অ্যান্টিলোপ, জেব্রা, জিরাফ, গণ্ডার, জলহস্তি, হায়িনা, বুনোকুকুর, ওয়াইল্ডে বিস্ট, হাতি, কেপ বাফেলো, কুমির, অস্ট্রিচ, শকুন, বেবুন, ওয়ার্থহগ, একজাতীয় বড় ও দুষ্প্রাপ্য কুডু (গ্রেটার ও লেসার) ও আরও অজস্র প্রাণী।
তবে লায়ন কান্ট্রি সাফারিতে একটা ব্যতিক্রম দেখলাম। সেখানে জলাভূমি সৃষ্টি করে যেমন রাখা হয়েছে জলহস্তি, তেমনি দেখলাম ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের প্রাণী টাপির। আমি খুব কাছে থেকে একটা টাপিরের ছবি তুললাম এবং ভিডিও করলাম। টাপির পাওয়া যায় সাধারণত দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকায় এবং এশিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে (মালয়েশিয়ায়)।
এখানে টাপিরের অবস্থান সম্পর্কে আরেকটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমার মনে হলো, ফ্লোরিডা টাপিরের বসবাসের জন্য আদর্শস্থানীয়, কেননা টাপিরের বাসস্থান রেইনফরেস্টে, আর ফ্লোরিডাতে ঘনঘন বৃষ্টিপাত হয়, বৃক্ষরাজি/জলাভূমি তো আছেই।
সাভানা হলো এমন এক অঞ্চল যেখানে প্রচুর বৃক্ষ থাকলেও গাছগুলো দূরত্বে অবস্থান করে এবং এদের ক্যানোপিতে (ডালপালার আচ্ছাদন) ফাঁকফোকর থাকায় মাটিতে আলোবাতাস পৌঁছে প্রচুর ঘাস সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। স্থানে স্থানে অবশ্য ঘন ঝোপঝাড় ও উঁচু ঘাস থাকে। সাভানা অনেক প্রকারের হয় এবং আফ্রিকা ছাড়াও অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এখানে সেসব প্রসঙ্গক্রমে যেটুকু এসেছে, তা-ই বললাম। এবং যৎসামান্য বর্ণনা যেটুকু দিলাম তা আমি ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক দেখে বলেছি।
অবশেষে ২ তারিখ চলে এলো। খুব ভোরে ফ্লাইট বলে এবং রাত বারোটায় বাইরে থেকে ফিরে আসার কারণে মাত্র এক বা দুইঘন্টা ঘুমোতে পারলাম। অন্ধকার থাকতেই রওনা দিলাম। এয়ারপোর্টে সবাই এসেছিল, টুটু ভেতরে ঢোকেনি, সে গাড়িতে বসা ছিল।
আমি একটা স্যূটকেস ও একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম, টরোন্টোতে ফিরলাম বিশালাকারের তিনটা স্যূটকেস ও হ্যান্ডব্যাগ ও কাঁধে ল্যাপটপ ঝুলিয়ে। সবচেয়ে বড় স্যূটকেসের ওজন দাঁড়িয়েছিল বত্রিশ কেজি!
আমার যুক্তরাষ্ট্রে গমনের বহু আগে থেকেই ছোটোবোন শোভা দুনিয়ার শপিং সেরে রেখেছিল আমাদের তিনজনের জন্য। তারপর সেখানে গিয়ে আরো শপিং করলাম। আমার লাগেজের মূল্য টিকেটে ধরা ছিল না। ফলে টরোন্টোতে যেমন লাগেজের দাম দিলাম, তেমনি আসবার পথে ফোর্ট লডারেডেলেও এতগুলো লাগেজের মূল্য পরিশোধ করলাম। নিয়ম আছে, প্রথম লাগেজের পর যত লাগেজ নেয়া হবে, সেগুলোতে আনুপাতিক হারে ফি বাড়তে থাকে। যেমন, প্রথম লাগেজের মূল্য যদি পঁচিশ ডলার হয় তবে দ্বিতীয় লাগেজে লাগবে বিয়াল্লিশ ডলার, তৃতীয়টিতে (হিসেব করে দেখতে হবে)। এভাবে আনুপাতিক হারে লাগেজের দাম দিতে হলে লাগেজগুলো এয়ারপোর্টে ফেলে আসাই ভালো।
আমার কাউন্টারের মহিলাটি আমার প্রতি সদয় ছিল। সে জানাল, আমাকে আনুপাতিক হারের বিপুল পরিমাণ ডলার দিতে হবে না; শুধু মূল মূল্যটা দিলেই হবে! আমার তো রীতিমতো আক্কেল গুড়–ম! জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই যদি ভাগ্য এমন সহায় হতো! (অবশ্যি আমি মহিলার কানে ফিসফিস করে বলেছিলাম যে, আমি স্টুডেন্ট; যেন আমার প্রতি সে সদয় হয়)।
বিপুল পরিমাণ মালসামান নিয়ে টরোন্টোতে ফিরলাম। পিয়ারসন এয়ারপোর্টে লাগেজ নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়িনি, শুধু একটা ডিক্লারেশন দিয়ে এসেছিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরলাম ক্যাবে চড়ে। সত্তর ডলার ভাড়া প্রদান করলাম।
আমার আনা উপহারসামগ্রী ও জিনিসপত্তরের মধ্যে আমাদের তিনজনের জন্য সবরকম ব্যবহার্য জিনিসপত্র, জুতা, ব্যাগ, জামাকাপড়, গহনা, শো-পিস, টেবিল ল্যাম্প, ক্রিস্টালের নানা জিনিস ও শো-পিস, ঘড়ি, পারফিউম, লোশন, মেকাপ কিট, ছোটো ফ্যান, সেতুর পোশাক ও মাইকেলসের কয়েকটি দামি হ্যান্ডব্যাগ, শাড়ি ও আরো অনেক জিনিস এবং সর্বোপরি আমার জন্য ইলেক্ট্রোনিকস।
বিপুল সংখ্যক ইলেক্ট্রোনিক দ্রব্যাদি! ল্যাপটপ, দু’টো আইফোন, আইপ্যাড, এমনকি অ্যাপল আইপড ন্যানো। আরও আছে কয়েকটি অ্যান্ড্রয়েড হ্যান্ডসেট, সনি মুভি ক্যামেরা, পোর্টেবল ডিভিডি, ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, ওয়্যারলেস হেডসেট প্রভৃতি।
আমার জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে। তবে ইউএসএ দর্শন খুবই ব্যতিক্রম।
শুধুমাত্র অনেককিছু প্রাপ্তির দিক থেকেই না, এটা ছিল মনের একটা প্রশান্তি এবং জীবনের একটা বড় সাধ পূরণের অধ্যায়। দীর্ঘ দশটি বছর পরে ছোটোবোনটাকে আর ওর মেয়েটাকে দেখলাম। তারপর আমি ফ্লোরিডা এসেছি শুনে মেজোপা চলে এলো শুধু আমাকে দেখতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে। এইসব প্রাপ্তি ইহজাগতিক ইলেক্ট্রোনিক দ্রব্যসামগ্রীর চাইতেও বহু মূল্যবান।