হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
সোনালি মাছ
রূপকথার সেই কাহিনির মতো। এক জেলে সারাদিন জাল ফেলে একটা মাছও পেলনা। শেষে সে যখন নিরাশার শেষ সীমায় পৌঁছুল তখন তার জালে আটকে গেল এক সোনার মাছ। মাছটি কথা বলে উঠল। মিনতি করল জেলেকে তাকে ছেড়ে দিতে। তাকে ছেড়ে দিলে জেলেকে সে পণ দিবে। জেলে মাছটাকে ছেড়ে দিল, তারপর পেল মূল্যবান রত্ন। সেই জেলের ভাগ্য ফিরে গেল, জীবনে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
রূপকথার সেই কল্পকাহিনির মতোই বঙ্গোপসাগরে জেলের জালে জড়িয়ে গেল মস্ত বড় এক সোনার মাছ। স্বর্ণের মতো তার রঙ। কথা বলা সেই মাছ নয়। কিন্তু কোনো কথা না বলেও সে বুঝিয়ে দিল যে সেই কল্পকাহিনিকে হার মানানোর মতো মূল্যবান বস্তু সে। তবে এতে সাধারণ জেলেদের ভাগ্য ফেরে না। তারা জাল ফেলেই যায় আর হতাশায় ভোগে। কারণ কল্পকাহিনির ছোঁয়া তো আর সবার ভাগ্যে লাগে না। আর যদি শয়ে শয়ে এই মাছ ধরা পড়ত বঙ্গোপসাগরে তাহলে কী হতো? পরিণাম হতো সুন্দরবনের মতো। সুন্দরবন যেমন খেয়ে খেয়ে শেষ করে ফেলেছে মানুষ, তেমনি নিমেষেই বিরান হয়ে যেত বঙ্গোপসাগরের অবশিষ্ট মাছ। এমনিতেই বঙ্গোপসাগর দূষণ ও অতি আহরণের শিকার। তার ওপর মাছ ধরার কম্বিং অপারেশন শুরু হলে আর দেখতে হবে না। কেননা, সোনার মাছের স্বর্ণালি সন্ধানে আপামর মাছ জালে তুলতে শুরু করবে বিজ্ঞ জেলে আর মৎস্য সাধকেরা।
এই মাছটির নাম কোরাল মাছ। সোনালি কোরাল। আকারে বিশাল, ওজনে ৩৭ কেজি। আর সে বিক্রিত হলো ৩৬ লাখ টাকায়। হ্যাঁ, খুবই মূল্যবান মাছ সে, সন্দেহ নেই। কোনো কোনো প্রাণী বা প্রাকৃতিক উপাদান অত্যন্ত মূল্যবান। যেমন কস্তুরি মৃগ। মৃগনাভি নিঃসৃত সুগন্ধি পদার্থের জন্য স্মরণাতীতকাল থেকে মানবজাতির লোলুপতার শিকার হয়ে আজ কস্তুরি হরিণ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন প্রায়। তেমনিভাবে গণ্ডারের খড়গ, হাতির দাঁত, সাপের বিষ আর বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর চামড়ার লোভে সেসব প্রাণী শিকার করে মানুষ তাদের ফেলে দিয়েছে বিলীন হবার সর্বশেষ প্রান্তে। কোনো কোনো প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। চলতি দশকেই সবচেয়ে মর্মন্তুদ নিয়তির শিকার হয়েছে রুয়ান্ডার ভিরুঙ্গা পর্বতমালার মাউন্টেন গোরিলা। নিষ্ঠুরভাবে আর গণহারে গোরিলা নিধন করেছে কঙ্গো-রুয়ান্ডার বিদ্রোহীরা। ২০০৭ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস পরিবেশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের সরকার বিরোধী বিদ্রোহীরা দুইটি মাউন্টেন গোরিলা মেরে তাদের মাংস খেয়ে ফেলে।
পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সোনালি কোরাল ধরা পড়বার খবরটি। ২০১২ সালে। এর এত দাম হবার কারণটা কী? খবরটা পড়েই জানতে পারলাম এর ফোত্না অতি মূল্যবান।
ফোত্নাটা কী বুঝতে পারলাম না। ভাবলাম মাছের পেটা হবে। কিন্তু পরে জানলাম মাছের পেটের ভেতরে শাদা অথবা কিছুটা ট্র্যান্সপারেন্ট ধরনের যে বাতাসের টিউব থাকে, সেটাই ফোত্না। চীন, হংকং ও কোরিয়ায় কোরাল মাছের ফোত্না বেশ মূল্যবান। স্বাদ বাড়াতে ও মনকাড়া সুগন্ধির জন্য দামি খাবারের স্যুপে এই ফোত্না ব্যবহার করা হয়। চোখের রেটিনা প্রতিস্থাপন ও অপারেশনের মূল্যবান যন্ত্রপাতি তৈরিতেও এই ফোত্না ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অপারেশনের সার্জারি গ্লাসেও এর ব্যবহার হয়। সোনালি কোরালের ফোত্না যত বড় হয় মাছের দামও তত বেশি হয়। স্থানীয় ভাষায় এই মাছটির নাম ‘খৈয়া ফুল’। খেতে বেশ সুস্বাদু। দামি মাছ লাক্ষার চেয়েও স্বাদ বেশি সোনালি কোরালের। বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ মাছ আছে তার ৫ থেকে ৭ শতাংশ হবে এ ধরনের সোনালি কোরাল। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যে পরিমাণ সোনালি কোরাল রয়েছে তার মূল্য হতে পারে কয়েক শ’ কোটি টাকা। তবে এই মাছ ধরা পড়ে সামান্যই। সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের জন্য যে ধরনের জাল ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে এই মাছ সহজে ধরা পড়ে না। ৩৫ থেকে ৫০ মিটার গভীরতায় এই মাছের বিচরণক্ষেত্র।
মহামূল্যবান এই বিরল মৎস্য-সম্পদ রক্ষা ও যথাযথ আহরণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। অথচ ‘কিং ক্র্যাব’-এর মতো আরেক মূল্যবান মৎস্য-সম্পদ সমুদ্র থেকে আহরণ করে ভারতের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন ক্যান্সারের প্রতিষেধক। কিং ক্র্যাব পাওয়া যায় বঙ্গোপসাগরের তিনটি দ্বীপ-সেন্ট মার্টিন, মহেশখালি ও সোনাদিয়ায়। কিং ক্র্যাব দেখতে কচ্ছপের মতো, ছয় ইঞ্চিরও বেশি লম্বা লেজ রয়েছে এর। অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে মৎস্য-সম্পদের পদ্ধতিগত আহরণ, সংরক্ষণ বা যথাযথ ব্যবহার নেই।
বঙ্গোপসাগরের সুবিশাল জলসীমায় কী পরিমাণ জলজ ও প্রাণিজসম্পদ রয়েছে, তা জরিপ কিংবা গবেষণার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জামাদি বা নিজস্ব বিশেষায়িত কোনো জাহাজও নেই। নেই তদারক, মনিটরিং বা দূরদৃষ্টি।
কোরাল মাছ কালেভদ্রে ধরা পড়ে, গণ হারে ধরা পড়ে না- সেই স্বল্প সম্ভাবনাই বহাল থাকুক। তাতে জেলেরা অলস বা লোভী হয়ে পড়বে না। সার্বিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। কল্পযুগ এখন নেই। সোনালি মাছ ধরা পড়লেও সে কথা বলে উঠবে না; বলবে না তাকে ছেড়ে দিতে। অন্তত জেলেরা যেন বুঝতে পারে বা এটা মহামূল্যবান মাছ সেই কথা বুঝার মতো জ্ঞান রাখে। তা না হলে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী বা ঠকবাজের কবলে পড়ে সে মাছ হারাবে। আলাদিনের চেরাগের মতো মূল্যবান দুয়েকটি সোনালি কোরাল কোনো ভাগ্যবান জেলের জালেতে জড়িয়ে যাক। বদলে যাক তার ভাগ্য।