হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

‘জীবনের জলসাঘরে’ শিরোনামে কিংবদন্তি মান্না দে তার জীবনী লিখে গেছেন। বইটি আমার সংগ্রহে আছে। আর সেটা আমি পড়েছিও। বইটা পড়ে শুধু মান্না দে সম্পর্কেই যে জানা যাবে তা নয়, বরং সংগীত সম্পর্কে অজানা অনেককিছু জানা যাবে।

আমার আজকের লেখা সংগীত সম্পর্কে। ইতোপূর্বে ঢাকা ও টরোন্টোর পত্রিকায় কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী মান্না দে ও বশির আহমেদ সম্পর্কে লিখেছি। ‘বালুকা বেলা’ কলামে আমার নিজের সংগীত চর্চা ও গান গাইবার বিষয়টি উল্লেখ করেছি প্রসঙ্গক্রমে। আজকে সবিস্তারে আলোকপাত করব মান্না দে প্রসঙ্গে। আর বিশেষভাবে বলব এই দুই কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী সম্পর্কে। বশির আহমেদ আমার ক্লাসিক্যাল সংগীত শিক্ষার গুরু ছিলেন আর মান্না দে ছিলেন এবং এখনও মনের গহিনে আছেন আমার দূরের গুরু হিসেবে। তাকে আমি কাছে থেকে দেখিনি বা কখনও তার সাথে আমার কোনোদিন কথা হবার উপলক্ষ সৃষ্টি হয়নি। তবু তিনি আমার দূরের গুরু। তাকে আমি আমার তরুণ কাল থেকেই মনে প্রাণে, শ্রবণে আর করোটিতে ধারণ করেছিলাম।

বইটা থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, ক্লাসিকেল ও গজল, টপ্পা-ঠুমরী ভজন ও সিনেমার সংগীত সম্পর্কে অনেককিছু জানা যাবে। আর জানতে পারা যাবে সেই উনবিংশ শতকের সংগীতের উত্থান ও অগ্রগতি, দুঁদে ওস্তাদ ও সংগীত বিষয়ক পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে। মান্না দে’র প্রথম ওস্তাদ তারই কাকা স্বার্গীয় কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কাছেই মান্না দে’র সংগীতে হাতে খড়ি হয়।
মান্না দে’র ডাক নাম ছিল মানা। এখানে আমি ‘জীবনের জলসাঘরে’ সম্পর্কে আলোচনা বা রিভিউতে যাব না। সেটা একটা মহাভারতের মতো। আমি বইটি থেকে মান্না দে’র সংগীত সম্পর্কিত কিছু কথা বলব আর সামান্য উদ্ধৃতি দিব। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন একটা একক প্রতিষ্ঠান। হেন কিছু নেই সংগীতের যা তার অজানা ছিল। নাত্ গাইবার জন্য তিনি উর্দু শিক্ষক রেখে উর্দুতে তিনি এতটাই পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন যে, তার কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করে নিলেন উর্দুতে তার অসাধারণ দক্ষতা। তখনও সংগীতে চরম প্রতিযোগিতা ছিল। হতাশাও কাজ করেছিল মান্না দে’র মাঝে। তবে তিনি ছিলেন অসম্ভব আশাবাদী আর বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজকে মানিয়ে নেবার দক্ষতা তার ছিল। এক স্থানে তিনি বলেছেন: ‘আমি মোটেই সেই ধরনের মানুষ না, যারা ভাবেন আমাদের সময়ে সবই সবচেয়ে ভালো ছিল। না, আমি মোটেই তা ভাবি না। এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের সেই দিনের তুলনায় এখন অনেক ভালো।’

মান্না দে’র জন্ম ১ মে ১৯১৯ সাল। তার প্রকৃত নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। ১৯৩৭ এ কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু। সেই বছরই গায়ক হিসেবে মঞ্চে (কলেজ ফাংশনে) আত্মপ্রকাশ। ১৯৩৯ সাল থেকে ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের সহকারি হয়ে প্রথম মুম্বাই যাত্রা ১৯৪২এ। শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন ওস্তাদ আমান আলী খাঁ সাহেবের কাছে। প্রথম প্লে ব্যাক ‘তামান্না’ ছবিতে। গানটি ছিল ‘জাগো আঈ উষা।’ শচীনদেব বর্মণের সুরে ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবিতে ‘ওপর গগন বিশাল’ গান টা গেয়ে সাফল্য ও জনপ্রিয়তা পান।

দর্শক-শ্রোতা কী চায় কীভাবে চায়- সবই বুঝতেন তিনি। আর এই বুঝা-পড়ার পালায় তাকে ভুগতেও হয়েছিল বেশিরকম। মহানায়ক উত্তম কুমার আর রাজ কাপুর লিপ সিং এর বিষয়ে খুব বেশি রকমের সচেতন ছিলেন। ঠোঁট মিলল কিনা- এ নিয়ে অনেক খেসারত দিতে হয়েছিল মান্না দে কে। সে অন্য এক গল্প। মানুষের, শ্রোতাদের মনকে বুঝতেন তিনি। তাই তার অ্যাপ্রোচটা ছিল ‘ডাউন টু আর্থ’ এবং ছিল একটা সর্ব ভারতীয় আবেদন। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি হিন্দি গান দিয়ে চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক করেন প্রথম, তারপর ভারতীয় প্রায় সব ভাষাতেই। বাংলা গানে তিনি অনেক পরে ঢুকলেও দেখা গেল যে, তার বাংলা গানে এপার-ওপার দুই বাংলার শ্রোতারা রীতিমতো মাতাল হয়ে যেতেন সুরেলা কন্ঠে ও মধুর বাণীতে। তিনি জন রিভস-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রবলভাবে।

প্রথম বাংলা গানে প্লে ব্যাক করেন ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে (১৯৫৪)। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে প্রথম প্লে ব্যাক করেন ‘কে প্রথম কাছে এসেছি।’ একধরনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও দার্শনিক প্রজ্ঞা নিয়ে জন্মেছিলেন এই কালজয়ী শিল্পী। সব ছাপিয়ে প্রেম ও প্রেমময় মনটাকে তিনি বুঝেছিলেন বিশুদ্ধ হার্দিক ভঙ্গিতে। ‘সবে যখন প্রাণে আমার মন জেগেছে, পৃথিবীটা একটুখানি বদলে গেছে।’ এটা কোন্ কিশোর-কিশোরীর মনের কথা নয়? এই গান টা সেই বিখ্যাত গানের একটি কলি ‘ও কেন এতো সুন্দরী হলো।’
মান্না দে ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীতশিল্পী এবং সুরকারদের একজন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তিনি সত্তর বছরেরও অধিক সময় সংগীত চর্চা করেছিলেন। আলিপুরদুয়ারে তার গুণগ্রাহী দেবপ্রসাদ দাস নিজের বাড়িতে মান্না দে সংগ্রহশালা তৈরি করেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাকেই ভারতীয় গানের ভুবনে সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সংগীতবোদ্ধা। উত্তর কলকাতায় তার বাসস্থানের কাছে মান্না দে’র আবক্ষ মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়।

মান্না দে গায়ক হিসেবে ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সফল সংগীত ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে অশেষ সুনাম অর্জন করেছেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এই দুই দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সংগীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন। সংগীত ভুবনে তার এই অসামান্য অবদান স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় অভিষিক্ত করে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ প্রদান করে।

কথা ছিল কুস্তিগীর হবার, হলেন গায়ক। তিনি কুস্তির আখড়ায় যেতেন। কুস্তি লড়তেন। তাতে তার মেজদার সম্মতি ছিল। মান্না দে’র পরিবারে তার মেজদা ছিলেন পরম প্রতাপশালী। মান্না দে নিজের মনের তাগাদায় আর কৃষ্ণচন্দ্রের ছায়ায় সংগীতকে বেছে নেন।

এবার আমার প্রসঙ্গ। হাতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে পিঁপড়ের প্রসঙ্গ আরকি। একটা সময়ে প্রত্যক্ষভাবে সংগীতচর্চা করলেও সংগীতবিষয়ে তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিক বিদ্যা আমার খুব একটা ছিল না। আর এখনও সেই ঘাটতিটা রয়ে গেছে। একসময় ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম। সঙ্গীতজ্ঞ বশির আহমেদের কাছে কিছুকাল ক্লাসিক্যাল শিখেছিলাম, যদিও সেটা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারিনি। লেখালেখিতে ডুবে গিয়েছিলাম। একটা সময় মনে হতো, হয়তো হারমোনিয়াম বাজানোটা ভুলে গেছি। ক্যানেডায় আসার পূর্বে একটা স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম কিনেছিলাম চড়া দামে। প্রথম দফায় সাথে নিয়ে আসতে পারিনি। পরে ২০১২-এর জুলাই মাসে বাংলাদেশে গিয়ে সেটা নিয়ে এসেছি। জীবন ও জীবিকায় ব্যস্ত থাকায় সেটা পড়ে ছিল অনাদরে।

যেকোনো বিদ্যা অর্জনই অত সহজ নয়, সাধনা আর একাগ্রতা ছাড়া কোনো কিছুতেই সফলতা অর্জন করা যায় না। অন্যান্য বিষয়ের মতো সংগীত শিক্ষাটিকেও সহজভাবে নিয়েছিলাম। এটা যে সহজ কাজ নয়, হেলাফেলার নয়- সেটা বুঝার পরিপক্কতা আমার হয়নি। এখন বুঝি। লক্ষকোটি মানুষের মন জয় করা কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে ৮৯ বছর বয়সেও প্রতিদিন দুইঘন্টা রেওয়াজ করতেন! কোনো কারণে সেটা করতে না পারলে তার দিনটাই মাটি হয়ে যেত। তিনি তার কানটাকে তখনও টিউন্ড করে রাখতেন শোনার জন্য যে কে ভালো গাইছে, তার কাছে শেখার জন্য, নতুন কিছু লাভ করার জন্য তখনও তার প্রাণ আইঢাই করত! সুতরাং সংগীতকে যারা খুব সহজভাবে নিচ্ছেন, গানের গলা একটু ভালো হলে আর সামান্য কিছু গান শিখে রেকর্ড করলে, বিভিন্ন চ্যানেলে গান করলেই সংগীতশিল্পী হওয়া যায় না। ভিত শক্ত না হলে তা ধসে যেতে পারে। প্রকৃত অর্থে শিক্ষালাভের কোনো মেয়াদকাল নেই। তবে সাধারণভাবে একটা নির্দিষ্ট সোপানে এসে কারুর ব্যবহারিক ও তাত্তি¡ক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটতে পারে। সেই মেয়াদকালটাও আজকাল কমে যাচ্ছে শর্টকাট অবলম্বনের কারণে। শর্টকাটে যেখানে কাজ হয়ে যায়, সেখানে খামোখা বেগার খেটে লাভ কী! সংগীতের ক্ষেত্রেও এরকম পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। সংগীতশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিবিশেষের মানসিক প্রস্তুতির মেয়াদকাল ক্রমেই কমে আসছে। ৪০, ৫০ বা ৬০ দশকের চেয়ে ৭০, ৮০ কিংবা ৯০ দশকের একটা পার্থক্য কিন্তু সুস্পষ্ট কিছুটা সঙ্গীতের ‘আধুনিকায়ন’ ও যুগমানসের দাবির কারণে। তারপর সা¤প্রতিকসময়ে (বিগত তিনদশকে) সংগীতের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সুরে, বাণীতে আর কম্পোজিশনে। সেটা হতে পারে যুগের দাবির প্রেক্ষিতে কিন্তু তা যদি সাংগীতিক যাবতীয় পরিভাষাকে অতিক্রম করে ক্রমাগত এক্সপেরিমেন্টাল পর্যায়েই থাকে তবে তা স্থায়ী হয় না। আমরা বড় বেশি এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলছি। অথচ এক্সপেরিমেন্টেশনের জন্য কাঠামোটাই ঠিক রাখছি না।

আধুনিক সংগীতের কথাই বলছি। সংগীত অর্থ হলো নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়। যারা ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চা করছেন তারাও কিন্তু এই তিনটি কাজই করছেন। নৃত্যও করছেন তারা, কিন্তু সেটা একটা আন্তরছন্দ, আপাত দৃশ্যমান নয় কিন্তু অনুমেয় ও বোধগম্য। আমরা এই তিনটি বেসিক উপাদানের র‌্যাশিও ঠিক রাখছি না, যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও নর্তনকুর্দন করছি।
আমি সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক মেয়াদও সমাপ্ত করিনি আবার কোনো শর্টকটাও বেছে নিইনি। তাই সংগীতকে আমি আমার আত্মার খোরাক করে মান্না দে’র ভক্ত হয়েছি আর তার দুয়েকটি গান গাইবার চেষ্টা করেছি। গায়ক হতে চাইনি। যদিও আমার মাঝে ‘গায়ক হবার সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান’ বলে অনেক পোড়খাওয়া বন্ধু বা বিদগ্ধ ব্যক্তি মতপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আমি সংগীতশিল্পী হতে চাইনি। চেয়েছি নিভৃতে দুয়েকটি গান গাইতে। সাহিত্য যেমন জীবনের প্রতিচ্ছবি, তেমনি সংগীতও কিন্তু মনের প্রতিচ্ছবি। এর জলজ্যান্ত একটা প্রমাণ আমি নিজে। তখন অগাস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম। স্থান কলকাতা। সময় দুপুর। আমরা ওপেন মার্কেট আর এসি মার্কেটে ঘুরাঘুরি করছিলাম। ওপেন মার্কেটের সামনে দিয়ে বিশাল ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। আসলে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম, আরো খোলাসা করে বলতে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলাম লোয়ার সার্কুলার রোডে। দুইপাশের পুরোনো ইমারতগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এখানেই কোথাও ছিল আজাদ পত্রিকা অফিস আর তাতে বসে আব্বা (মরহুম আবদুল হাই) সাংবাদিকতা করছেন!

হাঁটছি তো হাঁটছিই, ভালো লাগছে আবার ক্লান্তিও ভর করেছে। একটা জায়গায় দেখলাম কিম্ভূত আকারের একটা চাপকল, তাকে ঘিরে মহিলা ও পুরুষেরা ভিড় করেছে, পানি নিচ্ছে। স্নান করছে, কথা বলছে। জায়গাটা অপেক্ষাকৃত খোলামেলা ও গাছপালায় ঢাকা। তীব্র গরম, গাছপালার ফোকর দিয়ে রোদের আলপনা অঙ্কিত হয়েছে। এইসময় শুনতে পেলাম সেই সংগীতটি। কোথায় যেন তা বাজছে। আসলে বাজছে আমার বুকের গহিনে! ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ, একি বেদনার মতো বেজেছে আবার হারানো সেদিন…।’ এরকম নস্টালজায় খুব কমই আক্রান্ত হয়েছি এযাবৎ। কে গাইছিলেন গানটি? আর কে? সেই মহাগুরু, মানে মান্না দে!
ছোটোকাল থেকেই মামা-খালাদের মুখে শুনেছি সতীনাথ, হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, সুবীর সেন, জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সায়গল, গীতা দত্ত, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধুরী, সন্ধ্যা আর লতার গান। তখন মান্না দে’র গান শুনতাম না। অথচ মান্না দে’র বহু আগের হিট বাংলা গান আছে যা এখনও সমান জনপ্রিয়। পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে এখনও তিনি তুঙ্গে। তাহলে মান্না দে’র গান শুনতাম না কেন মামা-খালাদের মুখে? আসলে গাওয়া যায় না গুরুর গান। শুধু মন ছুঁয়ে যায়, ভেতরে অনুরণন ওঠে, কিন্তু মুখনিঃসৃত হয় না। গুরুর গায়কি, কন্ঠ, ক্লাসিক্যাল বেইজ, সর্বভারতীয় আবেদন, (অনেকের ভাষায় ‘আলাদা একটা কিছু’)- সবকিছুই যে গুরুর একান্ত নিজস্ব। মান্না দে’র নিজের ভাষাতেই সেটা ‘একটু অন্যভাবে।’ এই ‘অন্যভাবে’টা ধরতে হলে মনে হবে মরীচিকার পেছনে ছুটছি। এসব কারণেই মান্নার গান শুনতাম না তাদের মুখে। হেমন্তের গান শুনতে পেতাম। কারণ হেমন্তের সেই সোজাসাপ্টা মিঠে ভরাট গলাটাই ছিল তার অসাধারণত্বের প্রধান মাপকাঠি। তার গান গাইতে হলে সুরটা হয়তো কব্জা করা যেত। কিন্তু কন্ঠটা কোথায় মিলবে? তেমনিভাবে কিশোরকুমারের গানও তো গাওয়া যেত, কিন্তু তার সেই স্টাইল ও ঈশ্বরপ্রদত্ত কন্ঠ কে নকল করতে যাবে? তাই কিশোরকুমারের গানও সুষ্ঠুভাবে আমাদের পক্ষে গাওয়া সম্ভব না। শ্যামল মিত্রের ক্ষেত্রেও তাই। তবু তার গান গাওয়া যায় সুরের গতিটা ধরে ফেলতে পারি বলে। কিন্তু তারপরেও কথা থাকে। শ্যামলের মতো এত মেলোডি, এত দম আর এত এনার্জি কোথায় পাব? যাদের গান আমরা এখনও গুনগুন করে গেয়ে থাকি, মামা-খালারা গাইতেন, তারা ছিলেন পপুলার, কিন্তু দিকপাল নন।

নিজের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসছি। আমি মান্না দে’র ভক্ত হই যখন আমি নটরডেম কলেজে পড়ি। পরে পুরো বিশ^বিদ্যালয় জীবনে আমি মান্না দে, শ্যামল মিত্র, বশির আহমেদ প্রমুখের গান গাইতাম। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে শুনেছিলাম মান্না দে’র সেই গানÑ‘আমি নিরালায় বসে…।’ প্রায় চল্লিশ বছর পর আমি আমার নিজ কন্ঠে এই গান টা রেকর্ড করেছি! অবশ্যি আমি আবারও বলছি যে, মাঝখানে ১৬-১৭ বছর আমি গানের জগতে ছিলাম না। তেমনিভাবে কিছু কিছু গান, বিশেষত বশির আহমেদ ও মান্না দে’র গান আমি রেকর্ড করেছি অনেক বছর সময় নিয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘বালুকা বেলা’র দুয়েকটি এপিসোডে ও বিভিন্ন মাধ্যমে আমি অনেকবছর পর আমার গানে ফিরে আসবার কাহিনি বলেছি। সেসব এখানে আর উল্লেখ করে পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক করতে চাই না।

চলছিল গুরুর প্রসঙ্গ। …একটু অন্যভাবে-মানে কথা-সুর-গায়কি-মেলোডি-বেইজের মেলবন্ধন দিয়ে ব্যক্ত করা আরকি। এই কাজটি একদিনে করেননি মান্না দে, করেছেন তার সুদীর্ঘ সত্তর বছরের সাধনায়।

কিশোরকুমার-হেমন্ত-রফি’র মতো অতি অলৌকিক কন্ঠ মান্না দে’র নেই। কিন্তু সেটা তিনি পূরণ করেছেন সেই ‘একটু অন্যভাবে।’ ‘ডাউন টু আর্থ’ কথাটা বুঝি শুধু মান্না দে’র ক্ষেত্রেই খাটে। বাণী ও সুরের সম্মিলনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন তিনি। তাই ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো…দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই, আমি তো মানুষ’ গাইবার সময় এর টোন, এর বাণী তার মায়াবী সুরের জালে অন্যরকম ডাইমেনশন পেয়ে যায়। যেমন ‘রিমঝিমঝিম বৃষ্টি’ গানটি যখন তিনি গাইলেন তখন মনে হবে সত্যিই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির একটি ছন্দ থাকে, সেই ছন্দটি প্রকাশ পায় মান্না দে’র বৃষ্টিভেজা সুরের জাদুকরি প্রভায়।
এই মহাগুরু সম্পর্কে বলতে গেলে আরব্য রজনীর গল্পের মতো একটার পর একটা এপিসোড এসে যেতে থাকবে।

২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে মান্না দে পরলোকে পাড়ি দেন। টরোন্টোতে বসে ইন্টারনেটে তার প্রস্থানের সংবাদটি দেখে আমার মনে হয়েছিল যে, পৃথিবীর একটা সুর-ছন্দবদ্ধ বিশাল অংশ যেন আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে মহাকাশের বø্যাকহোলে চিরতরে হারিয়ে গেল।