হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

 

গত দুই এপিসোডে আমি ভ্রমণ বিষয়ে লিখেছি। আমার জীবনের পুরো ভ্রমণ কাহিনি নয়; বিবিধ ভ্রমণের খণ্ডাংশ মাত্র। আজকের এই এপিসোডে আমি তেমনি আরেকটি ভ্রমণের কথা বলব।

আমি আমার প্রয়াত বন্ধু আলমের সাথে তার দেশের বাড়ি পিরোজপুরে ভ্রমণ করেছিলাম। তখন নটরডেম কলেজে পড়ছিলাম। ১৯৮১ সাল। বন্ধু আলম জানাল সে বরিশালে (পিরোজপুর) যাচ্ছে। আমি যাব কিনা। যাব, জানালাম। ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল,’ প্রবাদটি জানা ছিল। শেরে বাংলার দেশ, নদী আর খালের দেশ, জীবনানন্দের দেশ-না দেখে কি পারা যায়।

এক বিকেলে সদরঘাটে এসে লঞ্চে উঠলাম। দু’তলায় উঠে আলম তড়িঘড়ি করে একটা কোণের স্থানে চাদর-কাঁথা বিছিয়ে ফেলল। এই দৃশ্য আমাকে অবাক করল। পরে সব দেখেশুনে বিষয়টি বুঝে গেলাম। এটা হলো জায়গা দখল নেয়া। আর যারা মেয়েছেলে সাথে নিয়ে সপরিবারে যাচ্ছে, তারা শাড়ি বা চাদর দিয়ে মশারির মতো বানিয়ে তার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে।

আমি আর আলম লঞ্চের ছাদে আর নিচতলায় ঘুরাঘুরি করে সময় কাটাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে শুয়েও পড়েছিলাম আলমের বিছানো চাদরে। কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় চিল্লাচিল্লিতে। বিষয়টা কী? অনুসন্ধান করে দেখলাম যে, একজন ঘুমোচ্ছিল, অন্য এক লোক গাদাগাদি স্থানটা পার হবার সময় ঘুমন্ত লোকটির গায়ে পাড়া দিয়ে পার হয়ে যায়। এই নিয়ে বচসা থেকে মারামারি পর্যন্ত গড়াল।

আলমদের বাড়িতে আসার সাথে সাথে এক মজার দৃশ্যের অবতারণা করল আলম। নেংটি পরে গেছো বানরের চাইতেও তৎপরতার সাথে উঁচু ডাবগাছের মাথায় উঠে একের পর এক ডাব ফেলতে লাগল। একসময় নেমে তারপর ডাব কেটে আমাকে দিল। সেদিন ডাবের সুস্বাদু মিঠে পানি খেয়ে আর নড়তেই পারছিলাম না। তখন বর্ষার দিন ছিল। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা মাঠে দুইদল গ্রামবাসীর সাথে যোগ দিয়ে আমি আর আলম ফুটবল খেললাম। তারপরের দিনগুলো বনেবাদাড়ে, জংলাস্থানে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। ‘ডেউয়া’ নামের একপ্রকার হলুদ ফল খেলাম। তারপর পিরোজপুর, বানারীপাড়া প্রভৃতি স্থান চষে ফেললাম। এরপর আরো কয়েকবার আলমের সাথে বৃহত্তর বরিশালের কাউখালি, স্বরূপকাঠি প্রভৃতি স্থান ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।

এক ঈদে আমি, আলম, লাভলু (আমাদের জুনিয়র বন্ধু), ডলি আর ওর ছোটো ভাই শাহাদাৎ (আলমের ভাগ্নি-ভাগ্নে) কাউখালীতে ডলিদের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করলাম। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট কেবল চুকিয়েছি। সেবার আমি লঞ্চের ক্যাবিন ভাড়া করেছিলাম। কোনো এক শীতার্ত রোদ-করোজ্জ্বল দিনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে দিনভর ঘুরে বেড়ালাম আমরা ক’টি প্রাণী।

আরো একবার গিয়েছিলাম কাউখালীতে। স্নান করেছিলাম, সাঁতার কেটেছিলাম সন্ধ্যা নদীতে। গান গেয়েছিলাম হারমোনিয়াম সহযোগে। অনেক শ্রোতা ও শ্রোতৃ ছিল সেই ঘরোয়া আসরে। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ আর ‘তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো।’ চৈতি নামের একটি মেয়ের অনুরোধে এই দু’টি গান বারবার শোনাতে হয়েছিল। সেবার ছিল সেরকম এক গরমের দিন। গরমের চোটে আমরা ঘরের কাছেই সন্ধ্যা নদীতে গা ডুবিয়ে গল্প করতাম। পরের কোনো এক এপিসোডে কাউখালী ভ্রমণ-বৃত্তান্ত আরো বৃহদাকারে তুলে ধরব। দুইবার কাউখালী ভ্রমণ ও লঞ্চের ক্যাবিন ভাড়া করে যাওয়া আসা আর এই ভ্রমণের ভেতরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা ও রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার ইচ্ছে পোষণ করছি।