Home কলাম বালুকা বেলা : শিকার ও শিকারি

বালুকা বেলা : শিকার ও শিকারি

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

শিকার ও শিকারি

শিকার ও শিকার সম্পর্কে এই অংশটুকু লেখার তাগিদ অনুভব করলাম একটা ঘটনা থেকে। আমি যেখানে কিছুটা সময় ছিলাম, সেই স্থানটার নাম রেন্সবার্গ ড্রাইভ, কাছেই আয়নভিউ বাসস্টপ। এখান খেকেই বাসে উঠে বিভিন্ন গন্তব্যে যাই। ইন্টারসেকশনের নাম ক্যানেডি অ্যান্ড এগলিন্টন।

২০১৭ সাল। মাসটা ছিল সম্ভবত মে। ড্যানফোর্থে এক বন্ধু’র সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে আয়নভিউ এসে বাস ধরব বলে রাস্তা পার হতে যাচ্ছি এইসময় আমার পাশ থেকে এক মহিলা (সম্ভবত তামিল) বলে উঠল ‘লুক, লুক।’ কী ব্যাপার? পরক্ষণেই রাস্তার ওপারে তাকিয়ে আমার চক্ষুস্থির। দেখলাম একটা হরিণ দুলতে দুলতে চলছে। আমি রাস্তা পার হয়ে দেখলাম আমার বাস এসে গেছে। কিন্তু রইল পড়ে বাস। আমি হরিণের পেছন পেছন ছুটলাম।

ততক্ষণে আমার পেছনে জুটল আরও কয়েকজন দর্শক। হরিণটা সাইডওয়াক থেকে নেমে একটা মার্কেট ও আবাসিক বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে একটা প্রাইভেট প্রোপার্টির জংলাস্থানে ঢুকে গেল। সেখানের লেখা ছিল: নো ট্রেসপাসিং। আমি আর কী করি, দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাইরে থেকেই হরিণটাকে দেখতে লাগলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, ভেতরে আরেকটি হরিণী। ওরা দু’জনে একত্র হয়ে প্রোপাটির শেষ মাথায় এসে বাঁয়ে মোড় নিয়ে আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। উৎসুক দর্শকেরা চলে এলে আমি জানালাম যে হরিণদু’টো চলে গেছে।

অগত্যা ফিরে এলাম বাসস্টপে। ক্যানেডি সাবওয়েতে এসে পশ্চিমমুখী ট্রেনে চেপে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামলাম। এখানে এসে বার্গার কিং-এ বসলাম। রাস্তার ওপার থেকে টিডি ব্যাংকে ডিউটি শেষ করে বন্ধু এলো। কফিসহযোগে হরিণের গল্প করলাম। সেখান থেকেই সূত্রপাত হলো শিকার কাহিনির। শিকার সম্পর্কে আমার জানা তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিলাম। শুরু করলাম ‘রুদ্রপ্রয়াগের চিতা’ দিয়ে। বন্ধু শুনে অবাক হলো। তার থেকে বয়সে আমি অনেক বড় হবার সুবাদে আর প্রচুর শিকারকাহিনি পড়ার কল্যাণে বেশ জ্ঞান ঢালতে পারলাম। কথা হলো হরিণদু’টো এলো কোত্থেকে? বন্ধু বলল, ‘হয়তো বøাফার’স পার্ক থেকে এসেছে।’

সেটা হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। টরোন্টো শহরের অনেকস্থানেই লোকালয়ে মাঝেমধ্যে হরিণ এসে পড়ে। ক্রেসেন্ট টাউনে থাকতে শুনেছিলাম, সংলগ্ন ম্যাডেলিন অ্যাভেনিউতে মাঝেমধ্যে হরিণের দেখা মেলে। বøাফার’স পার্কে কয়েকবারই গিয়েছি; হরিণও দেখেছি, কিন্তু এই পার্ক সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা নেই। ক্যানেডি সাবওয়ে স্টেশন সংলগ্ন একটি ঘন জঙ্গল আছে- সেখান থেকেও আমার দেখা সেই হরিণদু’টো এসে থাকতে পারে। বন্ধু’র সাথে শিকার নিয়ে গল্প করার পর স্থির করলাম ভারতবর্ষের শিকার সম্পর্কে একটু আলোকপাত করব। সোজা কথায়, আমার পঠিত শিকারকাহিনির বিশ্লেষণ করব। আমার চলমান জীবনীপর্বে আগেও শিকার সম্পর্কে কিছু লিখেছি, তবে এই পর্বে একটু বিশদ আলোচনায় যাব।

অতীত ভারতের এবং বাংলাদেশের সব শিকারকাহিনিই আমি পড়েছি- জিম করবেট থেকে শুরু করে খান বাহাদুর জে. বাট পর্যন্ত। জিম করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতা তিনবার পড়েছি। এই বইটি ভারতের শিকারকাহিনিকে একটা কিংবদন্তির রূপ দিয়েছে। আর যে সময়ের কথা বলছি, শিকার করবার শিকার, ব্যক্তি বা শিকারি এবং সেই পটভূমি আর নেই। তবে ভারত-বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনও শিকার চলছে। তবে তা চোরাশিকার, যা বিশ্বের বহু প্রজাতির বিলুপ্ত হবার কারণ, আর অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। এরমধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারপর আসে আফ্রিকার গণ্ডার ও হাতির বিপন্নতার কথা। এরপর আসতে পারে ভারতের সিংহ ও এক খড়গ বিশিষ্ট গণ্ডারের কথা। এখানে উল্লেখ্য যে, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ছাড়া এশিয়া মহাদেশে একমাত্র ভারতেই সিংহ রয়েছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে আছে আফ্রিকার দুইটি প্রজাতি: মাউন্টেন গোরিলা (পাহাড়ি গোরিলা, মূলত রুয়ান্ডার ভিরুঙ্গা পর্বতমালার গোরিলা) ও রেইন ফরেস্টের বিরল জিরাফ সদৃশ সুন্দর প্রাণী ওকাপি।

রুদ্রপ্রয়াগের চিতা দিয়েই শুরু করি। শুরু করার আগে ওপরের সামান্য ভূমিকা ছাড়াও আরেকটু কথা যোগ না করে পারছি না। ভারতবর্ষের ইংরেজ বংশোদ্ভুত শিকারি জিম করবেট তার রচিত বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘Man-Eating Leopard of Rudraparayag.’ বইটির বাংলা অনুবাদ হয়েছে ‘রুদ্রপ্রয়াগের চিতা’ নামে। আসলে প্রকৃত বঙ্গানুবাদে এর নাম হওয়া উচিত ‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাবাঘ।’ Leopard হলো চিতাবাঘ, কারণ ভারতে কোনোকালেই চিতার অস্তিত্ব ছিল না। চিতা মূলত আফ্রিকার (সাভানা) ও এশিয়ার একাংশের (মরুভূমি) অঞ্চলের প্রাণী, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ঈযববঃধয. অন্যদিকে, বাংলায় নামকরণ ভুল হয়েছে- তেমনটা বলা যাবে না, কারণ বাংলা ভাষাভাষীরা চিতাবাঘকে সংক্ষেপে চিতা বলেই চেনে।

ভারতের প্রখ্যাত শিকারি জিম করবেট রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাবাঘকে শিকার করেন ১৯২৬ সালের ২ মে। পরবর্তীতে তিনি শিকারভিত্তিক অনেকগুলো বই লেখেন, যার মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বইটি, যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। শিকার সম্পর্কে লিখিত কোনো বই যদি সর্বাধিক আলোচিত হয়, এবং তা যদি মানুষের নজর কাড়ে, তবে করবেটের এই বইটি প্রথম সারিতে থাকবে। এর কারণ এর বর্ণনারীতি, শিকারি ও শিকারের অভিনবত্ব, সুবিশাল পটভূমি, লেখকের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, এবং সর্বোপরি একটা মানুষখেকো চিতাবাঘের ধূর্ততা। রুদ্রপ্রয়াগের চিতা, এবং করবেটের শিকার এই চিতাবাঘের শেষ পরিণতি সম্পর্কে লিখিত এই বইটি কেন সাড়াজাগানো, তা নিচের পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যাবে:

-চিতাবাঘটি মানুষখেকোতে পরিণত হবার পর এর প্রথম শিকার হয় বেনজি গ্রামের এক ব্যক্তি ১৯১৮ সালে। ১৯২৬ করবেটের গুলিতে মারা যাবার আগে পর্যন্ত চিতাবাঘটি ১২৬ জন মানুষকে হত্যা করে, এবং দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত ৫০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে রাখে
-চিতাবাঘের লক্ষ্যস্থল ছিল কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রীদের আক্রমণ করা। তাই সে ৫০০ বর্গমাইল জুড়ে বিচরণ করলেও ফিরে আসত দুই তীর্থস্থানে গমনপথের সংগমস্থলে
-সে অনেক মানুষকে মারাত্মকভাবে জখম করে
-রাতে বা দিনে সে কুঁড়েঘরে ঢুকে যেত দরজা ভেঙে বা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে মানুষ শিকার করত
-সে দীর্ঘ আটবছর তার বিটকৃত অঞ্চলে মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখে এবং তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করে
-পেতে রাখা ফাঁদ, বোমা ও আর্সেনিক বিষ থেকেও সে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়, এবং কয়েকবার সে করবেটের হাত ফসকে চলে যায়
-এভাবে মানুষকে ফাঁকি দিতে দিতে সে ধূর্ততার শিখরে চলে যায়
-গ্রামবাসীরা তাকে অপদেবতা ভাবতে শুরু করে
এই চিতাবাঘ কেন মানুষখেকো হলো? একটা চিতাবাঘ বা বাঘ কিংবা অন্য মাংসাশী প্রাণীর মানুষখেকো হবার অনেক কারণ থাকে। প্রথমত বৃদ্ধ হয়ে বা কোনোভাবে আহত হয়ে স্বাভাবিক শিকারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দ্বিপেয়ে প্রাণী মানুষ শিকারের দিকে ধাবিত হয়, এবং একবার মানুষের স্বাদ পেলে তারা কেবল মানুষই শিকার করে। তবে রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘের কাজকারবারই ছিল আলাদা। সে যখন আটবছর আগে মানুষ হত্যা শুরু করে তখন সে ততটা বৃদ্ধ ছিল না। আসলে সে মানুষের মাংসের স্বাদ পায় মহামারীতে মৃত অ-সৎকারকৃত মানুষের মাংসের। এটি তার মানুষখেকো হবার অন্যতম কারণ বলে মনে করতেন জিম করবেট। তিনি তার বিখ্যাত ‘কুমায়নের মানুষখেকো’ শিকারগল্প গ্রন্থের ভূমিকাতে ব্যাখ্যা দেন এভাবে:

‘A leopard, in an area in which his natural food is scarce, finding these bodies very soon acquires a taste for human flesh, and when the disease dies down and normal conditions are established, he very naturally, on finding his food supply cut off, takes to killing human beings. Of the two man-eating leopards of Kumaon, which between them killed over five hundred and twenty-five human beings, one followed on the heels of a very severe outbreak of cholera, while the other followed the mysterious disease which swept through India in 1918 and was called war fever.’

জিম করবেট: ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই নৈনিতালে (উত্তরখণ্ডে) জন্মগ্রহণ করেন এডওয়ার্র্ড জেমস করবেট। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইংরেজ। করবেটের পূর্বপুরুষেরা আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। করবেটের মা ছিলেন মেরি জেন, আগ্রার চার্লস জেমস ডয়েলের স্ত্রী। সিপাহী বিদ্রোহের সময় মৃত্যু ঘটে চার্লসের। মেরির বয়স তখন মাত্র ২১ বছর, সঙ্গে তিনটি সন্তান। এইসময় মেরির সাথে আলাপ হয় মুসৌরির ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেটের সঙ্গে। ক্রিস্টোফার ছিলেন বিপতত্মীক ও তিনসন্তানের পিতা। দু’পক্ষের ছ’টি ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্রিস্টোফার ও মেরি নতুন সংসারের সূচনা করেন এবং ১৮৬২ সালে চলে আসেন নৈনিতালে।

ষোলজন সন্তানের মধ্যে করবেট ছিলেন অষ্টম। বাবা ছিলেন নৈনিতালের পোস্টমাস্টার। কাছেই কালাধুঙ্গি গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। ছোটোবেলা থেকেই করবেট বন্যপ্রাণি ও তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কৌতুহলী হন এবং বন্যপ্রাণি সম্পর্কে চর্চা শুরু করেন। বন্যপ্রাণিদের ডাক শুনে শুনে তার কান এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি সেসব ডাক অবিকল নকল করে শোনাতে পারতেন। বন্যপ্রাণিরাও বুঝতে পারত না সে ডাক আসল না নকল। তাঁর এই দক্ষতা পরবর্তীকালে তিনি শিকারের কাজে লাগিয়েছিলেন। স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে নৈনিতালের (বর্তমান) বিড়লা বিদ্যামন্দির কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনায় ইতি টেনে রেল দপ্তরে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। করবেট ছিলেন একজন নামকরা ফটোগ্রাফার। বন্দুক হাতে নিয়ে চলার বদলে একটা ক্যামেরা থাকলে তিনি অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

তাঁর নামেই ১৯৫৭ সালে ‘করবেট ন্যাশনাল পার্ক’র নামকরণ হয়। ১৯৫৭ সালে জিম করবেট ও তার বোন ম্যাগি পূর্র্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার নিয়েরিতে বসবাস করতে চলে যান। সেখানে তিনি বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। একটা সময় যে বাঘ তিনি শিকার করেছেন তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কেনিয়ার নিয়েরিতে পরলোক গমন করেন।
ইংরেজ কুলোদ্ভব হয়েও করবেট ছিলেন মনেপ্রাণে ভারতীয়। শিকারি জীবনে যেসব গ্রামে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন, সেখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র, সরলতা, অমায়িক ব্যবহার ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এদের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন তার রচিত ‘My India’ গ্রন্থে। বইটি তিনি ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে উৎসর্গ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখায় এইসব দরিদ্র সোজা-সরল লোকদের কথা একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তার নাম দিয়েছিল ‘কার্পেট সাহেব’।

জিম করবেটের লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো- ‘ম্যানইটারস অব কুমায়ন’ (১৯৪৪), ‘দি ম্যান-ইটিং লেপার্ড অব রুদ্রপ্রয়াগ’ (১৯৪৭), ‘মাই ইন্ডিয়া’ (১৯৫২), ‘জাঙ্গল-লোর’ (১৯৫৩), ‘দি টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যানইটারস অব কুমায়ন’ (১৯৫৪)। এরমধ্যে প্রথম বইটির প্রথম সংস্করণ আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হয় এবং ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়। যারা তার লেখা পড়েছেন তারা জানেন যে তার লেখায় জাদুকরী আকর্ষণ আছে। এমন ঝরঝরে ভাষায় ও সাবলীল ভঙ্গিতে তিনি তার যাত্রাপথ বা শিকারের বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় যেন চোখের সামনেই সেসব ঘটছে। একা রাইফেল হাতে জঙ্গলের পথে দিনে এবং রাতে মাইলের পর মাইল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি কী করে মানুষখেকো প্রাণীর পিছু নিয়েছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। বেশ কয়েকটি পরিস্থিতিতে তিনি নিতান্তই দৈবক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন। ছোটোবেলায় বন্যপ্রাণিদের জীবনযাত্রা ও চলাফেরা সম্বন্ধে তিনি যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন সেসব পরবর্তী সময়ে তাকে শিকারের কাজে সাহায্য করেছে।
জিম করবেটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তার নিরহঙ্কার ভাব ও অমায়িক ব্যবহার। তার লেখায় কাহিনির নিখুঁত বর্ণনা ছাড়া কোনো অতিশয়োক্তি, উচ্ছ¡াস বা গর্বের বিন্দুমাত্র ছায়া পড়েনি। দিনের পর দিন বহু কষ্ট সহ্য করে, বিপৎসংকুল পাহাড়ি পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে যে সফলতা তিনি অর্জন করেছেন সেখানে কিছুটা উচ্ছ¡সিত হওয়া খুব অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু তার লেখায় সেটা প্রকাশ পায়নি। বাঘের হাত থেকে অত্যাচারিত গ্রামবাসীদের বাঁচানোতেই ছিল তার আনন্দ। এজন্য তিনি দিনের পর দিন শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে বা ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি।

অনেকে বলেছেন, যদি ভারতকে এতই ভালবাসতেন তবে দেশ স্বাধীন হবার পরেই তিনি ভারত ছেড়ে চলে গেলেন কেন। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তার লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে যে, তার আশঙ্কা ছিল স্বাধীন ভারতে তার ওপর হয়তো অত্যাচার নেমে আসবে, ইংরেজ হওয়ায় তিনি হয়তো কোপানলের শিকার হবেন। ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে লখনৌ থেকে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) গিয়ে ‘এস. এস. অ্যারোন্দা’ জাহাজে মোম্বাসা, এবং সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে নিয়েরি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন করবেট ও তার বোন ম্যাগি।
লখনৌতে যারা সেদিন করবেটকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তার প্রিয় ভারতভূমি ছেড়ে যাবার আগে নৈনিতালের বাড়ি বিক্রি করে তার বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রাইফেল ও বন্দুক গভীর জঙ্গলে ‘সমাধিস্থ’ করেছিলেন জিম করবেট।
জীবনে অজস্র শিকার করলেও করবেট অহেতুক বন্যপশু হত্যা করা কিন্তু পছন্দ করতেন না। তাকে যে শিকার করতে হয়েছে সেগুলো পরিস্থিতির চাপে পড়ে, বাধ্য হয়ে শিকার করেছিলেন তিনি। কুমায়ন ও গাড়োয়ালের বিস্তীর্র্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বাস করত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে জঙ্গলের পথেই যেতেই হতো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ দিয়ে তাদের গৃহপালিত গোরু-ছাগল চড়াতে, জ্বালানির জন্য শুকনো ডাল যোগাড় করতে, গ্রামের স্কুলে পড়তে যেতে, ভিনগাঁয়ের পরিচিত বা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে অথবা বাজার-হাট করবার জন্য জঙ্গলের পথে না গিয়ে উপায় ছিল না। সে কালে সেইসব গ্রামে পাকা বা চওড়া রাস্তা কোথাও ছিল না, গাড়িঘোড়া তো দূরের কথা। হিমালয়লের জঙ্গলে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্যময় পাখির কূজন, দূর থেকে ভেসে আসা বন্যপ্রাণির ডাক বা কাছাকাছি বয়ে যাওয়া কোনো নদীর স্রোতের শব্দ ছাড়া নৈঃশব্দ ভঙ্গের অন্য কোনো কারণ ছিল না। যাদের এরকম গ্রাম দেখার সুযোগ হয়নি এবং শহরাঞ্চলেই জীবন কেটেছে, তারা এই পরিবেশকে স্বপ্ন বলেই মনে করবেন। এইসব দরিদ্র মানুষেরা ছিল ধর্মভীরু এবং সহজিয়া জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। কিন্তু এই শান্ত ও নিস্তরঙ্গ পরিবেশ মাঝেমধ্যে অশান্ত ও ভয়াল হয়ে উঠত মানুষখেকো বাঘ বা চিতাবাঘের অত্যাচারে। সাধারণভাবে বাঘ মানুষকে নিজে থেকে আক্রমণ করে না, হঠাৎ সামনাসামনি পড়ে গিয়ে বা ভয় না পেলে। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের কথা আলাদা। মানুষ শিকার করাই তাদের মূূল লক্ষ্য।

বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার পেছনে অনেকগুলি কারণ করবেট বলেছেন। সজারুর মাংস বাঘের প্রিয় খাবার। সজারু শিকার করতে গিয়ে অনেকসময় সজারুর কাঁটা বাঘের পায়ে বা মুখে বিঁধে যায়, এবং তা সহজে বের হয় না। এতে বাঘ দ্রুত চলার ক্ষমতা ও ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলে এবং এ কারণেই অন্য কোনো শিকার ধরা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ বাঘের খুব সহজ শিকার বলে মানুষ মেরে খেতে খেতে একসময় মানুষখেকোতে রূপ নেয়। অনেকসময় বৃদ্ধ বয়সের কারণে স্বাভাবিক শিকার করতে অক্ষম হয়ে বাঘ মানুষখেকো হতে পারে। আবার কোনো শিকারির গুলিতে আহত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়লে বাঘ মানুষ শিকারের দিকে মনোযোগী হয়। ফলে স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা অংশত হারিয়ে ফেলে বাঘ ক্রমে মানুষখেকোতে পরিণত হয়।

কোনো এলাকার একটা বাঘ মানুষ মারতে শুরু করলে আশেপাশে বহু গ্রামের জীবনযাত্রা কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। একটা বাঘ একদিনে অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার গতিবিধি জানা না থাকায় বহু গ্রামের লোক তটস্থ হয়ে থাকে এবং সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে বেরুতে ভয় পায়। এরকম অনেক পরিস্থিতিতে জিম করবেটের ডাক পড়েছে- হয় গ্রামের মানুষের সকাতর আহ্বান অথবা সরকারের পক্ষ থেকে বাঘ মারার জন্য অনুরোধ আসে। এইসব ক্ষেত্রে করবেটকে বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে, বিপন্ন গ্রামবাসীদের রক্ষা করার তাগিদে। বাঘ শিকার করেছেন তিনি মোট তেত্রিশটি। সবগুলি কাহিনি যে লিপিবদ্ধ হয়েছে তা নয়। তার প্রথম মানুষখেকো শিকার কুমায়নের চম্পাবত গ্রামে- চম্পাবতের মানুষখেকো নামে যে কাহিনি তার লেখা ‘ম্যানইটারস অব কুমায়নে’ তিনি বর্ণনা করেছেন। সরকারি নথি অনুযায়ী বাঘটি মোট ৪৩৬টি মানুষ মেরেছিল। তবে সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে কারণ অনেক মৃত্যুর খবর সরকারি দপ্তরে পৌঁছুয় না। তাই আসল সংখ্যাটা আরও বেশি। তার মানুষখেকো জীবনের শুরু হয় নেপালে। দুই শতাধিক মানুষ মারার পর নেপালি সেনাবাহিনির জওয়ানদের তাড়া খেয়ে সে ভারতে আসে। এখানে এসেও মানুষ মারায় কোনো বিরতি দেয়নি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই বাঘ। দিনেরাতে সবসময় বেমক্কা হামলা চালিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের একরকম গৃহবন্দি করে ফেলে সে।

এখানে কথাটা বলে নেয়া ভালো যে, পানারের মানুষখেকো বা চম্পাবতের বাঘিনী রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘের চেয়েও অনেকগুণ মানুষ মেরে ততটা কুখ্যাতি অর্জন করেনি; কারণ রুদ্রপ্রয়াগের সেই মদ্দা চিতাবাঘটি কেদারনাথ ও বদ্রিনাথে আসা যাওয়ার পথে আস্তানা গাঁড়ায় তীর্থযাত্রীদের মারফত তার কুকীর্তির প্রচার বেশি হয়, এবং তার সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। তাছাড়া তার শাসনকালও ছিল দীর্ঘ আটবছর।

জিম করবেটের গুলিতে ১৯১১ সালে প্রাণ হারায় চম্পাবতের বাঘিনী। স্থানীয় মানুষ এই ঘটনায় এতই খুশি হয়েছিল যে তারা করবেটকে রীতিমতো সাধু বলে সম্মান দেখানো শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সিরিয়াল কিলারও চম্পাবতের বাঘিনীর মতো এত মানুষ হত্যা করেনি।

চাতুর্য আর হিং¯্রতার কারণে চিতাবাঘের সুনাম আছে। যদিও এরা সচরাচর মানুষ মারে না, কিন্তু একবার মানুষখেকো হয়ে গেলে এদের সামলানো খুবই কঠিন। এরকম একটি উদাহরণ হলো পানারের মানুষখেকো চিতাবাঘ। ভারতের কুমায়ন জেলার পানার গ্রামের কাছাকাছি এই চিতাবাঘের মানুষ মারার হাত খড়ি হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। পরবর্তীকালে জিম করবেটের গুলিতে ১৯১০ সালে পানারের ত্রাস প্রাণ হারায়। তবে তা হলে কী হবে, সংখ্যার দিক থেকে মানুষ হত্যায় পানারের চিতাবাঘকে অন্য কোনো চিতাবাঘ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
যারা জিম করবেটের ‘ম্যানইটারস অব কুমায়ন’ (১৯৪৪), ‘দি ম্যান-ইটিং লেপার্ড অব রুদ্রপ্রয়াগ’ (১৯৪৭), ‘মাই ইন্ডিয়া’ (১৯৫২), ‘জাঙ্গল-লোর’ (১৯৫৩), ‘দি টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যানইটারস অব কুমায়ন’ (১৯৫৪), এবং কেনেথ অ্যান্ডারসনের ‘দিস ইজ দি জাঙ্গল’ (১৯৬৪), ‘দি টাইগার রোরস’ (১৯৬৭), ‘জাঙ্গলস লং এগো’ (১৯৭৬) প্রভৃতি বই পড়েননি, তারা এগুলো পড়ে ফেলুন এবং সংগ্রহে রাখুন।

Exit mobile version