হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

২০১৭ সালে ঢাকায় এসে আমি হাতিরঝিল এলাকা থেকে একটা বাচ্চা কুকুর কুড়িয়ে এনেছিলাম। ঘটনাটা কিছুটা আকস্মিকই বটে। আমার কুকুর পোষার কথা নয়। ঢাকায় স্বল্প সময়ের অবস্থানে একটা কুকুরের প্রতি মায়া জাগিয়ে তারপর সুদূর টরোন্টোতে পাড়ি দেয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।
হাতিরঝিলের লেকের ধারে বসে ছিলাম আমি ও আমার আইলটস ছাত্রী। বাসা থেকে সে মায়ের অনুমতিও নিয়ে ফেললো। তার মা নিজে আমার কাছে মেয়েটিকে নিয়ে এসে আইলটস পড়ানোর বিষয়টা আগেই পাকা করে গিয়েছিলেন। পড়া শেষ করে সে আমার কন্ঠে গান শুনতো।

সে দামি কোনো রেস্তরাঁয় খেতে এবং কেনাকাটা করতে পছন্দ করে।
যাইহোক, আমি আর ছাত্রী লেকের পাড়ে বসে গল্প করছিলাম। ক্যানেডা থেকে আনা কিছু গিফট দিলাম তাকে। এর মধ্যে ভালো একটা পারফিউম ছিলো। থেকে থেকে আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো একটা দৃশ্য দেখে। একটা ছোট্ট কুকুরছানা সাইডওয়াক ধরে খুব দ্রুত ছুটছে। ল্যাম্পোস্টের আলোয় দৃশ্যটা আমার মন কেড়ে নিলো। এমন সুন্দর বাচ্চাটা যে কোনো সময় মেইন রোডের কোনো গাড়ির তলায় পড়ে প্রাণ হারাতে পারে।

এমন ছোট্ট কিউট প্রাণী সহসাই নজরে পড়ে না। আমার অস্বস্তির কারণ, এটা যে কোনো মুহূর্তে কোনো গাড়ির তলায় পড়ে মরে যাবে। আমি আনমনা ছিলাম। এইসময় দুজন হিজড়া এসে হাত পাতলো। তারা টাকা না নিয়ে যাবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি বললাম, টাকা দিবো কিন্তু তোমরা আমাকে ওই বাচ্চাটা ধরে এনে দাও। ওরা বাচ্চাটা ধরে আনলো। আমার ছাত্রী সবকিছু দেখে কেমন বিহŸল হয়ে পড়লো। সে বিড়াল-প্রিয়, কুকুর-প্রিয় না। অস্ফুটস্বরে বললো, স্যার কুকুরটা আপনি নিলেন?
আমিও বিহ্বলতার মধ্যেই ছিলাম, নতুন একটা দায়িত্ব কাঁধে পড়লো বলে। ছোট্ট করে বললাম, হ্যাঁ।

পরদিন নিজেই একে গ্রুমিং করালাম, কৃমির অষুধ খাওয়ালাম।
প্রথমে ওর স্থান হলো আমার ড্রয়িং-কাম-ডাইনিংয়ে। নোংরা করে ফেলে বলে ওকে গ্যারেজে স্থানান্তর করলাম। সেখান থেকে প্রমোশন পেয়ে উইশবোনের স্থান হলো ছাদে। একটা বক্সের ঘর বানিয়ে দিলাম। আমি ওকে খাবার দিতে গেলে প্রায়ই সঙ্গী হয় ভাগ্নে রনির ছেলে ইহান, না হয় ছোটো ভাই ডিউর মেয়ে জায়না। ওদেরকে পেলে উইশবোন খেলায় মেতে ওঠে।
কিছুদিন পর আমার মনে হলো, উইশবোন হয়তো ছাদে তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছে। তাই মনস্থ করলাম, ওকে পুনরায় গ্যারেজে স্থানান্তর করব। সেইরাতে খুব শীত পড়েছিল। উইশবোনকে রাতেই নিয়ে এলাম আমার ঘরে। রাতটা সে ঘরেই কাটালো।

ইতোমধ্যে তাকে সবরকমের শট দিয়ে আনলাম ভেটেরিনারি হসপিটাল থেকে। ইঞ্জেকশন দেয়ার পর সে রাতে নেতিয়ে পড়ল। সম্ভবত সামান্য জ¦রও এসেছিল। আমি তাকে রাতে হালকা খাবার খাইয়ে আমার বিছানার পাশেই রাখলাম। ইতোমধ্যে তার জন্য প্যাকেট খাবার আর বেল্ট কিনে আনলাম কাঁটাবন থেকে।

দুদিন পর সকালে হঠাৎ আনলিশড হয়ে খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল উইশবোন। গেটের কাছে গিয়ে সে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে কোলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। যেতে দিলাম, কিছুটা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াক। আমি জানি, সে ফিরে আসবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, সে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরই সে ফিরে এলো। আমি ওর গলার বেল্টে দড়ি বাঁধলাম না। আবার তাকে যেতে দিলাম বাইরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কাজকারবার দেখছি। হঠাৎ দেখলাম উইশবোন এক দৌড়ে পুবদিকে আমাদের চার নাম্বার রাস্তার মাথায় চলে গেছে। পরমুহূর্তেই ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো আমার। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো দশাসই চেহারার একটি বড় কুকুর। সে এগিয়ে গিয়ে উইশবোনকে দেখলো। তখনও ভাবতে পারিনি কী ঘটতে চলেছে। হঠাৎ বড় হিং¯্র কুকুরটা উইশবোনের গলা কামড়ে ধরল। উইশবোনের তীক্ষè চিৎকারে আমার মাথা ঘুরে উঠল। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে কোলাপসিবল গেটের তালা খুলে গিয়ে উইশবোনকে জ্যান্ত ফিরে পাবো না। সেইসময় বড়পাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড, হঠাৎ উইশবোন ছুটে গিয়ে ঢুকে গেলো বিপরীত দিকের দুই বিল্ডিংয়ের সঙ্কীর্ণ চিপায়। আমি নেমে গিয়ে উইশবোনের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না, এমনকি কোনো সাড়াশব্দও পেলাম না। তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত পচা-আর্বজনার পাহাড় ডিঙিয়ে উইশবোনের খোঁজ করা সম্ভব হলো না। অগত্যা আমাদের বাসা থেকে সাংবাদিক এলাকার গেইট পর্যন্ত কয়েকবার উইশবোনের খোঁজ করলাম। রাতেও একবার খুঁজলাম। উইশবোন লাপাত্তা।
ততক্ষণে আমার বোধ হলো, হয়তো উইশবোন সাংঘাতিক আহত হয়ে নোংরা আবর্জনাময় অন্ধকার স্থানটাতে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। ভেতরটা কাঁটার মতো খচখচ করে উঠল। বড়পাকে জানালাম। বড়পা সান্ত¦না দিলেও আমার মন মানছিলো না। নিজকে অপরাধী লাগছিলো। হয়তো ওকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে কাজটা ভালো করিনি। দুর্ঘনাটা ঘটেছিল ১৪ জানুয়ারি ২০১৭। রাত বারোটার পর ১৪ তারিখ পার হয়ে ১৫ তারিখে পড়ল। আমার মন বলছিলোÑযদি উইশবোন ফিরে আসতো! রাতে কোনো কাজে মন বসছিলো না। সামান্য কোনো শব্দ শুনলে কান পাতি, এই বুঝি উইশবোন ফিরে এলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই হতাশ হইÑহয়তো উইশবোন মরে গেছে; আর বেঁচে থাকলেও একটা মারাত্মক আহত বাচ্চা কুকুর কোনো সাহায্য ছাড়া কীভাবে ফিরে আসবে?

অনেকরাত পর্যন্ত ওর আশায় জেগে রইলাম। মনে মনে বলছিলামÑউইশবোন আসবে, উইশবোন ফিরে আসবে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে রাত পৌনে তিনটায় বিছানায় পিঠ ঠেকালাম। চোখে ভাসছিলো সেই মর্মান্তিক দৃশ্যটি। কেবল চোখ লেগে এসেছিল, এইসময় একটা খসখস শব্দ শুনে কান খাড়া করলাম। পরে মনে হলো, পশ্চিমদিকে আমার বেডরুমের জানালার ধার ঘেঁষে খালি প্লটে গজিয়ে ওঠা মাঝারি গাছের পাতায় শব্দ উঠছে বাতাসে।

উঠে বসলাম। আবারও শব্দ হলো, মনে হলো কেউ যেন নক করছে আমার দরজায়। এবার উঠে দাঁড়ালাম, এবং পরক্ষণেই উইশবোনের ডাক শুনলাম। ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম উইশবোনকে! ওকে ভেতরে এনে গলায়-গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। এবং আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখলামÑওর গলায় ক্ষতের কোনো চিহ্নই নেই! আমার কল্পনায় দেখা উইশবোনের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত গলার সাথে এই উইশবোনের কোনো মিল নেই! মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম সৃষ্টিকর্তার দরবারে। ভেবে পেলাম না উইশবোনের অক্ষত থাকার কারণ। ওর গলায় আবারও হাত বুলাতে বুলাতে উত্তরটা খুঁজে পেলাম। উইশবোনের পিছল চামড়া ভেদ করে বড় কুকুরের দাঁত বসে যাবার আগেই উইশবোন ছুটে পালিয়েছিল।

হয়তো উইশবোন অনেকরাত পর্যন্ত বদ কুকুরটার চলে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো, কিংবা সে অন্যদিক থেকে বের হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলো। এই সম্ভাবনাটাই বেশি। কেননা, সে যেহেতু অক্ষত ছিল, তার তাড়াতাড়ি ফিরে আসাটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু পথ হারিয়েছিল বলে ফিরে আসতে তার দেরি হলো। যাইহোক, সে ফিরে এসেছে, এবং আমাকে মনোযাতনা থেকে রেহাই দিয়েছে-এ আমার পরম পাওয়া। উইশবোনের এই কাহিনি আমাদের বাসার সব সদস্যদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে, আর দিয়েছে স্বস্তি। ইহানের ধারণা হয়েছিলো উইশবোন মারা গেছে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল-উইশবোন এভাবে মরতে পারে না।

উইশবোন ছিলো দুরন্ত আর বাড়ছিলো অস্বাভাবিক হারে। কোলাপসিবল গেইটের ফাঁক দিয়ে তখন আর সে যেতে আসতে পারছিলো না। পাতলা লিশে কাজ হয়নি। ওর জন্য শেকল কিনতে হয়েছিলো।

ওর স্থান হলো আবার ছাদে, সে যথেষ্ট বড় তখন। এরপর সবচেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। একদিন ওর প্র¯্রাব করার ভঙ্গি দেখে আমি বুঝলাম উইশবোন আসলে মেয়ে কুকুর। আর আমি কেনোই বা ওকে ছেলে কুকুর ভেবে আসছিলাম তা বলতে পারবো না। সত্যি বলতে কি, আমি একটু নিরাশ হলাম। বোধহয় আমার বিশ^াসে আকস্মিক আঘাত আসার কারণেই।
নানা কাজে, লেখালেখিতে আর বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমি উইশবোনকে সময় দিতে পারছিলাম না। এদিকে সে এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকে মেজো আপা বিষয়টা মানতে পারছিলেন না। কুকুরটাকে সরাবার জন্য তিনি আমাকে অনবরত তাগাদা দিয়ে চললেন। এদিকে আমারও চলে যাবার সময় হয়ে গেলো। এক ভদ্রলোক কুকুরটি নিতে চাইলেন। আমি তার ফোন নাম্বার নিয়ে উইশবোনকে দিয়ে দিলাম।

এরপর তো ফিরে এলাম টরোন্টোতে। প্রায়ই উইশবোনের কথা মনে পড়তো। ২০১৮ সালে ফিরে ্এসে সেই ভদ্রলোকের ফোন নাম্বার খুঁজে পেলাম না।
উইশবোন যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে যেনো, এই কামনা করি।