হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
আজ একটা সত্য কথা বলার সৎসাহস করছি। কাউকে আঘাত করে বা উদ্দেশ্যমূলক কিছু বলছি না। কোনো ইঙ্গিতও করছি না। ডাউন টু আর্থ দৃষ্টিভঙ্গিতে কথাগুলো বলছি। আজকাল লেখক-অভিনয়শিল্পী বা কন্ঠশিল্পী কিংবা প্রতিভাধরদের মূল্যায়ন করা হয় সোশাল মাধ্যমে কে কীভাবে ভাইরাল হয়েছেন। ফেসবুকে বা অন্যান্য ইলেক্ট্রানিক মাধ্যমে যাদের বেশি ফলোয়ার্স থাকে বা ফ্রেন্ডস প্রাচূর্যে উপচে পড়াদের যে কোনো স্টেটাসে সব্বাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মিলিয়নস ভিউজ ও কমেন্টস থাকে। কেউ কেউ সেলিব্রিটি না হয়েও তাদের চেয়ে কম যান না। একপ্রকার সেলিব্রিটির মতোই তারা। এটা খারাপ কিছু না; বরং ভালো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা তাদের আছে।
পার্থক্যটা হলো এইসব ‘মিলিয়ন-ডলার’ ফেসবুকার, অ্যাক্স হ্যান্ডেল বা ইনস্ট্রাগ্রামধারীদের চেয়ে অনেকসময় একজন সাধারণ ফেসবুকার কখনও কখনও অনেক মূল্যবান স্টেটাস দেন। সেইসব কারুর নজরে পড়ে না বা হালে পানি পায় না।
সদ্যপ্রয়াত হুমায়রা হিমু’র চলে যাওয়াটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাকে আমি চিনি না কিন্তু জানি। আমি তার বড় কোনো ফ্যানও নই যে, পাহাড়সমান কষ্ট বুকে ধারণ করব। কষ্টের চেয়েও আক্ষেপ হচ্ছে বেশি, যখন অনলাইন পত্রিকায় তার একটা কথা পড়লাম। অনেকদিন তাকে কোনো নাটকে দেখা যায়নি। এপ্রসঙ্গে হুমায়রা হিমু বলেছিলেন, বেশি ভিউজ পড়ে না বলে পরিচালকেরা তাকে নেন না। হুমায়ারার কতটুকু প্রতিভা ছিল আমার জানা নেই। নাটক বা অভিনয় জগতের সাথে আমি জড়িত নই। কখনও ছিলাম না। সম্প্রতি টিভি স্ক্রিপ্ট লেখার ফরমায়েশ পেয়ে আমি ছোটো পর্দার নাটক দেখতে শুরু করি কিছু নির্মাণের কৌশল বুঝতে।
আমার উদ্দেশ্য হুমায়রা হিমু’র মৃত্যুরহস্য উদঘাটন, এই অপমৃত্যুকে ঘিরে থ্রিলার রচনা নয়। আমি এখানে সামাজিক অধঃপতন ও অপরাধ, দায়িত্বহীনতা ও উন্নাসিকতার কথা বলব। বেঁচে থাকতে কাউকে মূল্যায়ন করা হয় না; মৃত্যুর পর একজন তারকা, শিল্পী বা লেখক কিংবা প্রতিভাধর কেউ ব্যাপক টিভি কাভারেজ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন, বিশেষত অপমৃত্যুর ক্ষেত্রে। এটাই দেখে আসছি এই অবধি।
হিমু’র একজন ঘনিষ্ঠজন বলেছেন এই অভিনেত্রীর কিছু বাজে অভ্যেস ছিল। তিনি এটাও বলেছেন যে, এসব নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইত, কিন্তু এগিয়ে আসত না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
হুমায়রা ছিলেন ব্রোকেন ফ্যামিলির একজন। একা থাকতেন তিনি। ফ্রাস্ট্রেশন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। এরমধ্যে তিনি জড়িয়ে যান বিগো লাইভ-এর মতো অ্যাপে। কোনো কোনো অ্যাপের উপকারিতা বা বিনোদন থাকলেও কিছু অ্যাপ চরম অধঃপতন ডেকে আনে। আমন্ত্রণ জানায় খারাপ কাজে লিপ্ত হতে। আমার এক ছাত্রী ও মডেল সম্পর্কে কিছু কথা বলব আজ। সেই বিষয়ে আসছি।
শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, রুটিন জীবন ও সুন্দর লাইফস্টাইল তৈরি করে নিতে হয়। সমাজ সবসময়ই বৈরি, সমালোচনা ও ক্ষতি করা সমাজের কিছু মানুষের অন্যতম বিনোদন। সেসব উজিয়ে নিজেরভাবে চলে জীবন গড়ে নিতে হয়। হুমায়রা সেটা পারেননি।
আমার এই অপাঙতেয় জীবনে আমি দেখেছি ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরাই অধঃপতনে যায় বেশি। এখানে তাদেরকে যতটা না দোষারোপ করতে হয়, তার বেশি দোষ দিতে হয় তাদের পিতামাতাকে। আমি দেখেছি কীভাবে একটা মেয়ে তার মায়ের সামান্য রোজগারে চরম হতাশায় নিপতিত হয়। পিতা খোঁজ নেয় না মেয়ের। একের পর এক বিয়ে করে, আর ছোটোবেলায় আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া সেই মেয়েকে দেখে চিনতে পারে না!
আমার গানের দৃশ্যায়নের মডেল সেরকম পরিস্থিতিরই শিকার। আমি তাকে অর্থ দিয়ে, জামাকাপড় কিনে দিয়ে, পরীক্ষার ফি দিয়ে, অসংখ্যবার তাকে দামি রেস্তরাঁয় খাইয়ে তার মনোবল চাঙা রাখছিলাম। আসলে তার পিতামাতার স্থান তো আমি পূরণ করতে পারব না। একটা তরুণীর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে আমি সামাজিকভাবে অপারগ। তবুও সব ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ ছন্দপতন। তার মা অসুস্থ হয়ে গেলে সব গড়বড় হয়ে যায়।
পারিবারিকভাবে দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটনে পড়ে মেয়েটি একরোঁখা হয়ে যায়। আমি তাকে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে বললাম। কিছু খরচ আমার সাধ্যমতো আমি দিব, জানালাম। কিন্তু সে তলে তালে যে মাকড়সার মতো জাল তৈরি করছিল, আমার জানা ছিল না। সে বিগো লাইভ অ্যাপ, টিভি নাটক ও শর্টফিলমে জড়িয়ে যায়। সে যথেষ্ট সুন্দরী ও আমার স্পর্শে এসে অনেককিছু শিখেছে। সে তার বাবাকে অভিশাপ দিত, চোখের জল ফেলত। আমি তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে জেনেছি যে, ইতোমধ্যে সে চরম হতাশায় মায়ের সাথেও সম্পর্ক তার ভঙ্গুর। আমি শেষ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল, এবং অনেকটা নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেল।
একদিন সে আমার সাথে দেখা করে। বলল, তার মা এখন তার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এই বিষয়টিতে সে চরম বিরক্ত, যদিও সে তার মাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছিল দূর থেকে। এদিকে আমার মধ্যে প্রশ্ন জাগল, এত চাকচিক্য, দামি জামাকাপড়, লেটেস্ট মডেলের আইফোন সে কোথায় পেল।
আমি তাকে দোষ দিতে পারি না। দোষ দিচ্ছি আমাদের ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি মনে করি, আমার সাথে যোগাযোগ সে না-ই বা করল। সে বেঁচেবর্তে থাকুক, ভালো থাকুক- এটা আমি মনেপ্রাণে চাই।
হুমায়রার অকালে চলে যাওয়াটা বিপুল মিডিয়া কাভারেজ পেল কেমন করে। ওই যে বলে না ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।’ বিষয়টা তেমনি হুমায়রার হতাশায় সমব্যথী হয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। মরার পর বিপুল শোক-দুঃখ আর সমবেদনা প্রকাশে তার দূরের-কাছের মানুষেরা হামলে পড়লেন।
হুমায়ারার বলা কথাটার সূত্র ধরেই বলছি, নির্মাতারা ভিউজ দেখে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নেন! এটা সহজ সমীকরণ। কিন্তু একটু দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে অন্যভাবে দেখলে কেমন হয়? ভিউজ না পাওয়ার শুধু একটা কারণ নয়- একাধিক কারণ থাকতে পারে। নির্মাণ ভালো হয়নি বা স্টোরি দুর্বল কিংবা শর্টকাট অবলম্বন। অনেককিছুই হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে, নির্মাতারা বোঝেন কাকে কখন কোথায় নিতে হবে। এটা তো নির্মাণ। এখানে খরচাপাতির বিষয় আছে। খরচটা উঠে এসে লাভও থাকতে হবে। এটাই এখন চরম বাস্তবতা। কিন্তু আমার বিশ্বাস, প্রতিভাবান নির্মাতারা সবই পারেন। গল্পকে টুইস্টেড করে, নান্দনিক উপস্থাপনা ও শক্তিশালী চরিত্র দিয়ে যে নাটক সাধারণ মাপের হতো, তাকে অসাধারণ করে তুলতে পারেন বাড়তি বাজেট যোগ না করেও। একজন পড়তি অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রিক একটা চরিত্রে সফলভাবে উপস্থাপন করা যায় বলে আমি মনে করি।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, টিভি নাটক স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে আমি টিভি নাটক দেখতে থাকি। আমার লেখা নাটক টিভিতে প্রচারিত হলো। আরও ক’টি স্ক্রিপ্ট তৈরি করা আছে। দু’টি স্ক্রিপ্ট পাইপলাইনে আছে। টিভি নাটক দেখতে গিয়েই প্রথমবারের মতো জানলাম হুমায়রা হিমু একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী।
তার অকাল অপমৃত্যুকে ঘিরে এখন মিডিয়াতে অনেক আলোচনার ঝড় বইছে। অনেকে অনেক কথা বলছেন নানারকম তথ্য বেরিয়ে আসছে। কিন্তু হুমায়রা তো আর ফিরে আসবেন না।
হুমায়রা, পরপারে ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন।