হাসান জাহিদ: কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

“One moment on the lips, forever on the hips,” উদ্ধৃতিটি বিশ্বজুড়ে ফাস্টফুডের দৌরাত্ম বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। মজাদার, সহজে পরিবেশন ও ভক্ষণযোগ্য ফাস্টফুড যান্ত্রিক যুগের সাথে তাল মেলাবার জন্য খুব উপযোগী। তা সত্তে¡ও এর বহুবিধ নেতিবাচক দিক রয়েছে। আর এই কারণেই একে জাঙ্ক ফুড বলা হয়। অধিকাংশ ফাস্টফুডই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর যত্রতত্র ও যখন তখন খাওয়ার সুযোগ থাকায় এর সাথে মিলিত হয় জীবাণু। এইসব ফাস্টফুডে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট ও ব্যাকটেরিয়া। এই ফাস্টফুড নিয়ে Eric Schlosser (সাংবাদিক ও নন-ফিকশন লেখক)-এর লেখা Fast Food Nation: The Dark Side of the All-American Meal (2001) বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। বইটিতে লেখক ফাস্টফুডের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করেছেন।

ফাস্টফুড বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হলেও এটি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নয়। এর জনপ্রিয়তা অর্জনের আরেকটি মূল কারণ হলো এটি কম দামে কেনা যায়। স্ন্যাকবার বা ফুড স্ট্যান্ডেও এটি পাওয়া যায়। কোনো কোনো ফাস্টফুড চেইন বিশ্বজুড়ে আদৃত; ক্রেতারা সেখানে হ্যামবার্গার বা ফ্রাইড চিকেন কেনেন। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই কিছু প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড পাওয়া যায়, যেমন- ইতালীয় পিজা ও পাস্তা, মেক্সিকান টাকোস ও বারিটোস, মধ্যপ্রাচ্যীয় কাবাব ও ফ্যালাফ্যাল, জাপানি সুশি ও টেম্পোরা, চীনা এগরোলস ও নুডলস্, বাংলাদেশি সামোসা (সমুচা), সিঙ্গারা, হালিম কিংবা চটপটি। স্বাদের মাপকাঠিতে এগুলো অতি জনপ্রিয় আর অবশ্যই সহজলভ্যতা এসব খাদ্য জনপ্রিয় হবার অন্যতম কারণ।

দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণের রকমফের হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ও স্পন্দন, ওজন প্রভৃতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অধিক ফ্যাটযুক্ত খাবার হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে চলে। অনেকেই দিনের পর দিন ফাস্টফুড গ্রহণ করে ওবেসিটি’র শিকার হচ্ছেন। ওবেসিটি হচ্ছে এক ধরনের মেডিক্যাল কন্ডিশন যেখানে শরীরে দরকারের বেশি ফ্যাট জমে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং যা লাইফ এক্সপেক্টেন্সি কমিয়ে দেয়। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ফাস্টফুড অত্যন্ত জনপ্রিয়। মুখরোচক সামান্য পরিমাণ ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে রয়েছে লবণ, কার্বোহাইড্রেড ও ফ্লেভার। এমনিতেই এসব ব্লাড প্রেসার ও মেদ বৃদ্ধি করে থাকে। আবার অনেক লুকনো উপাদান থাকে ফাস্টফুডে, যা আমরা জানতে পারি না অনেকসময় বা জানার কোনো আগ্রহ বোধ করি না। ইন্টারনেটের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, বিশ্বখ্যাত একটি চেইন ফাস্টফুড ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরিতে যে ‘ন্যাচারাল ফ্লেভার’ প্রয়োগ করে তাতে নার্ভ ও মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর monosodium glutamate (MSG) থাকার সম্ভাবনা থাকে।
গেøাবাল ডায়েটারি চয়েস বা খাবার নির্বাচনের ধরনে ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে পুষ্টি ও খাদ্য গুণের। কারণ, সচেতন হচ্ছে মানুষ। যদিও একইসাথে খাদ্য বৈচিত্র্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীতে যে জিনিসটির ওপর সবচেয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট হয় সেটা হলো খাদ্য প্রস্তুত। কন্টিনেন্টাল ফুড প্রস্তুত হয় অন্য দেশ থেকে আগত অতিথিদের খাদ্যাভ্যাস, পছন্দ ও রুচির ওপর।
বিশ্বের সাধারণ রেস্তরাঁ থেকে শুরু করে পাঁচতারা, আন্তঃদেশীয় বা মহাদেশীয়- সব হোটেল-রেস্তরাঁর টার্গেট-অতিথি বা বোর্ডার রয়েছে। সুতরাং বিশ্বজুড়ে খাদ্য নির্বাচন ও প্রস্তুতি তথা রান্নার কায়দাকানুন বহুবিচিত্র। তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন, ব্যক্তিগত পছন্দ, আচার ও রান্নার স্টাইল বা রকমসকম এবং স্বাস্থ্যগত দিক, প্রভৃতি বিবেচনায় বিশ্বে বেড়ে চলেছে রান্নার প্রকারভেদ। সুতরাং বিশ্বজুড়ে খাদ্য নির্বাচন ও এর গতিপ্রকৃতি কোন্দিকে যাচ্ছে- স্বাস্থ্যের জন্য, গুণগত বা মানগতভাবে ভালো না মন্দ তা যাচাই করা দুঃসাধ্য। যারা বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন- যেমন ভেজিটারিয়ান বা যারা ডায়েট করেন নিয়মিত, তারা স্বাস্থ্যগত বা পুষ্টিগত দিক থেকে ভালো থাকেন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই তারা থাকুন না কেন। বাংলাদেশের মানুষ অধিক তেল, মশলা ও চর্বিযুক্ত খাবার খান। সাথে অনেকসময় যোগ হয় ফাস্টফুড।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, ইয়োরোপের দেশ বা ক্যানেডায় খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা ক্রমেই বাড়ছে। আর তাই গুরুত্ব বাড়ছে গ্লোবাল ফুড চয়েসের।
বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত? বিশেষত ক্যানেডায়? প্রথমত, ফাস্টফুড না খাওয়াই ভালো। দ্বিতীয়ত, এমনসব খাবার বেছে নেয়া উচিত যাতে প্রোটিন, মিনারেল, ভাইটামিন ডি ও সি আছে। আর পারতপক্ষে ঘরে রান্না করা খাবার খাওয়াই সমীচীন। তেল, চর্বি ও কোলেস্টেরল বাড়ায়, খাদ্যে এমন উপাদান না থাকাটা পুষ্টিকর ও সহজে হজম উপযোগী। ক্যানেডা যেহেতু প্রচণ্ড শীতের দেশ, তাই ঘাম কম হয়। অনেকে আবার শারীরিক পরিশ্রমও কম করেন; তাই দেশি শাকসব্জি বা স্থানীয় লেট্যুস, ব্রকোলি, টমেটো ও অন্যান্য ফলমূল প্রচুর পরিমাণে খাওয়া দরকার। বাংলাদেশের ট্রপিক্যাল আবহাওয়ায় অনেক খাবার (অবশ্যই ভেজালমুক্ত) সহজেই হজম হয়ে যায় আর বাড়তি মেদ ঝরে যায় ঘাম ও শারীরিক পরিশ্রমে। অতএব যারা হালকা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, তারা অবশ্যই অধিক পরিমাণ বিরিয়ানি, গোরুর মাংস ও মাখন-পনির পরিহার করবেন। আর খাদ্যে লবণ যত কম দেবেন, ততই মঙ্গল। এইসাথে একটা বিষয় স্মর্তব্য- অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ বা ডায়েটিংয়ের অজুহাতে একেবারেই কম খাওয়া ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। শরীরে যতটুকু ক্যালোরি বার্ন হয়, ততটুকু ক্যালোরিই শরীরকে দেয়া উচিত। আর এর পরিমাণ নির্ভর করে ব্যক্তিগত রুচি, অভ্যাস, আচার-আচরণ, ধর্মীয় অনুভূতি এবং শারীরিক ও মানসিক শ্রমের ওপর।