হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
জীবনের সব স্মৃতিই সুমধুর নয়; কিছু স্মৃতি থাকে তিক্ততার। তিক্ত স্মৃতি ছাপিয়ে শুধুমাত্র সুখপ্রদ স্মৃতি রোমন্থন করতে আমরা ভালোবাসি- অতীত ব্যর্থতা ছাইচাপা দিয়ে চেতন-অবচেতন মন থেকে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। এই উপলব্ধি আমি অনেকখানিই অর্জন করেছি আমার সদ্য তারুণ্যের শিক্ষাজীবন থেকে। শিক্ষা ও শৃঙ্খলা মানেই নটরডেম কলেজ- উন্নত পরিবেশ, সরস প্রথা আর স্নেহ-শাসনে মিশেল শিক্ষক ও উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
গাছপালার ভেতর দিয়ে ক্যান্টিনে যেতে কাব্য জেগে উঠত, বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে এসে জেগে উঠত গতি, বিশাল সকার মাঠে গিয়ে একের পর এক গোল দিতে সাধ জাগত।
আমার অতি শৈশবে নটরডেম কলেজের উঁচু পাঁচিল ঘেঁষা আরামবাগের যে সরুগলি, তার অপরপ্রান্তে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম আমরা। বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম উচ্চ দেয়াল ও দেয়ালের ওই পাশে বড়বড় গাছের দিকে। আমার পিতা কলেজের নাম বলতেন, কিন্তু আমি সেটা উচ্চারণ করতে পারতাম না। তখন এবং আরো অনেকটা বড় হওয়া পর্যন্ত ভাবিনি, শৈশবের রহস্যের দুর্গ আমার উঁচু শ্রেণীতে পড়ার বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠবে।
বর্ষপরিক্রমায় আমরা একে একে ভাড়া বাসা বদলে শেষে এসে ঠেকলাম গোপিবাগে। আমার এএসএসি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। সেটা ১৯৮০ সাল। আমার ভালো কোনো কলেজে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারে সবাই সন্দিহান ছিল। আমার মতো অমনোযোগী, কুঁড়ে ও কাব্যমনার কাছ থেকে কেউ ভালো কিছু আশা করেনি। কুঁড়েমি করছিলাম- শেষমুহূর্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম জমা দিলাম। যথাসময়ে রিটেন ও ভাইভা হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে চান্স পেয়ে গেলাম। আমার প্রয়াত ভগ্নিপতি প্রাক্তন রাজউক চেয়ারম্যান এস. এইচ. এম. আবুল বাশার আমাকে কলেজে ভর্তির টাকা দিলেন এবং একটা ঘড়ি কিনে দিলেন।
ততদিনে আমি কেউকেটা গোছের কেউ হয়ে গেছি। ধরাকে সরা জ্ঞান না করলেও খানিকটা নাক উঁচু প্রকৃতির হয়ে গেলাম; নটরডেম কলেজ বলে কথা। সেইসাথে ভাবছিলাম, নটরডেম কলেজ ফাদার পিশাতো (প্রয়াত) ও অনেক গুণবান শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর কলেজ- আমি তার যোগ্য কিনা। কিন্তু তারুণ্যের ধর্মই এমন যে, একটা বেপরোয়া ভাব জেগে ওঠে। কিছুদিন বাদে আমার হামবড়া ভাব ছুটে গেল। সাপ্তাহিক কুইজ ও নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজে কলেজে উপস্থিতির গুরুভারে আমার ভাব ছুটে গেল। একমাত্র নটরডেম কলেজের পক্ষেই সম্ভব একটা বেপথু ছাত্রকে হাড়মাস অবধি শিক্ষা দিয়ে ছাড়বার। এর অর্থ এই নয় যে, শিক্ষকরা খুব নির্দয় ও কড়া। বরং তারা বেশ সদয় ও বন্ধুভাবাপন্ন। মোদ্দা বিষয় হলো, কলেজের লিখিত ও অলিখত নিয়মাবলি। একদিন ফাদার বেনাস (পরলোকগত) আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিলেন। তিনি পড়িয়েছিলেন জন ডানের ‘ডেথ’ কবিতাটি:
‘Death, be not proud, though some have called thee
Mighty and dreadful, for thou art not so;
For those whom thou think’st thou dost overthrow
Die not, poor Death, nor yet canst thou kill me.’
ফাদার বেনাসের উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি বিমুগ্ধ হয়ে শুনলাম-দেখলাম। তার শুদ্ধ ইংরেজি শুনে মনে হতো- এমনভাবে যদি ইংরেজি বলতে পারতাম! আমার জন্ম যদি অ্যামেরিকায় হতো! পরবর্তীতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে জন ডানের ম্যাটাফিজিক্স পড়েছিলাম, তবে শিখেছিলাম কিনা জানি না। গর্ব করতাম এই ভেবে যে, প্রথমে নটরডেম কলেজ, তারপর ঢা.বি. এর ইংরেজি বিভাগ! হয়তো মানুষ হয়ে জন্মানোটা সার্থক হলো।
ঢা.বি.তে এসে এবং পরবর্তী জীবনে অনেক স্মৃতির ভিড়ে কেবল ভেসে উঠত নটরডেম কলেজ আর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যা প্রতিষ্ঠানের কথা। আবেগ দলা পাকাত গলার কাছে। আজও যখন নটরডেম কলেজের পাশ দিয়ে যাই, তখন অপলক তাকিয়ে থাকি কলেজটার দিকে। আসাদগেটে গেলে তাকিয়ে থাকি আমার ছেলের স্কুল সেন্ট জোসেফের দিকে। কত সহস্রবার একটা কচি হাত ধরে এই স্কুলটিতে ওকে পৌঁছে দিতাম, নিয়ে আসতাম সুইট হোমে!
একটা বিশেষ স্মৃতি ছিল: শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুদর্শন মুখতার আহমেদ বাংলা ভাবসম্প্রসারণের অ্যাসাইনমেন্টে আমার বাংলা ভাষা জ্ঞানের উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করেছিলেন ক্লাসে। সেই প্রশংসাবাণী বহুকাল আমার মনে অনুরণন তুলে ছিল।
সবচাইতে সুখকর ও অ্যাডভেঞ্চারাস স্মৃতি ছিল আমাদের কক্সবাজার সফর। সেই স্মৃতি মনে আজও দাগ কেটে আছে। আমার ফোর্থ সাবজেক্ট ছিল জিয়োগ্রাফি। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা কক্সবাজারে এক্সকারসনে যাব। শ্রদ্ধেয় পরলোকগত শিক্ষক অমূল্য বিশ^াস ছিলেন দলনেতা। সাথে ছিলেন অতুলদা ও আরো একজন। চট্টগ্রামের ট্রেনে উঠেছিলাম। রাত বারোটার পর ভৈরব জংশনে ট্রেন থেমেছিল ক্ষণিকের জন্য। তখন শুনলাম সেই হৃদয় উজাড় করা গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আমরা ২০ ফেব্রুয়ারি সম্ভবত রাত দশটার ট্রেনে উঠেছিলাম। তাই রাত বারোটার পর মহান একুশে।
চারদিক নীরব, রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে যেন উপলব্ধি ও আর্তির মধ্যবর্তী কোনো অজানালোক থেকে ভেসে এলো সেই মায়াবী সুর। আমার নির্ঘুম অস্তিত্ব সহসা গৃহকাতর হয়ে উঠল। আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো জেগে থাকা কয়েকজন বন্ধু’র দুষ্টুমিপূর্ণ আলাপচারিতায়। শিক্ষক অমূল্য বিশ^াস তার ল²ী-ট্যাঁরা নির্ঘুম চোখ দিয়ে ছেলেদের দুষ্টুমি দেখছিলেন। দুই ঠোঁটের কোণে তার মৃদু হাসি।
চট্টগ্রামের দামপাড়ায় আমরা বন্ধু বাবু’র বাসায় উঠলাম। সারাদিন ঘুরলাম ও চট্টগ্রাম নৌবন্দর দেখলাম। বন্ধু’র বাড়িতে একরাত কাটালাম। সকালে রওনা দিলাম বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশে। বাসে ঝিমোতে লাগলাম। রাতে আমার ঘুম হয়নি। আমাদের বন্ধুদের কয়েকজন ব্যস্ত ছিল অন্য ঘুমন্ত বন্ধুদের কাপড় এলোমেলো করার কাজে…।
কক্সবাজার এসে আমরা হোটেল-মোটেল বা রিসোর্ট পাইনি। পরে আমাদের স্থান হলো আনসার ক্যাম্পে।
দেয়ালে হেলান দিয়ে অনেক রাতে গান করছিলাম আপনমনে। দেখি আমার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে বন্ধু পাবলো (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী)। শ্রোতা পেয়ে আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে গাইলাম- ‘তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিণী…।’ বন্ধু বলল, ‘ভালোই তো গাইলে।’
তন্দ্রা ও জাগরণের মধ্যে বারবার শুনছিলাম অদ্ভুত শব্দ। ঢেউ ও ঝাউবনের মধ্য দিয়ে কেটে আসা বাতাসের শব্দ। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম দুই নদী- গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানেই কালের গর্ভে গড়ে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ আমাদের বাংলাদেশ।
…মন কেমন করে উঠল। জীবনে প্রথম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসা। প্রকৃতির বিস্ময় বঙ্গোপসাগরকে নিজ চোখে দেখা, এর সুবিশাল পরিধির একপ্রান্তে এসে তার নোনাজলের স্বাদ নেয়া ও অবগাহন করা। আমার ক্যামেরা ছিল না। বন্ধু সাগর ও নতুকে বললাম ছবি তুলে দিতে। ওরা তুলে দিল ছবি। নয়ন আমাকে জিজ্ঞেস করল যে, আমি বার্মিজ দোকানে যাব কিনা। খুব বেশি কিছু কেনাকাটার মতো পয়সা আমার ছিল না। তাই দলবল সহ যাইনি। একা গিয়েছিলাম। পরে সৈকতের দোকান থেকে ঝিনুকসামগ্রী কিনলাম, জ্যান্ত স্টারফিশ কুড়ালাম। স্নান করলাম সমুদ্রজলে। আমি সাঁতার জানতাম, তবে সমুদ্রের উথলে পড়া ঢেউয়ে সাঁতার জানা ও না জানা কোনো পার্থক্য বহন করে না। তাই বোকা অ্যাডভেঞ্চারার হইনি। অন্যরাও হয়নি। তীক্ষè নজর ছিল আমাদের শিক্ষকের।
কামনা করি, মিনতি জানাই- প্রকৃতির বিস্ময় এই উপসাগর যেন আরো দূষিত না হয়। এর ইকোসিস্টেম যেন ভেঙে না পড়ে অতি দূষণ, আহরণ ও আনসাস্টেইনেবল মনুষ্য কর্মকাণ্ডে। বিশালত্ব ও সৌন্দর্য যেন না হারায় আমাদের উপসাগর।
আমরা ফিরে এসেছিলাম একটা সুখকর অনূভূতি নিয়ে, অনেক অজানাকে জেনে।
…মনে পড়ে সেই গানটির কথা-‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি কই আগের মতো বাজে না…।’ বাঁশি যে বাজে না আগের মতো!
শেষ করছি, হারুকি মুরাকামির একটা উদ্ধৃতি দিয়ে-
“Memories warm you up from the inside. But they also tear you apart.”