হাসান জাহিদ: কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমাদের কানাডায় আগমণের প্রথম দিকের কথা বলছি।
আমরা কানাডায় এসে খানদানি শীত বলতে যা বোঝায় সেটা পাইনি। পেয়েছি কনকনে ঠান্ডা আর বৃষ্টি। তুষারপাতও দেখেছিলাম কিছুটা। সেটা ছিল এপ্রিল মাস। তারপর থেকে তো গরম পড়তে লাগল। মে, জুন, জুলাই আর অগাস্ট- এই চারটি মাস গরমে কেটেছে। একেবারে বাংলাদেশের মতো আবহাওয়া। সেই সময় সামারে ভালোই গরম পড়ত টরন্টোতে। বাংলাদেশের গন্ধ পেতাম? মনে হতো গাছে গাছে আম-কাঁঠাল পেকেছে। ইচ্ছে করে একাকী দিগি¦দিক ঘুরতাম, আর মনে করতাম বাংলাদেশেই আছি। দূর থেকে কিছু কিছু গাছকে আমগাছের মতোই লাগত। অবাক হতাম দেখে যে, টরোন্টো এতো সবুজ!

সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হলো ঠান্ডা। ডিসেম্বরের শেষে ভোরের দিকে তাপমাত্রা মাইনাস ৬ বা সাত হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের আগমনের পর প্রথমবারের মতো কানাডীয় শীতের স্পর্শ পেলাম। বৃষ্টিও হচ্ছিল। তবে, মাঝেমধ্যে তাপমাত্রা একলাফে উঠে যাচ্ছিল ৯-১০-এ। সেইসাথে সূর্যের দেখাও মিলছিল।

আমরা কানাডায় পদার্পণ করে প্রথমে মিসিসগায় আমার স্ত্রী’র খালার বাসায় উঠেছিলাম। সেখানে ১০-১২ দিন অবস্থানের পর আমরা সেভেন ক্রেসেন্ট প্লেসের একটা অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠলাম।

তাপমাত্রা যা-ই থাকুক না কেন, বাতাসটা কিন্তু থামে না! এমনি হাওয়া যে মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম চারপাশে বরফ জমে আছে। ক্রেসেন্ট প্লেসে আসার পর স্লো-ফল দেখলাম? ১৭ ডিসেম্বর কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার সময়। শুরু হয়ে গেছে তবে তুষারপাত। তাপমাত্রা মাইনাস ২ থেকে মাইনাস ৬ পর্যন্ত ওঠানামা করছে। সেই বছর? সম্ভবত ২০১২ সাল? আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেককেই নানা কথা বলতে শুনলাম। মাইনাস ৬ বা ৭ থেকে হঠাৎ প্লাস ৯-এ উর্ধ্বগমন এবং তারপরেই মাইনাস ২-এ অধঃপতন-এরকমটা নাকি হয় না। ইন্টারনেটে দেখলাম এদেশীয় এক কøাইমেটলজিস্ট বলেছেন যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস করাটা দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞের এই কথাটা কি বিজ্ঞানীদের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও আবহাওয়া পরিবর্তন থিয়োরির সত্যতা প্রমাণ করছে?

হিসেব অনুযায়ী পুরোপুরি শীত পড়ার মাস ডিসেম্বর। আসল শীতটা নাকি জাঁকিয়ে বসে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই। আসল শীতটা কী? অস্থিমজ্জা জমে যাবার ঠান্ডা আর ক’দিন বাদেই পড়তে যাচ্ছে।

মিসিসগার খালা-মামা গং আমাদের নতুন বাসায় বেড়াতে এসে বাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, এরকম হলুদ আলো মন খারাপ করে দেয়। তোমরা বাল্ব বদলে ফেলো। তারা বললেন কুলহোয়াইট বাতি কিনতে। এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ চলে এলো। আমরা যে প্রতিমুহূর্তেই নাড়ির টানে পাক খাচ্ছি, সেটা আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রায় পদে পদে উপলব্ধি করছি। বাইরের বরফ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতি মন উতলা করে তোলে। দেশের মায়াবী আবহাওয়ার মাঝে ফিরে যেতে চায় বিবাগী মন। আমকাঁঠালের দিনে ঝিঁঝিঁ পোকার কলতান শুনতে কান হা-হুতাশ করে। প্রকৃতির মতো যদি ঘরের আবহটাও এরকম বিষণœ থাকে, মন মানে না তখন। অনেকের কাছেই শুনেছি, যখন চারিদিকে কেবল বরফ আর বরফ থাকে, তখন নাকি মন খারাপ হয়। হয়তো হয়। জাপানে থাকাকালিন এরকম বরফের আবরণ দেখেছি প্রকৃতিজুড়ে, ছুটে বেরিয়েছি বরফের ওপর দিয়ে। তখন মন খারাপ হবার ফুরসত হয়নি। ট্রেনিং-এর ঠ্যালায় মন খারাপ হবার উপায় ছিল না।

একটা দিনের কথা মনে আছে। আমরা হিরোশিমা থেকে টোকিও যাব বুলেট ট্রেনে চেপে। আমাদের আবাসস্থল থেকে বাসে চেপে সাইজু রেলস্টেশনে এলাম। সেখান থেকে কানাডার সাবওয়ে ট্রেনের মতো ট্রেনে চেপে বুলেট ট্রেনের বড় স্টেশনে এলাম। এরা বলে শিঙ্কানশেন। প্ল্যাটফরমে এসে বুলেট ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম ট্রেনের লাইনগুলো সব ঢেকে গেছে ঝকঝকে সাদা বরফে। এদিকে আবার সেদিন ছিল সূর্যের সোনালি আলো। মন খারাপের সুযোগ আর রইল না। বরং বুলেট ট্রেনে চাপবার আনন্দ, টোকিও দেখার উত্তেজনা, টোকিওতে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ইলেক্ট্রনিক মার্কেট ‘আকিহাবারা’তে ইলেক্ট্রনিকসামগ্রী কেনাকাটার অদম্য বাসনাতে উল্টো ফুর্তিতে ভরে উঠেছিল মন। তবে, হিরোশিমা-টোকিও-ওসাকা, যেখানেই থেকেছি- একান্ত কক্ষে বসে দেশের কথা, আপনজনদের কথা মনে পড়ত বৈকি। মনও খারাপ হতো, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হতো না; কেননা জানতাম যে, ফিরে যাচ্ছি নিজ বাসভূমে। হিরোশিমায় আমাদের সেন্টারে আমার কক্ষে এক ছুটির সকালে উঠে সøাইডিং দরজা খুলতে পারছিলাম না। আমার বারান্দাজুড়ে বরফ জমে গিয়ে এই দশা হয়েছিল। পরে বেলা বাড়লে আস্তে আস্তে বরফ গলে গেল। মন খারাপের অবকাশ পেতাম না। পাছে ছুটির সময়টা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, সেই ভয়ে চটপট নাশতা সেরে রাজ্যের সব মুভির সিডি নিয়ে এসে বসে পড়তাম একের পর এক মুভি দেখতে। বিকেলে ছুটতাম শপিং করতে। সন্ধ্যে বা রাতে বাসায় ছেলে শাহদিব ও স্ত্রী সেতুর সাথে কথা বলার কাজটা সারতাম। দুইদিনের ছুটিটা মোটামুটি এরকমই কাটত।

দুধের মতো সাদা বাল্ব কিনে আনলাম। বেডরুম, ড্রয়িংরুম আর প্যাসেজে সেই সাদা এনার্জি বাতিগুলো লাগালাম। শাহদিবের রুমের বাতিগুলো সবচেয়ে নিষ্প্রভ। পাণ্ডুর রোগীর মতো। কিন্তু শাহদিব কুলহোয়াইট বাতি পছন্দ করল না। ওর নাকি এমন কম আলোই ভালো লাগে!
জানি না, কুলহোয়াইট বাতিতে মনটা কুল থাকবে কিনা, আর মন খারাপ দূর হবে কিনা।
ভাবছিলাম, স্বপ্নের উড়োজাহাজটা উড়ছে? কোথায় গিয়ে থামবে, জানি না।