হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

বদলে যাওয়া সময়

সময় সত্যিই বদলে গেছে। বৈশ্বিক, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে। অনেক বদলে গেছে সময় সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের তুলনায়। শূন্য দশকে এসে পৃথিবীর মানুষ যেন শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর আমি নিজে রয়েছি এক ঘোরের জগতে। প্রায়ই ভুলে যাই বার ও তারিখ। কেননা, আমি এখন কক্ষচ্যুত মানব। আসলে আমি এক আজব টাইম ম্যাশিনে আসীন আর সেই টাইম ম্যাশিন যেন পৃথিবী থেকে লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূরে। সেই টাইম ম্যাশিনে বসে আমার বর্তমানটা রূপ নিয়েছে অতীতে। তাই বর্তমানে যা ঘটছে, তা মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায় আমার কাছে। তাই ভুলে যাই দিন তারিখ, গুলিয়ে যাচ্ছে বর্তমান ও অতীত।

বহুদিন হয়ে গেল ক্যানেডা থেকে এসেছি। এখন মনে হয়, কখনই আমি ছিলাম না টরোন্টো নামের এক শহরে। সেখানে জীবনযাপনের প্রায় চোদ্দটি বছর আমার চেতনা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এরকম কোনো জীবন আমার ছিল না কখনও। বিয়ের পরের ক’টি বছর, বিশেষভাবে শান্তিনগর ও মোহাম্মদপুরের বাসায় অবস্থানই চেতনাজুড়ে বিরাজ করছে। শান্তিনগরের ছিমছাম নিরালা বাসায় ছোট্ট শাহদিব ও তার মাকে নিয়ে দিনযাপন আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল।

ক্যানেডায় এসে একটা সময় নিজকে খুব অসহায় মনে হতো। আর তাতে ঘৃতাহুতি দিত আমার স্ত্রী। সত্যিই, আমি কেমন করে এতটা ক্ষয়িত হয়ে গিয়েছিলাম, আমি কখনও জানতে পারিনি আগে। এখন জানি, তবে এই জানার কোনো মূল্য নেই। স্ত্রী’র দোষটা একটু বলি। সে সবসময় কিছু একটা করার জন্য তাগাদা দিত। সেটা আমার ভালো লাগত না। ঢাকায় আমি ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ; টরোন্টোতে এসে মনে হলো বন্দিপাখির জীবন। আর তোতাপাখির মতো গতানুগতিক বুলি আওড়ে যেতে হতো। কেননা. ক্যানেডীয় জীবন যাপন করতে গেলে তোতাপাখি বনতেই হবে। আসলে দোষটা আমার স্ত্রী’র নয়- অকপটে স্বীকার করছি। স্ত্রী যেসব কথাগুলো বলত, বাস্তবের নিরিখে তা যুক্তিযুক্ত। আসলে আমি মন থেকে অনেককিছু মেনে নিতে পারিনি। আমি প্রখর বাস্তবাদী ও দূরদর্শী কখনই ছিলাম না। সেই ধাত আমার এখনও আছে। তাই ব্যাবাক দোষ বেচারা স্ত্রী’র ওপর চাপিয়ে দিলাম।

আমি লম্বা সময় ধরে বিচরণ করছি ঢাকা শহরে। হয়তো জীবনের তাগিদেই এই জীবনযাত্রা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমি সেই আগের মতোই-কোথাও আমার কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। তবে আমার ভেতরে অনেক উলোটপালট হয়ে গিয়েছে। আমি নিজকেই এখন চিনতে পারি না। আমার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট আর গন্তব্য অনিশ্চিত।

কিন্তু ভেতরে আশা জাগিয়ে রেখেছি এখনও। সেই আশা হলো কিছু অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে যাওয়া। একটি জীবনে লেখালেখি বিষয়ে অসমাপ্ত কাজের তালিকা অনেক দীর্ঘ আমার। এক জীবনে সবকিছু সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। মানুষের অন্যতম চাারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো অপূর্ণতাবোধ। প্রতিটি মানুষই অপূর্ণতা নিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করে। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই সাধ্যের ভেতরে কিছু স্মারক রেখে যেতে চাই। তার অন্যতম হলো লেখা-লেখা-লেখা। আরেকটি হলো, কিছু গান নিয়ে (মৌলিক ও অন্য বিখ্যাত শিল্পীর গাওয়া কিছু গান) একটি অ্যালবাম প্রকাশ করব। আশা করছি শেষ করে যেতে পারব।

আমার অন্য একটি উদ্দেশ্য আরো কিছু সরস সাহিত্য (গল্প ও উপন্যাস) সৃষ্টি করা। সেই লক্ষ্যে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। মানসিক প্রস্তুতির কথা বললাম এজন্য যে, আমি সর্বক্ষণ তাড়িত হচ্ছি বদলে যাওয়া সময়ের বুলডোজারের নিষ্পেষণে। মানুষকে টিকে থাকতে হয় পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে লড়ে। আমিও টিকে আছি সেভাবে, কিন্তু ধারণ ক্ষমতা সব মানুষের সমান নয়। আর আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে আমি যেন অতিমাত্রায় পরিস্থিতির শিকার।
আসলে কিছু একটা আমার মনে প্রচ্ছন্ন ছিল। কেন যেন টাউনহল আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অথচ মোহাম্মদপুরে অবস্থানকালে সেখানে আমার বড় তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না বাজার আর কেনাকাটা করা ছাড়া। ক্যানেডায় অভিবাসী হবার পর আমি কয়েকবারই ঢাকায় এসেছি এবং আমি টাউনহলে গিয়েছি একাধিকবার। কোনো চেনা লোকের সাথে দেখা করতে নয়-কিছু একটার খোঁজে। টাউনহলের শতাব্দী পুরোনো ইমারতের নিচে এক রহস্যময় লোক তাবিজ, অষ্টধাতুর রিং, ব্রেসলেট, চেইন, পাথর ও পাথরের আংটি বিক্রি করে। রাজিয়া সুলতানা রোডের বাসায় থাকতে আমি একটা অষ্টধাতুর ব্রেসলেট কিনেছিলাম লোকটার কাছে। কেন যেন মনে হতো লোকটা রহস্যময়-যেন এই জগতের লোক নয়। তার পসরা সাজিয়ে বসার অন্ধকার স্থানটা তাকে আরও রহস্যময় করে তুলত।

স্মৃতির সেন্ট যোসেফ: ভেতরে তোলপাড় ওঠার কারণ সেন্ট যোসেফ স্কুল। তখন স্কুল ছুটি হয়েছে। দুয়েকজন ছাত্র রাস্তা পার হচ্ছে বা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে। সেই আগের ড্রেস-অ্যাশ কালার প্যান্ট, সাদা শার্ট। শার্টের বুকে স্কুলের লোগো। আগে স্কুল ছুটির পর শাহদিবকে নিতে এসে সব ছেলের ভিড়ে ওকে চেনা মুশকিল হতো। দূর থেকে সবাইকে একই রকম লাগত।

…জ্যাম থাকায় আটকে পড়ে বেশ ভালো করে স্কুলটাকে, স্মৃতির জায়গাটকে দুইচোখ ভরে দেখলাম। জায়গাটা সেরকমই আছে। প্রশস্ত ফুটপাথ ও রাস্তা, বড়গাছে ছাওয়া আর পরপর কয়েকটি স্কুল-কলেজ-ইউনিভাসিটি। সব আগের মতো। শুধু সেই সময়টা নেই।
আমি অতি কল্পনায় আক্রান্ত হলাম। মনে হলো, বাবুকে স্কুল থেকে নিতে এসেছি। ওকে নিয়ে ছিমছাম বাসাটায় গিয়ে ওকে ভাত বেড়ে দেব। ওর মা তখন কলেজে। ওকে খাইয়ে আমি খাব এবং বিশ্রাম করব। ও কম্পিউটারে বসে গেম খেলবে। হায়রে সেই দিন! আমার মনে হলো, টরোন্টোতে মাঝখানের কয়েকটি বছর মিথ্যে। আমরা কোনোদিনই সেখানে ছিলাম না। এখন যা দেখছি, তা-ই সত্যি। আমি ফিরছি রাজিয়া সুলতানা রোডের বাসায়…।
টাউনহল বাজারের সামনের পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে আমি গেলাম থামের সাথে ঘেঁষে বসা লোকটার কাছে। তার গালে কাঁচাপাকা দাড়ি দেখলাম। আগে দাড়ি ছিল না। শ্যামলা ছোটখাটো অতি সাধারণ একটা মানুষ। তার কাছে অষ্টধাতুর একটা আংটি চাইলাম। যেটা সে আমাকে দেখাল, সেটা পছন্দ হলো এবং কিনলাম। তারপর আমার নজর গেল নানা পাথর বসানো আংটির দিকে। আগে সেসব দেখেও দেখতাম না। আমার ধারণা ছিল, সেসব নকল পাথর। কিন্তু এবার আমি ক্যাটস আই’র খোঁজ করলাম। লোকটা জানতে চাইল এটি রাশির পাথর কিনা। জানালাম যে, রাশির পাথর। সে জানাল, রাশির বাইরের পাথর হলে সে আমাকে একটা ভালো পাথর দিতে পারে- সেটা হলো টাইগার স্টোন। সে টাইগার স্টোন বসানো রিং দেখাল। পাথরটা ভালো করে দেখে মনে হলো বাঘের জ্যান্ত চোখ যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। স্টোনটার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দেখে লোকটা আমাকে সেটা নিতে বলল। দাম জিজ্ঞেস করলাম। দাম শুনে ইতস্তত করলাম। আসলে সেই মুহূর্তে বেশি টাকা ছিল না পকেটে। লোকটা পাথর নিয়ে যেতে বলল আমাকে। বাকি টাকা পরে দিলেও চলবে। মনে হলো, আমাকে সে ঠিক চিনতে না পারলেও হয়তো আমার অবয়ব তার অবচেতন মনে চিত্রায়িত ছিল। আমি দ্বিরুক্তি না করে টাইগার স্টোন পাথরের রিং নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

লোকটার কথা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে বলছিল-এটা পাওয়ার স্টোন। শক্তি যোগায় আর তরুণদের তুলনায় একটু বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে।
পাথর আসল না নকল তা যাচাই করার পদ্ধতি আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, যেকোনো আসল পাথরের মধ্যে মসৃণতা ও ঔজ্জল্য থাকে। এক্ষেত্রে জ্যান্ত কথাটা ব্যবহৃত হয়। দেখলাম, পাথরটা মসৃণ এবং জ্যান্ত। তারপর ইন্টারনেটে দেখলাম এর গুণাগুণ। লোকটা যা বলেছিল মিলে গেল। পাথরটার ছবি ইন্টারনেটে দেখলাম। আমার পাথরটার সাথে মিলে গেল এবং নিঃসন্দেহ হলাম।

এখন একটু বলি, রাশির পাথর বলতে লোকটা কী বুঝিয়েছিল। রাশির পাথর হলো সেই পাথর যা কারুর রাশি অনুযায়ী পরতে হয়। যেমন, ক্যাটস আই হলো তুলারাশির জাতকের জন্য। আমার রাশি বুঝে আমাকে ক্যাট’স আই পাথর নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার আপন খালাতো ভাই শাহরিয়ার ভাইজান। আমি যখন প্রথম নেপাল ভ্রমণ করেছিলাম, সেইসময় কাঠমাণ্ডুর থ্যামেল এলাকা থেকে আমি একটা ক্যাট’স আই কিনেছিলাম। সেটা জ্যান্ত ছিল, কেননা শাহরিয়ার ভাইজান নিজে পরীক্ষা করে কথাটা বলেছিলেন আমাকে। তাছাড়া, ওটা নকল হবার কথা নয়-অনেক দাম দিয়ে পাথরটা কিনেছিলাম অভিজাত পাথরের দোকান থেকে।

ফিরে আসি বর্তমানে। সাফল্য যে একেবারেই নেই তা নয়। কোভিড-১৯ এর পিক সময়টার অধিকাংশ সময় টরোন্টোতে ব্যস্ত থেকেছি একটা উপন্যাস রচনায়। যার নাম ‘ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস’, আর এই উপন্যাস রচনার কথা ‘বালুকা বেলা’ কলামে বলেছি ইতোমধ্যেই। পাশাপাশি এর ইংরেজি অনুবাদও শুরু করলাম। তারপর ঢাকায় এসে পুরো অনুবাদ শেষ করলাম।

২০২০ সালে রচনা করলাম জলবায়ু বিষয়ে পাণ্ডুলিপি। ২০২০-২০২১ সাল জলবায়ু পাণ্ডুলিপি নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম; সময় যায় আর সাথে সাথে এর আপডেট করার কাজ করতাম। কেননা, ২০১৯-২০২২ সময়ে জলবায়ু সম্পর্কিত অন্তত তিনটি কপ সম্মেলন (কনফারেন্স অব পার্টিজ) অনুষ্ঠিত হয়। যে প্রকাশক এই গ্রন্থের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন. তিনি ২০২১ সালে প্রচ্ছদ তৈরি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষাবধি তিনি বই প্রকাশ করেননি। ২০২২ সালে দু’টি প্রকাশনা সংস্থা আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আমার অক্লান্ত শ্রমের পাণ্ডুলিপির যথাযথ মর্ম তারা বুঝবে কিনা।
অবশেষে এগিয়ে এলো অক্ষরবৃত্ত। তারা এই গ্রন্থের জন্য আমাকে পুরস্কৃতও করল। অনেক প্রতীক্ষার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি বই এলো মেলায়। আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে গেলাম। তার ওপর বইমেলায় বোমা নিক্ষেপের হুমকি ছিল একটা চরমপন্থী দলের। তোয়াক্কা করিনি।

খুব মানসম্মত ছাপা। কভারের লেখাগুলো উঁচু অক্ষরের। খুশিতে মন ভরে গেলো। মৌমাছি যখন মধু’র গন্ধ পায়, উড়ে এসে বসে ফুলে। তেমনি আমার দুইজন কাছের লোক (একজন আমার অনেক সিনিয়র, অন্যজন বয়সে আমার বেশ ছোটো। সে সস্ত্রীক এলো)। ইতোমধ্যে কয়েকজনের ফোন পেলাম। আমি বসে গেলাম অটোগ্রাফ দিতে। ফোনে যথাযথ সাড়া দিতে পারিনি; সময় ছিল না। শেষমুহূর্তে মেলায় ঢুকেছিলাম। পরদিনই অনেক ফিডব্যাক পেলাম। চট্টগ্রাম থেকে স্নেহভাজন হিমাদ্রী (নাট্যনির্মাতা) চট্টগ্রাম বইমেলা থেকে আমার বই কিনে ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জারে পাঠাল।

কিছু সুখস্মৃতি জমা হয়ে গেল মনের গহিনে। তবে হতাশায়ও ভুগেছি। অনেকে মেলার শুরু থেকেই বইটা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল। আমি জানাতে পারিনি বই টা মেলায় আসবে কবে। যাইহোক, যার শেষ ভালো তো সব ভালো।