হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের নয়া চ্যালেঞ্জ আর জলবায়ু পরিবর্তন নিরসনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যপ্তমান অনৈক্য। আশা করা গিয়েছিল গ্লাসগো সম্মেলনে আশাজাগানিয়া কিছু হবে; কিন্তু বিশ^বাসী কোনো আশার আলো দেখতে পেল না এই সম্মেলনেও।

২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, এবারের সম্মেলনে এটিকে আরও জোরদার করার কোনো বিকল্প ছিল না। তা সত্তে¡ও সম্মেলনে যুগান্তকারী কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিশে^র প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছ থেকে কার্বন কমানোর জোরালো ও সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি কিন্তু এই সম্মেলনেও পাওয়া যায়নি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই সম্মেলনে একটি রুল বুক প্রণীত হয়েছে। আর এই রুল বুকের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিশ্রুতিগুলো খতিয়ে দেখবেন বিশেষজ্ঞরা!

কপ-২৬ (কনফারেন্স অব পার্টিজ)এর মূল লক্ষ্য ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার আশা বাঁচিয়ে রাখা, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হলেও এটা কীভাবে পরিপূর্ণ সফলতা পাবে, তা কিন্তু তর্কাতীত নয়। খোদ কপ-২৬ সভাপতি অলোক শর্মার ভাষায়, ‘আমরা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার আশা বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এর নাড়ি বড়ই দুর্বল।’

প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে একশ’ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েশে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে।

তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়েছিল। তারা জানত, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে:
‘We do not inherit the Earth from our ancestors; we borrow it from our children. ‘Cree Indian prophecy’।

বিশ^ উষ্ণায়ন বাড়ছে, আর তার জেরে বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে উপক‚লীয় অঞ্চল, বিশেষত বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চলীয় দেশ ও দ্বীপদেশগুলো হুমকির মুখে পড়বে। সেইসাথে এই সত্যটাও বেরিয়ে এসেছে যে, মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে।
মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে যদি উত্তর গোলার্ধে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তাহলে উত্তর মেরু অঞ্চলের ভূভাগের হিমবাহ, যা বিশাল আইস শীট এবং সারাবছর বিদ্যমান থাকে, সেই বরফ সম্পূর্ণ গলে যাবে, ফেঁপে উঠবে সাগরের জল (একমাত্র অস্ট্রেলিয়া বাদে অন্যসব মহাদেশে, বিশেষত গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার পর্বতমালায় এসব বরফ জমে থাকে)। এছাড়াও পোলার আইস ক্যাপ (সাগর-মহাসাগরে জমে থাকা পাহাড়সম বরফ) গলেও সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে। পোলার আইস ক্যাপের গলে যাওয়া উপক‚লীয় অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক।

যেমন, গলে যাওয়া পোলার আইস ক্যাপ ক্যানেডার উপক‚লের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াহু নিউজে প্রকাশিত স্কট সাদারল্যান্ডের প্রতিবেদন ‘Polar ice melting, sea levels rising point to major risks for Canada’s coasts’-এ সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বরফ গলা এবং ফলশ্রুতিতে সমুদ্রস্ফীতি ও সে কারণে উপক‚লে বিরূপ প্রভাব।

সামনের দিনগুলোতে জলবায়ু বিষয়ে আরো লেখার ইচ্ছে আছে। এই লেখায় স্কট সাদারল্যান্ডের প্রতিবেদন অবলম্বনে বিশেষভাবে পোলার আইস গলে কানাডার উপক‚লীয় অঞ্চলের ভবিষ্যত বিপন্নতা সম্পর্কে ছায়াপাত করা হলো। মূলত এই লেখাটি প্রতিবেদনের অনূদিত অংশ।
পোলার আইস ক্যাপ অতি দ্রুত গলছে এবং তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে, পোলার আইস ক্যপের বিভিন্ন পরিমাপ নির্ধারণে বিশ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে পরিচালিত স্যাটেলাইট উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী টিম।
“আমাদের নতুন উপাত্ত পোলার আইস শীট ক্ষয়ের নির্ভরযোগ্য ও সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেছে,” সমীক্ষার দলনেতা ড. অ্যান্ড্রু শেফার্ড, (যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লীডস-এর আর্থ অবজার্ভেশনের অধ্যাপক ) জানিয়েছেন বলে জানায় সিবিসি নিউজ।

ড. শেফার্ড আরো বলেন, “বর্তমান উপাত্ত গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার আইস শীটের পরিবর্তনসংক্রান্ত গত বিশ বছরের অনিশ্চয়তা দূর করেছে। এই তথ্যগুলো এখন থেকে জলবায়ু বিজ্ঞানীদের জন্য বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে।”

আইস শীট ম্যাস ব্যালান্স ইন্টার-কমপেয়ারিজন এক্সারসাইজ (IMBIE) নামে পরিচিত এই প্রজেক্টটি নাসা ও ইয়োরোপীয় স্পেস এজেন্সির যৌথ প্রয়াস, যা ২৬টি পৃথক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৭ জন জলবায়ু গবেষক নিয়ে গঠিত।
ইউনিভার্সিটি অব অটাওয়ার আর্থ সিস্টেম ডাইনামিক গ্রুপ-এর ভূপদার্থবিদ গ্লেন মিল্ন রয়েছেন এই প্রজেক্টে। প্রজেক্টের উদ্দেশ্য আইস শীটের মাত্রা ও পরিমাপ পদ্ধতির মধ্যে বিদ্যমান অনেক বছরের মতভেদ দূর করা।
কানাডার রাডারসেট-১সহ ১০টি বিভিন্ন স্যাটেলাইটের উপাত্ত একীভূত করে, উপাত্তগুলো একই ভূপ্রকৃতি, একই সময়কাল ও হিমবাহের গলে যাওয়া ও তৎজনিত ভূমি-ভরের উত্থান (পোস্ট গ্লেসিয়াল রিবাউন্ড) বিশ্লেষণ করে এই টিম একমত হয়েছে যে, নব্বইয়ের গোড়া থেকেই গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার আইস শীট দ্রুত ভর হারাচ্ছে।

১৯৯২ সাল থেকে বছরে যথাক্রমে গ্রিনল্যান্ড আইস শীট ৯৩ থেকে ১৯১ বিলিয়ন টন, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার আইস শীট ৩৯ থেকে ৯১ বিলিয়ন টন এবং অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলা ৬ থেকে ৩৪ বিলিয়ন ক্ষয়ের শিকার হয়েছে। একমাত্র পূর্ব অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের আইস শীট কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা ঘটেছে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই অঞ্চলে অধিক বরফপাতের ফলে, যদিও পরিবর্তনটা এখনো বছরে ২৯ বিলিয়ন টন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৫৭ বিলিয়ন টন বৃদ্ধি অর্জন করতে। তারপরও এই যৎসামান্য বৃদ্ধি গ্রিনল্যান্ডের প্রভূত ক্ষতিগ্রস্ততা সামাল দেবার মতো নয়। আর ভরের এই ক্ষতির কারণেই সাগর স্ফীতি ঘটছে।

“স্যাটেলাইট উপাত্তের সবগুলো একত্র করলে দেখা যায় যে, ১৯৯২ সাল থেকে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিক আইস শীট ১১ মিলিমিটারের ওপর বৈশ্বিক সাগর স্ফীতি ঘটিয়েছে, যা সেইসময়ে মোট সাগর স্ফীতির এক পঞ্চমাংশ,” ড. শেফার্ড বলেন।
মাত্র এক সেন্টিমিটারের সামান্য বেশি কোনো বড় ধরনের কিছু নয়। কিন্তু এই বৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩৬০ মিলিয়ন এলাকাজুড়ে, যা অনেক বড় পরিমাণ পানি যোগ করেছে।

কানাডার অনেক অঞ্চল আছে যেগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আটলান্টিক কানাডায় অবস্থিত নোভা স্কোশিয়ার পুরো পূর্ব উপকুল-ইয়ারমাউথ থেকে লুইসবুর্গ, নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ফরচুন বে ও স্টিভেনভিল, প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড দ্বীপের পুরোটা এবং নিউ ব্রান্সউইকের উত্তর উপক‚লের -বিশেষত মংকটন এলাকা । সেন্ট লরেন্স সীওয়ে জুড়ে যে এলাকা, তা-ও হুমকির মুখে, বিশেষভাবে কুইবেকের কিছু এলাকা। কানাডার ওয়েস্ট কোস্টের হাইডা গোয়েই দ্বীপসমূহ বিশেষভাবে বিপন্ন, যেমনটি বিপন্ন ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ড উপক‚ল আর পুরো ভ্যাঙ্কুভার সিটি। বর্ণিত এসব এলাকা ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছ¡াসের হুমকির মুখে রয়েছে। এই ঝুঁকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেই কেবল বাড়বে।
বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ^ নেতৃবৃন্দের ঐকমত্যে আসার ব্যর্থতা কেবল বাড়িয়ে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তনে বিশে^র বিভিন্ন দেশ ও বিশ^বাসীর বিপন্নতার মাত্রা। ‘টাইম টু অ্যাক্ট নাও’ শব্দাবলি শুধুমাত্র ফাঁকাবুলি হয়েই শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে।