Home কলাম বালুকা বেলা : পুরোনো ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি

বালুকা বেলা : পুরোনো ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

সাল বা দিন তারিখ মনে নেই। বাংলাবাজারে যাচ্ছিলাম বইমেলা উপলক্ষে আমার প্রকাশিতব্য বইয়ের তদারক করতে। বছরের একটা বিশেষ সময়ে বিশেষত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ঘনঘন আসা যাওয়া হয়। মোহাম্মদপুর থেকে রিকশায় আসি নিউমার্কেটে। একনম্বর গেইট পেরিয়ে নীলখেত মোড়ে যাই। সেখান থেকে আবার রিকশা নিয়ে বাংলাবাজারে যাই। দীর্ঘ জ্যাম আর দূষণ উজিয়ে মোটামুটি নিরাপদেই আসা যাওয়া করি। রিকশায় গেলে টাকার শ্রাদ্ধ হয়, তবু যাই। বাসের ভেতরের গাদাগাদি ভিড় আর আর অসহ্য জ্যামের কারণে রিকশাকে বেছে নিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস, যারা বাসে বা গাড়িতে যায়, তাদের চাইতে একটু আগেই পৌঁছাই আমি। কারণ আমার রুট হচ্ছে গলিঘুুঁপচি আর পৃথিবীর কৃশতম রাস্তা। এতই চিপাগলি যে, কোনোরকমে একটা রিকশা ঢুকতে পারে। সেই গলিতে আমার রিকশা ঢুকলে কোনো পথচারি নর্দমার একপ্রান্তে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ে রিকশার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে। মাঝেমধ্যে রিকশা থামিয়ে বহু পুরোনো আগামসি লেনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোণের প্রাচীন একটা দোকান থেকে বাকরখানি কিনি।

রিকশায় চানখাঁরপুল এসে ঘোড়াগুলো দেখতে পাই। হাড্ডিসার। দানাপানি খাচ্ছে কোনোটা। পাশে ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলো। এসব ঘোড়ারগাড়ির একটির রুট হলো সদরঘাট থেকে গোলাপশাহ্ মাজার পর্যন্ত, ভায়া গুলিস্তান। ভাড়া জনপ্রতি দশটাকা (সম্ভবত ২০১১)। তারপর আরো রুট আছে। নয়াবাজার, রথখোলা মোড় আর লালবাগ। আমার খুব খারাপ লাগে যখন দেখি দু’টি হাড্ডিসার ঘোড়া, কোনোটি আবার মাদি ঘোড়া, প্রচণ্ড রোদে মুখে ফেনা তুলে গুরুভার বহন করে ছুটছে। গাড়িগুলো পুরোনো, ভারী আর চাকাগুলো চালু-মসৃণ নয়। তা-ও আবার এবড়োথেবড়ো রাস্তায় চলে। তার ওপর অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে।
রায়সাহেব বাজারের মোড় থেকে (জনসন রোড) বাংলাবাজারের দিকে যেতে একদিন একটা দৃশ্য দেখলাম। বামে আজাদ হল, উল্টোদিকে রোড পেরিয়ে কোর্টকাচারি। রিকশায় বসে ছিলাম। বাংলাবাজার যাচ্ছিলাম, জ্যামে আমার রিকশা থেমে গেছিল। বসে আছি। আমার ডানপাশে হঠাৎ একটা বিশাল লম্বা মুখ দেখে চমকে উঠলাম। একটি ঘোড়ার মুখ। ঘাড় কাত করে সে তার মাথাটা বাড়িয়ে দিয়েছে সিটের ওপর। জ্যামে পড়ে সে আর তার সঙ্গীও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল। একটু পরে যানবাহন চলাচল শুরু করল, সেই ঘোড়ার গাড়িটাও চলতে শুরু করল। তার সামনে স্যানিটারি আইটেম বোঝাই একটা ভ্যান চলছিল, কিছু খড় ঝুলছিল। সেই ঘোড়াটা চলন্ত অবস্থায় মুখে কিছু খড় তুলে নিল। সে খেতে পেরেছিল কিনা জানি না, তার মুখে বেল্ট বাঁধা ছিল। আমার দুই চোখ ভিজে গিয়েছিল।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পেছনে, নিমতলিতে, পুরোনো শহরের একচিলতে কোনো স্থানে গাদাগাদি করে থাকে ঘোড়াগুলো। ওরা পশু, তাই পশুর মতোই ব্যবহার করা হয় ঘোড়াগুলোর সাথে। কোনো অভাগা ঘোড়া আবার বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারায়।
অথচ এককালে এমন ছিল না। ঘোড়াগুলো তখন ছিল তরতাজা। দূষণ ছিল না, জ্যাম ছিল না। মনের আনন্দে-প্রাণশক্তিতে তখন তারা গাড়ি টেনে চলত। তাদের প্রতি মালিকের যতœআত্তি আর মমতার কোনো ঘাটতি ছিল না। পুরোনো ঢাকার অনেক বাসিন্দা পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে এখনো ঘোড়ায় টানা টমটম গাড়ির ব্যবসা ধরে রেখেছেন। এছাড়া, অনেক নতুন মুখও ঘোড়ারগাড়ির ব্যবসা করেন। ঢাকায় আর্মেনীয়দের যে কয়টি প্রভাবশালী পরিবার ছিল, তার মধ্যে সিরকোর সাহেবই পুরোধা। জানা যায় যে, সিরকোর সাহেবই ১৮৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন। তখন এর নাম ছিল ‘ঠিকা গাড়ি।’

পুরনো ঢাকার এই ঘোড়ার গাড়ির কাহিনি এখন আমাদের কাছে রীতিমতো মিথ। এই মিথ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে ঢুকে গেছে। এই বাহন সম্পর্কে চালু আছে নানা অলৌকিক কাহিনি, কৌতুক আর রহস্যের সব ঠাসবুনোট। একটি কৌতুক মনে পড়ছে। এক ঘোড়ার মালিক তার ঘোড়ার সামনে পুরোনো পচা কিছু খড় দিয়ে রেখেছে। ঘোড়ার দুই চোখে সবুজ ঠুলি (চশমা পরানো)। অন্য এক লোক বলল, ঘোড়ার চোখে ঠুলি লাগাইছ কেলা? মালিক জবাব দিল, হালায় ময়লা-পচা খড় খাইবার চায় না। হালারে ঠুলি লাগাইয়া দিছি। হালায় পচা-ময়লা খড় সবুজ দেখবার লাগতাছে। দেহ না কিমুন জবর খাওন দিতাছে?
দেশের, তথা পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্য ও স্থাপত্য রক্ষা করা যেমন প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য, তেমনি এইসব অবলা প্রাণীদের প্রতি আমাদের আরো মানবিক ও যতœশীল হতে হবে। মনে রাখা উচিত এরাও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীব। এদেরও প্রাণ আছে, আছে ক্ষুধাতৃষ্ণা ও জৈবিক প্রবৃত্তি।

Exit mobile version