হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

১১ অগাস্ট, ২০১৬ বৃহস্পতিবার। রাতে খাওয়ার পর ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে উঠছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। গুনগুন করে গাইছিলাম-‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না, শুকনো ধুলো যত।’ গাইতে গাইতে মনে পড়ল ‘গীতবিতান’-এর কথা। বইটা রাখা আছে শেল্ফে-পুরোনো ও মলিন। ১৯৮৯ সালে কিনেছিলাম। সেইসময় অল্পস্বল্প রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম হারমোনিয়াম সহযোগে। সেটা ঘটত বিক্রমপুর হাউস-এর বাসায় আমার নিভৃত কক্ষে।
তার রেশ ধরে নরসিংদী জেলার রাজারবাগ নামে এক নিভৃত গাঁয়ে জলপাই গাছতলার ঘরে বসে গেয়েছিলাম-‘সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে…।’ পূর্ণিমার রাত ছিল। গান, নিসর্গ আর গানের বাণীতে আমার মধ্যে খেলে গিয়েছিল এক অলৌকিক-নৈসর্গিক আবেশ। শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল ছোটো খালাম্মা (প্রয়াত) ও তার মেয়েরা, তাদের এক চাচাতো ভাই ও একজন অচেনা প্রতিবেশী বৃদ্ধ।

…আমার গীতবিতানের বইটিতে কোনো কোনো গানের শুরুতে আমারই হাতে লেখা তারিখ ও আমার নাম রয়েছে। এই অভ্যাসটা আমার হয়েছিল আমার খালাতো ভাই শাহরিয়ার ভাইজানের কাছ থেকে। উনারও একটা গীতবিতান ছিল। আমি তাঁর বাসায় (অফিসার্স কোয়ার্টার) গেলে তিনি ভেতরের রুম থেকে বইটি নিয়ে আসতেন। উদ্দেশ্য, তিনি বা আমি যেন গাইবার সময় কোনো ভুল না করি। তখন দেখতাম, বইটাতে তারিখ/নাম লিখিত আছে। অবশ্যই বহুবছর আগের তারিখ। জানি না, কেন এরকম তারিখ লেখা থাকত। হয়তো কোনো স্মৃতিকে ধরে রাখতে, কিংবা কেবলই মনের খেয়ালে-এমনকি হেঁয়ালিপনায়! আমার কোনো বইয়ের শুরুতেই যদি কোনো তারিখ লেখা থাকে, সেটা সাধারণত আমার বই সংগ্রহ, তথা কেনার তারিখ। আমার গীতবিতানের প্রারম্ভে তারিখ ছিল: ২৯.৬.৮৯।
বইটা নিয়ে সূচি/পৃষ্ঠা দেখতে লাগলাম। যে গানগুলো সচরাচর গাইতাম, সেগুলোর পাশে যথারীতি তারিখ লেখা আছে। আমি নিশ্চিত যে, এই তারিখগুলোর অধিকাংশই লেখা হয়েছিল বেইলি রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারে বসে। বাকিগুলো অবশ্যই বিক্রমপুর হাউসে বসে লিখেছিলাম।

…বিকেলে খোকন (আমার ও আমার ছোটোভাইÑদুজনেরই বন্ধু। আর সে গিটারিস্ট) এসেছিল আমার অনুরোধে। ওকে নিয়ে একটা কাজ সারতে গিয়েছিলাম মিরপুর দশ নাম্বারে। কাজটা সম্পন্ন হয়নি-তার বিবরণ এখানে অনাবশ্যক। খোকনকে নিয়ে বডিলাইন নামের একটি দোকানে ঢুকলাম। সেখান থেকে মেয়েদের একটা পারফিউম কিনলাম। পরদিন গুলশানে আমার পুরোনো বন্ধু জেসি’র বাসায় সামান্য এই গিফট নিয়ে যাব বলে। জেসি ঢাবি’র ইংরেজি বিভাগে আমার ক্লাসমেট ছিল।
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওভারব্রিজ দিয়ে অন্যপ্রান্তে নেমে একটা অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকান থেকে মাছের ওষুধ ও দু’টো গোল্ডফিশ কিনলাম। এরপর দু’জন চা খেয়ে রিকশায় চেপে বাসায় ফিরলাম। খোকন বিদেয় নেবার পর ল্যাপটপে আমার অধুনা লিখিত গল্প পরিমার্জনা করছিলাম-সেইসময় বড়পা ডাকলেন খেতে। খাওয়ার পর আমার বাসায় এসে গুনগুনিয়ে গাইছিলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত…।

একসময় শেল্ফ থেকে গীতবিতান তুলে নিয়ে বিছানায় বসে ‘সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে…’ গাইবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম দমে কুলোচ্ছে না। গান থামল, কিন্তু গীতবিতানের পৃষ্ঠা উল্টানোর কাজ চলছিল। একটা গানে এসে আমার হাতে লেখা তারিখ দেখে থমকে গেলাম-তারিখ থাকলেও গানটা আমার অচেনা। গানের দ্বিতীয় লাইনে চোখ যেতেই আমার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। তারিখ ছিল ৩০.১.৯৪, আর গানটা ছিল:
‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে
তবু যে পরান মাঝে গোপনে বেদনা বাজে-
এবার সেবার কাজে ডেকে লও সন্ধ্যাকালে।
বিশ্ব হতে থাকি দূরে অন্তরের অন্তঃপুরে,
চেতনা জড়ায়ে রহে ভাবনার স্বপ্নজালে।
দুঃখ সুখ আপনারই সে বোঝা হয়েছে ভারী,
যেন সে সঁপিতে পারি চরম পূজার থালে।’
-(আমার সংগৃহিত গীতবিতানের পৃষ্ঠা ৪৭)

এই গান আমি গাইতাম না। তাহলে তারিখ কেন! একটু খেয়াল করতেই চোখে পড়ল ‘সেতু’ শব্দটা। ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠবার কারণ এই শব্দটা। আমার স্ত্রী’র ডাকনাম সেতু আর ১৯৯৪ সালে আমরা থাকতাম শান্তিনগরের নিরিবিলি ও ছিমছাম একটা বাসায়। খুব সম্ভব এই গানে সেতু কথাটা লেখা থাকায় ওই তারিখে আমি স্ত্রীকে গানের কথাগুলো দেখিয়েছিলাম।
২০১৬ সালে আমি স্ত্রী’র সাথে অভিমান করে চলে এসেছিলাম ঢাকায়। সেই অভিমান বেশিদিন টেকেনি। কারণ আমার প্রাণপাখি আমার ছেলেটাকে যে রেখে এসেছিলাম টরোন্টোতে।
যা কিছু সঞ্চিত আছে আমার, সেইসব আমার মনের গহিনে রয়েছে। সঞ্চয়গুলো কোনো না কোনো উপলক্ষে নিজেদেরকে মেলে ধরে। এই তারিখটা তেমনই-ঝিনুকের ভেতর থেকে বের হওয়া কোনো মুক্তো।

…স্মৃতি হাতড়ালাম। অনেককিছু ঠেলে আসতে চাইল বিক্ষুব্ধ জনতার মতো। কিন্তু দমন করলাম। অধুনা আমি দমন-নীতি অনুসরণ করছি-নইলে স্মৃতি নামের প্রজারা আমাকে ঘিরে ফেলবে।

তাই আমি ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছি।
কোনো এক আলোকিত সকালে বা নিরালা দুপুরে, প্রশান্ত বিকেলে বা ভর সাঁঝে অথবা রাতের গহিনে আমি ওকে রাবীন্দ্রিক চরণক’টি দেখিয়েছিলাম। ওর কাছে কি এর কোনো মূল্য আছে?
অথচ…আমার কাছে অনেক স্মারক আছে-বিয়ের ঝলমলে রাখিবন্ধন, এমনকি আমাকে ওর স্বজনেরা দেখতে এসে যে ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিল, তার ছবিও আমার কাছে আছে। এরকম আরো সঞ্চয় আছে। কেবল নেই সঞ্চয়পত্র, ফিক্সড ডিপোজিট বা প্রাইজবন্ড। এগুলো না থাকলে গীতবিতানের কোন্ অংশে একটা নগণ্য তারিখ লেখা আছে-তারও কোনো মূল্য নেই। তবে আমার মতো নির্বোধ আর বোকার হদ্দ মানুষের কাছে এসবের মূল্য অনেক বেশি। আমি অর্থের চেয়ে আত্মার খোরাককে লক্ষ-অযুত গুণ বেশি মূল্যবান মনে করি।
(সেতু, আমার জীবদ্দশায় বা আমার অন্তর্ধানের পর তুমি আমার এই নগণ্য লেখা পড়বে কিনা জানি না। না পড়ে থাকলে অন্তত এই অংশটুকু পড়তে অনুরোধ করছি)।

এবং এই অংশটুকু শেষ করছি কবিগুরুর গানের কিছু অংশ দিয়ে:
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচাকেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’