হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।
“When you realize the value of all life, you dwell less on what is past and concentrate more on the preservation of the future.”
উপর্যুক্ত উক্তিটি ডায়ান ফোসির ডায়েরিতে লেখা সর্বশেষ বাক্য। তিনি নিহত হয়েছিলেন দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের আঘাতে। ১৯৮৯ সাল। ঢাকায় বিক্রমপুর হাউসে আমার নিভৃত কামরায় বসে ভিসিআরে ‘Gorillas in the Mist’ মুভিটি দেখেছিলাম। মুভিটি নির্মিত হয়েছিল রুয়ান্ডার মাউন্টেন গোরিলাদের সাথে ডায়ান ফোসির বসবাস ও গোরিলা সম্পর্কে ফোসির বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর বই ‘Gorillas in the Mist’-এর ওপর ভিত্তি করে। তখন জানতাম না যে, এই নামে তিনি একটি বই লিখেছিলেন এবং একটা সময় সেটা বেস্টসেলিং ছিল। মুভিটি দেখে এতই অভিভূত হয়েছিলাম যে, গোরিলাদের সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে সেটা প্রকাশ করেছিলাম চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মাসিক প্রকাশনা ‘নবারুণ’এ। কিছুকাল পর বর্ণিত মুভিটি আবার দেখেছিলাম। দেখার পর ডায়ান ফোসি সম্পর্কে কিছু একটা লেখার তাগাদা অনুভব করলাম।
ডায়ান ফোসি (১৯৩২-১৯৮৫) ছিলেন একজন অ্যামেরিকান জিওলজিস্ট। ষাটের দশকে ডায়ান রুয়ান্ডায় গোরিলাদের ওপর গবেষণা করতে যান। গবেষণা করতে গিয়ে তিনি গোরিলাদের সাথে একাত্ম হয়ে যান। এই বিপন্ন প্রাণিগুলোর প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা জাগে। সেই ষাটের দশকেই গোরিলারা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল চোরাশিকারিদের কবলে পড়ে। ডায়ানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গোরিলা নিধন বন্ধ হয় এবং গোরিলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই ষাট দশকে গোরিলারা বিলীন হয়ে গেলে আজ আমরা মাউন্টেইন গোরিলা পৃথিবীতে আর দেখতে পেতাম না। সাম্প্রতিককালে এরা আবারও নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
ডায়ান ফোসি বিখ্যাত নৃতত্ত¡বিদ ল্ইু লিকী-এর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে গোরিলা গবেষণা কার্যে লিপ্ত হন। ‘লিকী’স অ্যাঞ্জেলস্’ গ্রুপের সদস্যভুক্ত হয়ে তিনি এবং আরো দুইজন গবেষক জেন গুডাল ও বিরুট গ্যাল্ডিকাস প্রাইমেটদের ওপর গবেষণা চালান। ডায়ান বেছে নেন গোরিলা। জেন ও বিরুট গবেষণা করেন যথাক্রমে শিম্পাঞ্জি এবং ওরাংওটানদের ওপর।
ডায়ান ফোসি ১৯৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর (দিনে বা রাতে) কোনো এক সময়ে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন। দুর্বৃত্তদের হাতেই তিনি খুন হন বলে মনে করা হয়। কেননা, গোরিলাদের সংরক্ষণ করে, রুয়ান্ডান সরকার এবং সচেতন সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল তার জন্য। গোরিলা চোরাশিকারি ও গডফাদারদের কোপানলে পড়েন তিনি। ‘গোরিলাস ইন দ্যা মিস্ট’ ছবিটাতে তিনি স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্তদের দ্বারাই নিহত হন বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু তার মৃত্যুরহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। তিনি মারা যান ভিরুঙ্গা পর্বতমালায় তার ক্যাবিনে। দুর্বৃত্তরা দেয়াল ছিদ্র করে সেখানে ঢোকে। অনুমান করা হয় যে, মৃত্যুমুখে পতিত হবার আগে তিনি তার আগ্নেয়াস্ত্রে গুলি লোড করছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য যে গুলি বেছে নেন, সেটা সেই অস্ত্রের গুলি ছিল না। তাহলে হয়তো বেঁচে যেতেন তিনি। ক্যাবিনে তার অনেক মুল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, হাজার হাজার ক্যাশ ডলার, ট্রাভেলার্স চেক, ক্যামেরা ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি খোয়া যায়নি। এই থেকে অনুমিত হয় যে, এটি কোনো ডাকাতির ঘটনা ছিল না; তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়াই মূল উদ্দেশ্য ছিল।
কোনো কোনো প্রাণী বা প্রাকৃতিক উপাদান অত্যন্ত মূল্যবান। যেমন কস্তুরি মৃগ। মৃগনাভি নিঃসৃত সুগন্ধি পদার্থের জন্য স্মরণাতীতকাল থেকে মানবজাতির লোলুপতার শিকার হয়ে আজ কস্তুরি হরিণ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন প্রায়। তেমনিভাবে গন্ডারের খড়গ, হাতির দাঁত, সাপের বিষ আর বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর চামড়ার লোভে সেসব প্রাণী শিকার করে মানুষ তাদের ফেলে দিয়েছে বিলীন হবার সর্বশেষ প্রান্তে। কোনো কোনো প্রাণীবর্ত ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান সময়েই সবচেয়ে মর্মন্তুদ নিয়তির শিকার হয়েছে রুয়ান্ডার ভিরুঙ্গা পর্বতমালার মাউন্টেন গোরিলা। নিষ্ঠুরভাবে আর গণহারে গোরিলা নিধন করেছে কঙ্গো-রুয়ান্ডার বিদ্রোহীরা। ২০০৭ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস পরিবেশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের সরকার বিরোধী বিদ্রোহীরা দুইটি মাউন্টেন গোরিলা মেরে তাদের মাংস খেয়ে ফেলে।
ফোসির সমাধি রচিত হয় কারিসোকে নামের স্থানে (ভিরুঙ্গা পর্বতমালায়) তাঁর নিহত গোরিলা-বন্ধুদের সমাধিক্ষেত্রে, যা তিনি জীবদ্দশায় প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সেই সমাধিক্ষেত্রের নাম দিয়েছিলেন-ডিজিট।
একজাতের হরিণ মাংস খায়! তার নাম ডুইকার (Duiker). আমার সংগ্রহে বিখ্যাত শিকারি Fred G. Merfield-এর Gorilla Hunter (১৯৫৬) গ্রন্থটি রয়েছে (ঢাকায়)। বইটা পড়ে জেনেছি যে, কোনো কোনো প্রজাতির হরিণ অন্য জন্তুর মাংস খেয়ে থাকে। ডুইকার তেমন এক জাতের অ্যান্টিলোপ বা হরিণ। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেই এই প্রাণীটি বিদ্যমান। প্রাণীটি ছোটো, সুন্দর ও গতিসম্পন্ন।
শিকারি ম্যারফিল্ড ক্যামেরুনের রেইনফরেস্টে একটি গোরিলা শিকার করেন। তিনি ও তার লোকজনেরা গোরিলার চামড়া ছাড়ান। মাংস বিলিয়ে দেন গ্রামবাসীদের মধ্যে। গোরিলার মাংস ওদের কাছে খুবই উপাদেয়! এক বালক তার ভাগের মাংস না খেয়ে সেই মাংসের টুকরো দিয়ে ফাঁদ পাতল ডুইকার ধরার জন্য। ম্যারফিল্ড নিজে অনেকবার ডুইকার প্রজাতির হরিণকে হাড্ডি চিবোতে দেখেছেন।
ডুইকার গোরিলার মাংস খেতে পারে; কারণ সে বন্য ও অবোধ। তাছাড়া সে গোরিলাকে মেরে তার মাংস খায় না। গোরিলার মাংস পেলেই খায়। কিন্তু যারা মানুষ, কামনা করি, তারা যেন গোরিলার মাংস না খায়। এই প্রাণীটাকে বিচরণ করতে দেয়া হোক জাদুবাস্তবতামাখা গহিন রেইন ফরেস্টে।
কামনা করি, হরিণ যেন গোরিলার মাংস আর খুঁজে না পায়।