Home কলাম বালুকা বেলা : জীবনের জঙ্গম চিত্র

বালুকা বেলা : জীবনের জঙ্গম চিত্র

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

 

জীবনটা বরাবরই এলোমেলো কেটেছে, অস্থিরতায় পার করেছি সময়। আমি অনেক বিষয়েই নিয়মনিষ্ঠ। অনেকক্ষেত্রেই গুছনো স্বভাবের। আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি। কিন্তু সর্বদাই মনে হয়, গুছিয়ে উঠতে পারছি না। এগুতে পারছি না। যেন নিয়তির টানে ছুটে চলেছি। আমার ভেতরের কোনো ‘ট্র্যাজিক ফ্ল’ হয়তো আমাকে কষ্ট দিয়ে আসছে, দিয়ে যেতে থাকবে। আসলে কিছু কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল ক্রিয়ার ফলে আমি আত্মগøানিতে ভুগছি। হয়তো পরিশোধিত হতে পারব না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার ভুলগুলো বিমূর্ত চিত্রের মতো। কাউকে বুঝাবার নয়, জঙ্গম চিত্রসম- ক্যানভাসের ওপর রং ছিটিয়ে বা ঢেলে গড়াতে দিয়ে বিমূর্ত ছবি তৈরি করার মতো। তেমনি আমি আমার ইচ্ছেগুলোকে রঙের মতোই ছিটিয়ে দিয়েছি- যা পরিণত হয়েছিল ভুল নামের ক্যানভাসে। আর কিছু সৃষ্টি করার তাড়নায় তড়পাচ্ছি। সৃষ্টি করেছি একটি উপন্যাস। নাম দিয়েছি ‘ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস।’ উপন্যাসটা প্যান্ডেমিক-এর ওপর ভিত্তি করে রচিত। গ্রন্থাকারে এটার একটা প্রাক-প্রকাশনা রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা কাগজে। এই উপন্যাসটা রচনা করে আমি অনেকটাই তৃপ্ত। দীর্ঘ দুইবছর এর আঙ্গিকগত দিক, পরিসর, প্লট আর সাহিত্যমান নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছি। বর্তমানে এটা একটা প্রকাশনা সংস্থার জিম্মায় আছে। তারা শেষ পর্যন্ত কী করে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

একটা বিষয় আমার কাছে বারবার মনে হয় যে, আমি এখন সাহিত্য বা সংগীত নিয়ে যতটা কাজ করছি তা যদি আরও কয়েকবছর আগে করতাম তাহলে কিছুটা হলেও আমার ভুলের মাশুল হতো।
এখন এখানে আমার কাছে সময়টা হলো সবচেয়ে ক্রুশল্। সময় পাচ্ছি না। অনেক কাজ। একটা শেষ করলে আরেকটা কাজ এসে যায়। অনেক উটকো ঝামেলাও সামলাতে হচ্ছে। এখন ভাবি, মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের বাসায় আমার অখণ্ড অবসরের সময়গুলোতে আরও কিছু কাজ সম্পন্ন করে রাখিনি কেন।
এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ক্যানেডায় অবস্থান করে ২০১২ সালে আমার একটি গল্পগ্রন্থ ও একটি স্বল্প পরিসরের উপন্যাস প্রকাশিত হয় বইমেলায়। উপন্যাসটির নাম ‘অনাদ্যন্ত’ আর গল্পগ্রন্থের নাম ‘পোড়োমানবের গল্প।’

অনাদ্যন্ত উপন্যাসটি লিখে আমি তৃপ্ত। নাতিদীর্ঘ এই উপন্যাসটি আমার মতে, আমার লেখা অন্যতম সেরা উপন্যাস। উপন্যাসটি সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক পাঠকমহলের জন্য প্রকাশিত গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লিখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণটাই তুলে ধরলাম:
‘শিক্ষিত, আদর্শবান ও ভালমানুষ মহি। বউ রহস্যময় কারণে মহিকে ছেড়ে চলে যায়। বন্ধু পরিবেষ্টিত মহি অন্যের সেবায় এবং লেখালেখি করে পার করে দিল অনেকটা বছর। চে গেভারার আদর্শে উজ্জীবিত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাদির প্রভাবে মহি অজান্তেই নিজকে প্রোলেতারিয়েত গোত্রভুক্ত করে ফেলে। দুর্ভাগ্যক্রমে সাদির অপমৃত্যু হয়। বন্ধুদের চাপে পড়ে আবার বিয়ে করে মহি। তার পাণ্ডুলিপিটি কোনো প্রকাশক ছাপাতে চাইল না। একরাশ অভিমান দানা বাঁধে বুকে।

একজন এমপি মহির কাজিন। তিনি মহিকে আশ্বাস দেন মহির প্রজেক্টে বিনিয়োগ করবেন। দলাদলির জের ধরে এমপি মহির প্রজেক্টে ইনভেস্ট করবেন না বলে জানান এবং মহিকে অপমান করেন। মহি যখন আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, তখন তার সদ্য বিয়ে করা বউ সাথীর কাছ থেকে এলো চরম আঘাত। মহি মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে পৃথিবীতে একাকী, বন্ধুবিহীন। চন্দ্রবিহীন পৃথিবীর মতো। চাঁদ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে- বিজ্ঞানীরা এমন আভাস দিয়েছেন। পৃথিবীবাসীর সীমাহীন অনাচার আর পাপ দেখে দেখে চাঁদ হয়তো লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এভাবে একদিন চাঁদ আর থাকবে না, তখন মানুষ চন্দ্রবিহীন পৃথিবীতে বাস করবে। একমাত্র সম্বল জমিটিকে ঘিরে যে প্রজেক্ট মহি করতে চেয়েছিল, সে স্বপ্ন তার ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার মহি বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকে। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করেও দলাদলির শিকার হয়ে এক পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে মহি। বন্ধুরা পাশ কাটিয়ে গেল, শুধু এগিয়ে এলো লিটু নামের এক বন্ধু। আপনজনেরা দূরে সরে যায়, স্ত্রী সাথী অন্যের প্ররোচনায় পড়ে মহির ভয়াবহ বিপর্যয়ে এগিয়ে এলো না। এগিয়ে এলো কলমী, মহির প্রথম স্ত্রী। এখন পরিণত, অঢেল অর্থের মালিক। কলমী মহির সেবা করে। বন্ধু লিটু আর কলমী বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দেয় মহিকে। কলমী জানায় সে ঘটা করে মহির বই প্রকাশ করবে। মহি রাজি হলো না। যেচে এসে কোনো প্রকাশক ওর পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে চাইলে কেবল তখনই রাজি হবে মহি।
দুর্ভাগ্য মহিকে ছেড়ে যায় না। কলমীকে ঘিরে মহির স্বপ্ন যখন নতুনভাবে শুরু হলো, তখন কলমীর আরো একটি কালো অধ্যায় আবিষ্কার করে মহি। মহি ছিটকে পড়ে আবার। চলে যায় তার স্বপ্নের প্রজেক্টসাইটে, যেখানে সে প্রাণীদের অভয়ারণ্য করতে চেয়েছিল, সেখানে সে করল সামান্য পোল্ট্রি।’

মহির একাকী জীবনযাপন ও দমবন্ধ করা অবস্থার চিত্র কাহলিল জিবরানের প্রতীকী ঢংয়ে উপস্থাপিত করেছি উপন্যাসের শেষের দিকে- Last night I invented a new pleasure, and as I was giving it the first trial an angel and a devil came rushing toward my house. They met at my door and fought with each other over my newly created pleasure; the one crying, “It is a sin!” – the other, “It is a virtue!”-Kahlil Gibran

গল্পগ্রন্থ ও গ্রন্থিত গল্পগুলো সম্পর্কে এখানে আমার তেমন কিছু বলার নেই। এতটুকু বলা যায় যে, গল্পগুলো আমার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল। দুয়েকটি গল্প পরীক্ষামূলকভাবে উপস্থাপন করেছি। কাঠামোগত নিরীক্ষা ও ভিন্নতার ছাপ আছে সেগুলোতে।

কথা হলো, আমি কি ভুক্তভোগী আর অভিযোগকারী কিংবা নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের কাঁধে চাপাতে চাচ্ছি? না, এর কোনোটাই না। এমনকিছু কেউ কখনো আমার সামনে বা পেছনে বলেনি। যারা ভালো গল্প লেখেন এবং যারা ভালো পাঠক- তারা পজিটিভ মনোভাবই পোষণ করেন আমার সম্পর্কে। তবে একটা জায়গায় আমার চরম ব্যর্থতা আছে। সেই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নিয়ে নিচ্ছি। তা হলো- বড় ধরনের গ্যাপ দিয়েছিলাম লেখালেখিতে আর দু’চারজন লেখক-সাংবাদিক-সাহিত্যিকের সাথে আমার চরম মতবিরোধ আছে। আরেকটা ব্যর্থতা বোধহয় এমন যে, আমি ঠিক তাল মেলাতে পারছিলাম না পত্রিকাসমূহের মতিগতি পরিবর্তনের সাথে। এর একটা হলো অনেক পত্রিকাসমূহের বাণিজ্যায়নের প্রবণতা। আরেকটি হলো, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ‘সাংবাদিক’দের আত্মম্ভরিতা। এসব জায়গাগুলোতে আমি চুপ করে থাকি। কিন্তু চুপ করে আর কতকাল থাকব? একদিন তো নিঃশেষিত হয়ে যাব, তখন তো একটা অতৃপ্তি নিয়ে চলে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে।
নিজের এই অতৃপ্তির কথা কার কাছে বলি? সবাই যন্ত্রবৎ। ব্যবসা-বাণিজ্য, গাড়ি-বাড়ি আর টাকাপয়সা ছাড়া অন্যকোনো আলোচনা কমই হয়। সবাই কিছু না কিছুর পেছনে ছুটছেনই। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবে দৌড়ঝাঁপের বিষয়টা আমি একটু কম করে থাকি। ছোটো হোক, বড় হোক- সবাই কোনো একটার পেছনে দৌড়ঝাঁপ করছেন। সেখানে আমার একান্ত অনুভূতির তো কোনো বিশেষ প্রাধান্য থাকতে পারে না। আমি খুঁজে বেড়াই সাদা মনের মানুষদের।

অনেক অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি। আসলে বেঁচে আছি- এরকমটা ভাবলে মনে হয় মৃত্যু বোধহয় কাছিয়ে আসছে।

Exit mobile version