Home কলাম বালুকা বেলা : জাদুবাস্তবতা কিংবা উত্তরাধুনিকতা

বালুকা বেলা : জাদুবাস্তবতা কিংবা উত্তরাধুনিকতা

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

জাদুবাস্তবতা কিংবা উত্তরাধুনিকতা

ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করে আমার সাহিত্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কিছুটা হলেও যে আবেদনিক হয়েছে, সে কথা আমার নিজের মুখেই বলতে হচ্ছে। আমার মনন অন্তত সেকথাই বলে। সাহিত্য অন্তহীন মহাসাগরের মতো, যার শেষ নেই। আমি যদি ইংরেজি সাহিত্য পড়ে তার থেকে বালিকণা পরিমাণও জ্ঞান অর্জন করে থাকি, সেটা আমার সম্পদ। তবে আমার জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই একটা Fallacy কাজ করেছে। যা আমাকে অনেকটা পেছিয়ে দিয়েছে। কালানৌচিত্য দোষ আমার আছে। কালক্রমের অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহার। আর অনভিজ্ঞতা। লেখায়, সংগীতে ও জীবন গড়ায় আমি কখনও সময় ও চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলাম না। সে অন্য কথা। পর কখনও বলব আমার ভুলগুলোর কথা।
খুব পড়েছি তা বলব না, আসলে যেহেতু কিঞ্চিৎ সাহিত্যচর্চা করে থাকি, সেজন্য পড়াশোনাও তো কিছু করতে হয়। তাই আমার পড়াটা পাঠ্যবই পাঠ করার মতো। উত্তরাধুনিকতা, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম সম্পর্কে পড়াশোনা করছি। আমার পড়া শিকার কাহিনি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে Peter Barry-এর ‘Beginning Theory’ ও Kurt Vonnegut পর্যন্ত বিস্তৃৃত করেছি। অনুবাদও করেছি-নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কানাডীয় গল্পকার Alice Munro-এর ‘The Progress of Love.’ সেটি ঢাকা থেকে অন্যধারা প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছিল ২০১০ সালে। আমার এই সাহিত্য বিষয়ে অধিক আলোচনা হয়তো আপনাদেরকে ক্লান্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু এসব তো আমার মাঝে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে।

এই অধ্যায়টি শেষ করব আমার প্রিয় লেখক/কবি আর প্রিয় কয়েকটি উপন্যাসের নাম বলে।
আমার প্রিয় লেখকদের একজন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আরেকজন হলেন কমল কুমার মজুমদার। কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯) এক স্বতন্ত্র ও স্বমহিম প্রতিভা। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল লেখক গোষ্ঠি, কিন্তু তিনি নিজে কোনো গোষ্ঠির লেখক নন। তাঁর ‘নিম অন্নপূর্ণা’ বা ‘মতিলাল পাদরি’ কিংবা ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এই লেখক আজীবন স্টাইল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন। চলতি বাংলা দিয়ে শুরু করলেও কমলকুমার ক্রমশ ঝুঁকেছিলেন সাধু বাংলার গদ্যরচনার দিকে। শেষাবধি নির্মাণ করেছিলেন স্বকীয়তাস্পন্দিত এমন এক ভাষারীতি, যা অনায়াসে চিনিয়ে দেয় কমলকুমারকে। আরও যে ক’জন প্রিয় গল্পকার/ঔপন্যাসিক আছেন তাদের মধ্যে এমিলি ব্রন্টি, গি দ্য মোপাসাঁ, সমারসেট মম, কুর্ট ভনিগাট, অ্যাডগার অ্যালান পো, চিনুয়া আচেবে, আলবেয়ার কামু প্রমুখ।

মূলত একজন ছোটোগল্পকার রূপে আমি গল্পরাজ্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা প্রভাবান্বিত নই। তবে, অবশ্যম্ভাবীভাবে কবিগুরুর অনেক গল্প আমি পড়েছি এবং প্রথমদিকে তার ভাষারীতির খানিকটা ছায়াপাত হয়তো করেছিলাম আমার গল্পের কাঠামোতে। কিন্তু সেটা আখেরে আমার জন্য ভালো হবে না ভেবে পরিত্যাগ করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্প আমার আমার এত ভালো লেগেছিল যে, সেগুলো অনেকবার করে পড়েছিলাম। একটা গল্প ‘হৈমন্তী’ বা অন্য একটি গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ কিংবা উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ তো অসংখ্যবার পড়েছি। পড়েছি ‘কঙ্কাল’ গল্পটি। ছোটোবেলায় আমার বড় আপার পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমি চুরি করে গল্পটা পড়েছিলাম, কী জানি যদি বড় আপা বকা দেয়। প্রথমবার পড়ে ভয় পেয়েছিলাম। বহুদিন কিংবা বছর পর আবার পড়লাম। আবারও পড়লাম। তারপর শেষ যখন পড়লাম, তখন ভয়টয় উবে গিয়ে উল্টো ভালোবেসে ফেললাম সেই কঙ্কালটিকে। কেন বলুন তো? আপনারা আন্দাজ করে নিন। আরও কত গল্প পড়লাম। যেমন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এবং আরও অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটোগল্পের জনক। আর তাই গল্প লিখিয়েদের জন্য রবীন্দ্রপাঠ অতি অত্যাবশ্যকীয়।

যেসব উপন্যাস পড়ে আমি অভিভূত সেগুলো হলো জন স্টেইনবেকের ‘গ্রেপস অভ র‌্যাথ’, অ্যালবেয়ার কামু’র ‘দ্য প্লেগ’ ও ‘দি আউটসাইডার’, চিনুয়া আচেবের ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’, সল বেলো’র ‘সিজ দ্যা ডেই’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সী’, এমিলি ব্রন্টির ‘ওইদারিং হাইটস’, এরিখ সেগালের ‘লাভ স্টোরি’।

আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি কে? তিনি আর কেউ নন, একমাত্র জীবনানন্দ দাশ। তারপরে আরও কয়েকজনের নাম করতে পারি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আল মাহমুদ, শঙ্খ ঘোষ, শার্ল বোদলেয়ার আর ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক যুগের পাঁচ কবি ছাড়াও টি.এস. এলিয়ট ও টমাস গ্রে। রোম্যান্টিক পাঁচ কবি’র অন্যতম পি.বি. শেলীর একটি কবিতা ‘ওজিমেনদিয়াস অভ ইজিপ্ট’ শেলীর দ্বি-শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অনুবাদ করেছিলাম এবং সেটি দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় শেলীর দ্বি-শততম জন্মবার্ষিকী সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।

এখন আমি লিখে যাচ্ছি আমার মতো করে- গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ। সাহস সঞ্চয় করে কিছু কিছু লেখা লিখছি বা লিখেছি জাদুবাস্তবীয় বা উত্তরাধুনিকতার আদলে। দু’টি বিষয়ই বø্যাক হোলের মতো অন্তহীন ও ধোঁয়াশার মতো অবয়বহীন ও মহাকাশের অপার রহস্যময়তায় প্রায় ভৌতিক চাদোয়ায় ঘেরা। লিখে যাচ্ছি, এর শেষ কোথায় জানি না। জানতে চাই না।

Exit mobile version