হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।
যুগে যুগে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত সত্য; যদিও সংবেদনশীল মন এই সত্য মানতে চায় না।
উত্তর গোলার্ধে সাগর ঘেরা, লেকসমৃদ্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শীতলতম একটি দেশের পত্তন, অতীত-ঐতিহ্য-কৃষ্টি বিষয়ে আলোচনায় অবধারিতভাবে আদিবাসী, তথা ফার্স্ট ন্যাশন্স এর কথা আসবে।
দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এক ধরনের অ্যানিমেল ইন্সটিংক্ট। চলমান প্যান্ডেমিক সময়ে জর্জ ফ্লয়েডের অকারণসম্ভূত বেদনার্ত প্রস্থান সেই ধারাবাহিকতারই নামান্তর।
কানাডা বিশে^র অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ, আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি। এর পত্তন ও উত্থান ঘটনাবহুল। দূর অতীত থেকেই এই অতিকায় দেশটার দিকে তাকিয়ে ছিল পুঁজিবাদী একচোখা দৈত্য। ফরাসি, ইংরেজ আর আংশিকভাবে পর্তুগিজরা শুষে খেয়েছে বিভার আর মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই থেকেই প্রবল বৈষম্যের শিকার এই দেশের আদিবাসীরা। যুদ্ধ-সংঘাত আর ইংরেজ-ফরাসির লড়াইয়ের ধকল গেছে তাদের ওপর দিয়েই।
কানাডাকে বুঝতে হলে এর তিনটি ফাউন্ডিং (পত্তন) গোষ্ঠির কথা ভাবতে হবে: আদিবাসী, ফরাসি ও ব্রিটিশ। ইয়োরোপিয় অভিযাত্রীদের উত্তর অ্যামেরিকায় আগমনের বহু পূর্ব থেকেই কানাডার আদিবাসীদের পূর্বপুরুষগণ এখানে অধিস্থিত ছিলেন। আজকের কানাডার নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠির একটা সিংহভাগ ইয়োরোপ থেকে আগত ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও ফরাসি খ্রীষ্টিয় সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং আজকের কানাডার আইনি ভিত্তিগুলো মূলত মধ্যযুগের ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে প্রোথিত আইন ও গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বহুলাংশে আবর্তিত; এদেশের আইন সবার জন্য সমান সুযোগ দিয়ে থাকে যদিও। কানাডায় মাল্টিকালচারাল (বহুস্তর বিশিষ্ট কৃষ্টি) বিদ্যমান। দেশটিতে প্রতিবছর বহু অভিবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্যমান ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় আগমন করে থাকেন এবং কানাডার মাল্টিকালচারকে আরো বর্ণিল করে তোলেন। অবশ্যি এই ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া ও অভিবাসীদের সংখ্যা সীমিত করে দেবার কথাও শোনা যায়। তাছাড়া, দুয়েকটি খাস ক্যানেডিয় সংস্থা এতো বিপুল সংখ্যক অভিবাসনের বিরোধিতা করে আসছে।
আদিবাসীরাই কানাডার ধারক ও বাহক, বহু মিথ-এর জন্মদাতা, অজ¯্র কালচার ও ঐতিহ্যের ঝান্ডাধারী। ওকাল্ট লোর থেকে শুরু করে রাশিফল, পাথর ধারণ, হাইডা টোটেম পোল নির্মাণ (একটি স্তরে স্তরে খাপযুক্ত খুঁটি যার ওপর টোটেমগুলি ঝুলিয়ে রাখা হয়, আর টোটেম খোদাই করা হয়), নাচ-গান, রীতিনীতি ও পরিচ্ছদ-প্রসাধন দূর অতীত থেকেই কানাডার আদিবাসী ঐতিহ্যকে ধারণ করছে।
এইসব ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার অতীত থেকেই বহিঃশক্তি ও পুঁজিবাদী-ঔপনিবেশিক-আগ্রাসী বহিঃবিশে^র শিকার হয়ে এসেছে। কানাডার পুঁজিবাদী শক্তি মূলত গড়ে উঠেছিল বিভারের পশম ও চামড়াকে ঘিরে। পুঁজিবাদ হলো প্রবাদের সেই মাকড়শা যে একটি ব্যাঙ ধরে পিঠের ওপর নিয়ে নদী পার হবার সময় যখন দুজনেই মারা যাচ্ছে তখন বলে, ‘আমি এটাই করি, কেননা এটা আমার স্বভাব।’
এটা এমন একচোখা দৈত্য যা ব্যবসায় সবসময় সর্বকালের সর্বোচ্চ পুঁজি পুঞ্জীভূত করতে চায়। ‘পুঞ্জীভূত করো, পুঞ্জীভূত করো,’ যেমন বলেছেন কার্ল মার্কস তার ‘ডাস কাপিটাল’ বা ‘পুঁজি’ গ্রন্থে।
বহিঃশক্তির বিদায়ের পর বিভিন্ন সময়ের শাসনামলে আদিবাসী, ফার্স্ট ন্যাশনস, তথা ইন্যুয়িট ও মেটিস অধিবাসীগণ আর অভিবাসী শ্রমিকগণ শিকার হয়েছিলেন নানা বৈষম্যের।
মাত্র কদিন আগেই সাসকাচুয়ানের গণকবরের বিষয়টি উন্মোচিত হয়। ভাবতে কষ্ট হয় যে, দক্ষিণ সাসকাচুয়ানের একটি প্রাক্তন আদিবাসী আবাসিক স্কুলে ৭০০টিরও বেশি অচিহ্নিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। আদিবাসীরা যে কতটা অত্যাচারিত হয়েছে অতীতে, এসব তার ট্র্যাজিক স্মারক।
গণকবর আবিষ্কারের পর সার্বভৌম আদিবাসী ফার্স্ট ন্যাশন্স ফেডারেশন প্রধান ববি ক্যামেরন বলেছেন যে, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, এবং ফার্স্ট ন্যাশন্স এর ওপর আক্রমণ। তিনি আরও বলেছেন যে, যতক্ষণ না তারা সমস্ত মৃতদেহ খুঁজে পাচ্ছেন ততক্ষণ তারা থামবেন না।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন যে তার দেশের জন্য ‘একটি উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তুলতে’ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের ইতিহাস স্বীকার করতে হবে।
আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অনেক দিক বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাপক গবেষণা ও তদন্তের দাবিদার। এটি বহু আগেই তাদের প্রাপ্য ছিল, কিন্তু তা প্রাপ্যই থেকে যায়।
কানাডিয়রা জাতিসত্তা, বহুসংস্কৃতিবাদ, আদিবাসী মানুষ। ইনুইট, মেটিস আর ফ্র্যাঙ্কোফোন। কানাডায় ফরাসি, ইংরেজ এবং অন্যান্য জাতি যারা বিভার পশম ও চামড়া, আর মূল্যবান সম্পদ শোষণের জন্য এসেছিল, এবং কীভাবে তারা একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক মোজাইক গঠন করেছিল যার সাথে যুক্ত হয়েছে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময় বিশ্বজুড়ে অভিবাসীদের আগমন।
বিশে^র প্রতি দেশ বা স্থানেরই একটা গল্প থাকে, যা তিক্ততা, উপভোগ, কষ্ট এবং রোমাঞ্চের মিথস্ক্রিয়া।
কানাডার প্রাথমিক ইতিহাসে, শ্রমিকরা, বিশেষ করে ১৯০০এর দশকের শুরুতে ক্যানেডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে নির্মাণের সময় প্রথমদিকের বসতকারী চিনা শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কানাডায় পৌঁছানোর পর ১৫০০০ চিনা শ্রমিকসহ অনেক অভিবাসী শ্রমিক খারাপ জীবনযাপন এবং কম বেতন বৈষম্যের শিকার হন। তারা দমনের শিকার হয়েছিলেন এবং তারা সামান্য বেতনের জন্য কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
ইতিহাসবিদদের মতে, তারা অনেক কষ্ট ভোগ করেছিলেন এবং প্রায় ৬০০ চিনা মারা যান।
ফার্স্ট ন্যাশন্সও এর ব্যতিক্রম নয়; ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তারা অনেক কষ্ট ভোগ করেছিলেন। অনেক চুক্তিতে এবং মৌখিকভাবে তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে, কিন্তু এটি কখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশে^ শোষণের ইতিহাস একইসাথে অশিব ও চমকপ্রদ। আলুর দুর্ভিক্ষের সময় ইংরেজদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছিলেন।
‘আলুর দোষে’ই হোক আর পুঁজিবাদের তাড়াতেই হোক, তারা প্রথম এখানে এসেছিলেন খালি হাতে।
ইংরেজরা তাদের কালো ভেড়ার গল্প নিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে সম্পত্তিবঞ্চিত হয়ে বা আর্থিক অবস্থা পড়ে যাওয়ায় কিংবা গোপন প্রণয়ের (Elopement) পরিণতিতে পরিযায়ী হয়েছিলেন তারা। এমন কাহিনি নিয়ে নোবেল বিজয়ী বড় গল্পকার অ্যালিস মানরো’র একটা বড় গল্প (উপন্যাসের ব্যপ্তি সমৃদ্ধ) আবর্তিত।
কানাডীয় কবি, ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, উদ্ভাবক, শিক্ষাবিদ ও পরিবেশবাদী মার্গারেট অ্যাটউড তার উপন্যাস ও কবিতায় বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভাষার ক্ষমতা, লিঙ্গ ও পরিচয়, ধর্ম ও পুরাণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্ষমতার রাজনীতি।
তিনি ছোটোবেলা থেকে পৌরাণিক ও কল্পকাহিনির প্রতি আসক্ত ছিলেন এবং তার অনেক কবিতা এগুলো থেকে অনুপ্রাণিত। কানাডীয় সাহিত্যে তার অবদানের মধ্যে অন্যতম হলো তিনি গ্রিফিন পোয়েট্রি প্রাইজ ও রাইটার্স ট্রাস্ট অব ক্যানেডার প্রতিষ্ঠাতা।
বৈষম্যের শিকার আদিবাসী শিশু সম্প্রতি বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ পরিবর্তন করতে কানাডার ফেডারেল কোর্ট অব আপিলের প্রতি আহ্বান জানায় কানাডা সরকার।
সূত্রমতে, আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে কানাডা সরকার। আদিবাসী শিশুদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার পরিবর্তে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে তারা।
কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ দেয়াটা জরুরি। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফস্টার কেয়ারে (রাষ্ট্রীয় সেবায় দেখভাল) রাখা আদিবাসী শিশুদের ওই ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
আপিলের নোটিশে কানাডা সরকার জানায়, ‘আদিবাসী শিশুদের প্রতি কাঠামোগত বৈষম্য হয়েছে, তা আমরা স্বীকার করছি। সরকারের অসদাচরণের কারণে আদিবাসীদের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে আমাদের দ্বিমত নেই। তবে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ের সমাধান আরো কার্যকর হতে পারে।’
আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্ক রয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন আলোচনার পরেও আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া যায়নি। সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠির আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী। আদিবাসীদের উপজাতি হিসেবে সম্বোধন করা একেবারেই অনুচিত, কারণ তারা কোনো জাতির অংশ নয় যে তাদের উপজাতি বলা যাবে। বরং তারা নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।
সূত্রমতে, পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশে ৪০টির বেশি দেশে বসবাসরত প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠির মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি। নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় যুগে যুগে এদের অনেকে কোণঠাসা, শোষিত, বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হয়েছে এবং যখন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের কথা তারা বলেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দমননীতি, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠির এই বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়েছে এবং ১৯৯৩ সালকে ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠি বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠি দশক’ ঘোষণা করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের সুনজরে দেখা। এছাড়া, ১৯৯৫ সালের ৯ অগাস্টকে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৮২ সালে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়।
আদিবাসীদের অধিকার, বিশেষ করে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি অনেক রাষ্ট্রের কাছে স্বস্তিদায়ক নয়, কেননা সেইসব দেশের জনগণের একটা বড় অংশই আদিবাসী।
আদিবাসীরা ভালো থাকুন, তাদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখে, তারা ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে বিচরণ করুন। এই কামনা আমাদের সবার।