হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমার ‘বালুকা বেলা’ কলামে গত সংখ্যায় লিখেছিলাম মন্টোগোমারি’স ইন সম্পর্কে। তখন ঐতিহাসিক ফোর্টইয়র্ক সম্পর্কে লিখব বলেছিলাম। আজ তাই আমার দেখা ও আমার কালচার অ্যান্ড হেরিটেজে পড়াশোনার ফসল ফোর্টইয়র্ক পরিদর্শন সম্পর্কে আলোকপাত করব।
এখানে ফিল্ড ট্রিপে এসে শিক্ষণীয় বিষয় ছাড়াও আমার আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটাও আজ বলব।

৩ অক্টোবর ২০১৪ শুক্রবার ছিল ঐতিহাসিক ফোর্টইয়র্কে ফিল্ড ট্রিপ। আমাদের কোর্স ‘কালেকশন অ্যান্ড অ্যাক্জিভিট’-এর টিচার কেন্ এই ট্রিপের নেতৃত্বে ছিলেন। ঠিক দেড়টায় ফোর্টইয়র্কে সবার উপস্থিত থাকবার কথা থাকলেও কেউ কেউ বেশ দেরি করেই এলো। সবার আগে সেখানে পৌঁছুলাম আমি আর জোয়ানা নামের একটি মেয়ে। বরাবরের মতো যথাসময়ে পৌঁছুতে পারব কিনা সন্দিহান ছিলাম। রাস্তাঘাট, দিক সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও পারিপার্শ্বিকতা নিরূপণ ও নির্ধারণ ক্ষমতা আমার কম; এমনকি সহজ রাস্তাও অনেকসময় ভুল করে ফেলি। তাই চিন্তিত ছিলাম। আগের দিন গুগল সার্চ করে কীভাবে সে স্থানে পৌঁছানো যায় সেটা দেখেছিলাম। দেখে খুব সহজ লাগল বলে চিন্তায় পড়লাম। ফোর্টইয়র্ক নাম শোনার পর ভীতি কাজ করছিল ভেবে যে, যাওয়াটা বোধহয় কঠিন হবে। আর যথারীতি সবার পরে আমি সেখানে উপস্থিত হবো।

স্থানটা টরোন্টোর ভেতরেই এবং সেখানে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। যাইহোক, টিটিসি (টরোন্টো ট্র্যানজিট কমিশন)-এর রুট দেখলাম। আমাদের ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে ওয়েস্টবাউন্ড ট্রেনে যেতে হবে বাথার্স্ট স্টেশনে, সেখান থেকে ৫১১ স্ট্রিট কারে নামতে হবে ফোর্টইয়র্ক অ্যাভেনিউতে। সেখান থেকে হেঁটে যেতে হবে ফোর্টইয়র্কে। মোট সময় লাগবে একঘন্টা দশ মিনিট।

একসময় পৌঁছুলাম ফোর্টইয়র্ক অ্যাভেনিউতে। স্ট্রিট কার থেকে নেমেই দেখতে পেলাম ফোর্টইয়র্ক লেখা। তবে সেটা দেখতে মেইন রাস্তার পাশে সাবওয়ে স্টেশনে ঢোকার আউটলেটের মতো। অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড বাইপাসের মতো। ঢোকার মুখেই দেখা হলো জোয়ানার সাথে। আমাদের সাথে পড়ে। জোয়ানা আর আমি একসাথে নেমে পড়লাম সিঁড়ি বেয়ে। তারপর আমার ডান-বামে তাকিয়ে বিস্ময়পোহত হলাম। বামদিকে দেখলাম মাথার ওপরে সড়কপথ ও তারপর ফøাইওভার। আর ডানদিকে? এক আজব দুনিয়া। আজব বৈকি, গ্রেটার টরোন্টো এলাকাতে এমন প্রান্তরের মতো জায়গা স্থানে স্থানে থাকলেও ফোর্টইয়র্কের ভেতরের মতো এমন ঢেউখেলানো উঁচুনিচু ও এত দিগন্ত প্রসারিত নয়।
ফোর্টইয়র্ক আদতে একটা দুর্গ, আর এটা টরোন্টোর ফোর্টইয়র্র্ক সংলগ্ন এলাকায় উনিশ শতকের প্রথম দিকের একটি সামরিক দুর্গ। দুর্গটি ব্রিটিশ ও কানাডীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের থাকার জন্য এবং টরন্টো হারবারের প্রবেশদ্বার রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। দুর্গটিতে পাথরের রেখাযুক্ত মাটির কাজের প্রাচীর এবং আর এই প্রাচীরযুক্ত স্থানে আটটি ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে, যার মধ্যে দুটি বøকহাউস। দুর্গটি ফোর্টইয়র্র্ক জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানের অন্তর্ভুক্ত। এটা একটি ১৬.৬ হেক্টর (৪১-একর) সাইট যাতে দুর্গ, গ্যারিসন কমন, সামরিক কবরস্থান এবং একটি ভিজিটর সেন্টার অবস্থিত।

যাইহোক, আমি ও জোয়ানা ঢাল দিয়ে নেমে গেলাম। কিছুদূর এগুতেই আমাদের ক্লাসের আরও দুয়েকজনকে দেখলাম। তারা আসছে বিপরীত দিক থেকে। পরে জানলাম, যেখানে ফোর্টইয়র্ক মিউজিয়ামের নতুন বিল্ডিং (প্রদর্শনী/রিসেপশন) হয়েছে? সেদিক দিয়েও ঢোকা যায়। আমার ও জোয়ানার সাথে যোগ দিল এগিয়ে আসা দলটা। আমরা দুর্গে ঢোকার মুখে একজন সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম। সে আমাদেরকে ক্যান্টিনে ঢুকতে বলল। জানাল, সেখানে আমরা হয়তো তথ্যাদি পেয়ে যাব। সেটা ছিল একটা ক্যান্টিন-কাম-স্যুভেনিয়ের শপ। সেখানে ঢুকে আমাদের ইনস্ট্রাক্টর কেন্-কে দেখতে পেলাম। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে উল্টোদিকে চললাম নতুন বিল্ডিং-এর দিকে। স্বল্পসময়ে ক্যান্টিনটার ভেতরে অবস্থান করে সেখানের বিভিন্ন প্রকার স্মারক ও কফি-ফাস্টফুডের দিকে মনটা ক্ষণিকের জন্য আটকে রইল। ভেতরটায় ছিল ওম। আর বেশ আরামদায়ক ও ‘মাই সুইট হোম’ গোছের পরিবেশ। ওপরে টালির ছাত, আকারে খুব বেশি বড় নয়। আমি তখনও ভাবতে পারিনি সেদিন আরও পরে, অনেকটা সময় ধরে আমাকে এই ক্যান্টিনে বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

এখানে ফোর্টইয়র্ক সম্পর্কে আরেকটু বর্ণনা না দিলে এই অংশের বিবরণলিপি অসমাপ্ত থেকে যাবে। ফোর্টইয়র্ক একটি সামরিক দুর্গ ও টরোন্টো শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটা ১৯২৩ সালেই কানাডার জাতীয় ঐতিহাসিক সাইটের মর্যাদা পায়। আপার কানাডা অঞ্চলের নতুন রাজধানি রক্ষার উদ্দেশ্যে আঠারোশ’ ও উনিশশ’ শতকে ব্রিটিশ আর্মি ও কানাডীয় মিলিশিয়া বাহিনি এই দুর্গ নির্মাণ করেছিল প্রধানত সদ্য স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক হামলার হুমকির আভাস পেয়ে।

১৭৯৭ সালে টরোন্টোর গ্যারিসন ক্রিক-এর পূর্ব তীরে বর্তমান বাথার্স্ট স্ট্রিটে একটি গ্যারিসন নির্মিত হয়। পরে ১৮১৩ সালে একটি যুদ্ধে (ব্যাটল অব ইয়র্ক) গ্যারিসনটি ধ্বংস হয়। আজকের ফোর্টইয়র্কের অনেকটাই পুননির্মিত হয় সেই শতকেই যুদ্ধের পর। বাথার্স্টের পশ্চিম এলাকাজুড়ে ফোর্টইয়র্ক পুননির্মিত হয়। ফোর্টইয়র্কের ভবনগুলো আজকের টরোন্টোর সবচাইতে পুরোনো ভবনগুলোর অন্যতম। যুদ্ধের আগের কেল্লাগুলো ছিল কাঠের নির্মাণ। পরে যেগুলো নির্মাণ করা হয়, সেসব ছিল কাঠ ও ইটের সংমিশ্রণ। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়; সেটা হলো যুদ্ধের পর যে কেল্লাগুলো নির্মাণ করা হয়, সেসব আঠারোশ’ শতকেই নির্মিত হয়েছিল এবং পরে কোনো যুদ্ধে সেসব ধ্বংস না হবার কারণে আজও সেসব প্রাচীন স্মারক হিসেবে রয়ে গেছে।

দি সিটি অব টরোন্টো ১৯৮৫ সালে মূল ফোর্টইয়র্ক ও কাছাকাছি অস্ত্রাগারসমূহকে হেরিটেজ কনজারভেশন ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে ঘোষণা করে।

আমরা নতুন ভবন, রিসেপশন প্রদর্শনী দেখলাম। সেই শতেরোশ’/আঠারোশ’ সালের সৈন্যদের পোশাক, চিঠিপত্র, আদেশ, সৈন্যদের বেতন-বই, হাজিরা খাতা-সবই সংরক্ষিত আছে। আর আছে অস্ত্র ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। মিউজিয়ামের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোক (কেভিন) আমাদেরকে ব্রিফ করলেন।

এরপর দুর্গ ঘুরে দেখার পালা। মানে যেদিক দিয়ে আমি ও জোয়ানা ঢুকেছিলাম, সেদিকেই ফিরে যাব। যেখানে প্রান্তরজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন কামান ও অন্যান্য স্মারক। লম্বা-টানা নতুন বিলাসী ভবনের একটি ওয়াশরুমে ঢুকলাম আমি। বের হয়ে দেখি সঙ্গী-সাথীরা কেউ নেই! রিসেপশনের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে জানাল, ওরা সবাই বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেল? সে বলল, পুরোনো বিল্ডিং দেখতে। আন্দাজ করলাম, যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেখানে কিছুদূর গেলেই গাছপালার তলে ক্যান্টিন, তারপর মূল দুর্গে ঢোকার চেকপোস্ট। সেখানে সিকিউরিটি গার্ড থাকে।

জাদুঘরের লোকটা আমাকে পেছন দিক থেকে বের হবার রাস্তা দেখিয়ে দিল। বের হবার মুখে ভারী অবাক হলাম। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে! এখন এই এতটা পথ কীভাবে হেঁটে যাব? কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দাঁড়ালাম বড় বড় থামের ওপর শুয়ে থাকা শেডের নিচে। একটা সিগারেট ধরালাম; যদিও জানি ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ সমস্ত এলাকাজুড়ে। বৃষ্টি থামার কোনো ইঙ্গিত দেখলাম না। একটা সময় মনে হলো কিছুটা যেন ধরে এসেছে বৃষ্টি। মূল দুর্গের উদ্দেশ্যে প্রায় দৌড়ে চললাম। পরনে জিন্স ও কেডস থাকায় দৌড়ানোর কাজটা সম্পন্ন করতে পারছিলাম। দ্রুতই পৌঁছুলাম সেই ক্যান্টিনে। তবে বেশ খানিকটা ভিজে গেলাম। ক্যান্টিনের পেছনের দরজা দিয়ে দেখলাম থরে থরে সাজানো দানবাকৃতির ও প্রকৃতির মতো কেল্লাগুলো। কোনটায় যাই প্রথমে? কোন্ কেল্লাটায় আমার সাথীরা আছে? শেষে আবার ছোট্ট একটা দৌড় দিয়ে সবচেয়ে কাছের কেল্লাটায় ঢুকে গেলাম। ভারি দরজা ঠেলে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। একটা প্রাণীও নেই ভেতরে। মাথার অনেক ওপরে ছাত। পুরো ঘরজুড়ে অস্ত্রশস্ত্র আর যুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক। একটা ভয়ের অনুভূতি খেলে গেল। বোধহয় দুইমিনিটও ছিলাম না ভেতরে, আবার ফিরে এলাম ক্যান্টিনে। যা হবার হোক। আমি বø্যাক কফি ও বিফ বার্গার নিলাম। খেতে খেতে স্যুভেনিয়েরগুলো দেখতে পেলাম। অনেক জীবজন্তুর নখর-দাঁত-হাড়ের তৈরি গহনা আর শো-পিস। এসব জীবজন্তুর মধ্যে ভালুক, কয়োটি, ওলভারিন, নেকড়ে ও বিভার। এগুলো সত্যিকারের। তবে কিনলাম না; কারণ আমি আগ্রহী ছিলাম জীবজন্তুর আলাদাভাবে হাড়-নখ-দাঁত কিনতে। কিন্তু সেসব আলাদাভাবে ছিল না। আরও অনেক স্যূভেনিয়ের ছিল দোকানজুড়ে। অধিকাংশই রিপ্রোডাকশন। যাইহোক, ততক্ষণে ফোর্টইয়র্কের বাকি কেল্লাগুলো দর্শনের ইচ্ছে উবে গেছে। বৃষ্টি তখনও চলছিল। ক্যান্টিনে তখন আমি ছাড়া আর দু’জন ছিল। একটা শ্রীলংকান মেয়ে ও অন্যজন সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছেলে। কফি খেতে খেতে কিছুক্ষণ ওদের সাথে কথা বললাম। ছেলেটার কাছে জানতে চাইলাম বাইরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ফুঁকতে পারি কিনা। সে বলল, ‘পারো, তবে নিষিদ্ধ। তুমি বাইরে গিয়ে চুপচাপ টেনে আসতে পারো। আমি কাউকে বলব না।’

তো বাইরে গিয়ে কাজ সেরে ফের ক্যান্টিনে ঢুকলাম। এইসময় মেয়েটাকে দেখলাম। মাঝারি উচ্চতার ফর্সা ডিম্বাকৃতির মুখের এক অল্পবয়সী সুশ্রী মেয়ে। সে একটা পোটলা ও একটা ব্যাগ ক্যান্টিনে রাখার অনুমতি চাইল। ক্যান্টিনের মেয়েটা সেটা রাখল। এবার আগন্তুক মেয়েটা একটা টেলিফোন করার অনুমতি চাইল। অনুমতি পেয়ে টেলিফোন করে সে কিছুটা রাগত আর কিছুটা অভিমানী ভঙ্গিতে কথা বলল।

মেয়েটা একজন সিকিউরিটি গার্ড আর সে সুপারভাইজারের কাছে সাইন-আউটের অনুরোধ করছে কিন্তু সুপারভাইজার কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। তবে মেয়েটি মেয়ে হবার কারণে, আরও বিশদভাবে বললে বলতে হয়, তরুণী মেয়ে হবার কারণে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যায়, তার সবটাই আদায় করার চেষ্টা করছিল। সেটা আরও স্পষ্ট হলো কিছুক্ষণ পর।

মেয়েটি টেলিফোন ছেড়ে দিলে আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে? মেয়েটির উত্তরে বুঝলাম সে খুবই অপরিণত এবং সিকিউরিটি লাইনেও অনভিজ্ঞ। সে জানাল, তার কিছু সমস্যার কারণে সে আগেভাগে চলে যেতে চাইছে কিন্তু সুপারভাইজার রাজি হচ্ছে না। সে আরও জানাল, তাকে রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে হবে। বললাম, তোমার সমস্যা বুঝতে পারছি। তবে তুমি যেভাবে সাইন আউট করতে চাচ্ছ তা নিয়মের মধ্যে পড়ে না। ডিউটিতে আসার আগে তুমি তাদেরকে জানাতে পারতে তুমি আজ ডিউটি করতে পারবে না। মেয়েটি কী বুঝল কে জানে, তবে সে বলতে লাগল ‘আই ডোন্ট লাইক ক্যানেডা।’ তারপর আরও অনেক প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সে ইরানের মেয়ে আর তার নাম শহর। বললাম, তুমি পড়াশোনা না করে এই লাইনে ঢুকেছ কেন? সে বলল, পড়াশোনা এখানে কিছু করেছি। চাকরি এখনও পাইনি; সিকিউরিটির কাজ করে কিছু পয়সা রোজগারের চেষ্টা করছি।
মেয়েটির দায়িত্ব ছিল চেকপোস্টে কোনো গাড়ি থামলে সুইচ টিপে বার উঠিয়ে গাড়ি পার করে দেয়া। কিন্তু ক্যান্টিনের বাইরের শেডে দাঁড়িয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে দেখছিলাম একটা ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার নিজেই নেমে বার উঠিয়ে পার হয়ে গেল। দ্বিতীয় একটা গাড়ি এসে থেমে একই কাজ করল। মেয়েটি এবার এগিয়ে গিয়ে বলল, সরি। আমি একটু ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম আমার লাগেজ রাখার জন্য। ভদ্র ড্রাইভার গলে গেল। উদার হাসি দিয়ে বলল, ‘ইট’স অলরাইট।’ ভাবলাম, এইসব ক্ষেত্রে মেয়েদের জয় হয়। জোড়াতালি দিয়ে পার পেয়ে যায়। ছেলেরা সেটা পারে না।

এরপর যেটা ঘটল, তাতে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। মেয়েটা বলল, ‘তোমার কি একটা রেইনকোট দরকার?’ বললাম, ‘পেলে ভালো হয়। কিন্তু কোথায় পাব?’ (ততক্ষণে আমার মাথা থেকে ফোর্টইয়র্কের বাকি কেল্লাগুলো দেখা ও সঙ্গীদের খুঁজে বের করার চিন্তা বেমালুম উধাও হয়ে হয়ে গেছে। বাসায় কীভাবে পৌঁছুব, সেই চিন্তা পেয়ে বসল আমাকে। সেলফোনে সময় দেখলাম বিকেল সাড়ে তিনটা।)

একটু পরেই একটা হাঁক ছাড়ল মেয়েটা। সেই হাঁক-ডাক শুনে এগিয়ে এলো এক সিকিউরিটি গার্ড। সে চেকপোস্ট পার হয়ে বাইরের দিকে কোথায় যেন যাচ্ছিল। মেয়েটি রীতিমতো আদেশের সুরে বলল, ‘গিভ আ রেইনকোট টু দিস জেন্টলমেন।’ সিকিউিরিটির ছেলেটা হাতে ধরা প্যাকেট থেকে একটা পাতলা রেইনকোটের প্যাকেট আমাকে দিল। তারপর সে চলে গেল। ইতোমধ্যে আমরা নানা আলাপ জুড়ে দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটি সর্বক্ষণ বকবক করতে লাগল তার লাগেজের ব্যাপারে। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেলে সে এই বৃষ্টিতে মালপত্র কোথায় রাখবে। বৃষ্টিতে ক্যান্টিনের বাড়তি স্থানটুকু ভিজে গেছে। আমি বললাম,‘একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তুমি কি কফি বা ¯œ্যাক্স খাবে?’ মেয়েটা বলল, ‘আমার কাছে পয়সা নেই।’ বললাম, ‘আমি খাওয়াব।’ মেয়েটা তখন বলল, ‘আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি।’ বলে সে প্রথম কেল্লাটার দিকে চলে গেল। মেয়েটি অনেকসময় নিয়ে ফেলল। ততক্ষণে ক্যান্টিনের মেয়েটা বের হয়ে আমাকে বলল, ‘তুমি এই লাগেজগুলো রাখো। আমরা চলে যাচ্ছি।’ আমার টনক নড়ল, বললাম, ‘সে কী, আমার তো কফি-¯œ্যাক্সের দরকার।’ মেয়েটি বলল, ‘সব গুটিয়ে ফেলেছি।’ ভেতরে একটা হায়-হায় ভাব খেলে গেল। কফিটা আগেই নিয়ে রাখলে পারতাম। কিন্তু আমি তো আর জানি না ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়েটি জানত। কিন্তু সে তো ওয়াশরুমে গিয়ে আর ফিরে আসল না!

শহর একসময় ফিরে এসে আমার হাতে তার লাগেজ দেখল। আমি সব খুলে বললাম। মেয়েটা বলল, ‘তুমি এখন চলে যেতে পারো।’ কিন্তু আমি যেতে চাইলাম না। মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম রেইনকোটের কারণে। এরপর সে আরও অনেক কথা বলল, রাতে নাকি অনেক অ্যানিমেলস আসে। কী ধরনের প্রাণী? সে জানাল, স্কাঙ্ক, র‌্যাকুন-এসব। এরপর সে যে কাজটা করল, তাতে আমি একটু লজ্জিত হলাম আর যার প্রতি সে এই আচরণ করল তার কথা না হয় না-ই বললাম। সে একজনকে ডাকল যে তখন জায়গাটা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। বুঝলাম সে-ই সুপারভাইজার। লোকটি একটু ইতস্তত করে শেষে এগিয়ে এলো। শহর বলল, ‘আমাকে কিছু বোর্ড বা নিউজপেপার এনে দাও। আমার লাগেজ রাখব।’ লোকটি বলল, ‘সরি। বোর্ড কোথায় পাবো।’ এর জবাবে মেয়েটি আবার পুরোনো প্রসঙ্গ টানল। কেন সে সাইন আউট করতে পারবে না। কেন তাকে এমন সময়টায় ডিউটিতে ফেলল ইত্যাদি। লোকটি ধৈর্যসহকারে মেয়েটির প্রলাপ শুনে গেল। তারপর জানাল নিয়মকানুনের কথা। এরপর বিড়বিড় করতে করতে স্থানটা ত্যাগ করল।

এবার আমার যাবার পালা। তবুও যাচ্ছিলাম না। আসলে যে স্থানটা দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেটা দিয়ে বেরিয়ে তারপর কোথা থেকে বাস বা স্ট্রিট কার ধরব, সেটা আমার জানা ছিল না; বৃষ্টির মধ্যে খুঁজে বের করাও সম্ভব না। আমার উদ্দেশ্য বাথার্স্ট সাবওয়ে স্টেশনে পৌঁছানো-সেখান থেকে সোজা ভিক্টোরিয়া পার্কে। মেয়েটাকে বললাম। সে সোজা পথ বাতলে দিল। বলল, সোজা নতুন বিল্ডিং ক্রস করে মেইন রাস্তায় উঠে যেতে সেখানে স্ট্রিট কার মিলবে। অগত্যা মেয়েটার কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে পাতলা রেইনকোট গায়ে হাঁটতে লাগলাম। একসময় মেইন রাস্তায় উঠলাম। পৌঁছূলাম চার রাস্তার মোড়ে। এখানে বাস স্টপ দেখতে পেলাম। রাস্তা পার হয়ে একটা স্টপে এসে থামলাম। আমি খুঁজছি ৫১১ নম্বরের স্ট্রিটকার। যে স্টপে এলাম, সেখানে বাসও থামে, স্ট্রিটকারও থামে। একসময় দেখলাম একটা স্ট্রিটকার এলো; সেটা ৫১১। এখন সেটা বাথার্স্ট স্টেশনে যাবে, নাকি উল্টোদিকে যাবে-তা জানিনা। যেখানেই যাক। কোনো এক জায়গায় তো থামবে। আমার কাছে পাস ছিল, কাজেই ভাড়ার চিন্তা ছিল না। স্ট্রিট কারে চড়ে থিতু হয়ে বসলাম। একটু ঝিমুনিমতো এসেছিল। তারপর একসময় সচেতন হয়ে দেখলাম আসার পথে যেসব স্টেশন পার হয়ে এসেছিলাম, সেসব স্টেশনের নামই উঠছে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে। তার মানে বাথার্স্টেই যাচ্ছে সেটা।

তারপর তো একসময় পৌঁছূলাম বাসায়, যদিও বাথার্স্ট থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনের দূরত্বটা খুব বেশি ছিল।

এখানে একটু বলে নিই, যে উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ শিক্ষাসফর, আর শিক্ষালাভ?দুটোই মাঠে মারা গেছে। বৃষ্টির মধ্যে আমি কয়েকবার প্রত্যেকটা কেল্লা উঁকি দিয়েও বুঝতে পারিনি কোথায় আমার সহপাঠী আর আমার শিক্ষক কেন্। কেন্ কী ভাববে, বা বিষয়টা কীভাবে নেবে ভেবে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। সব রেকর্ড ভঙ্গ করে যদিও সবার আগে আমি পৌঁছুলাম কেল্লায় কিন্তু কেল্লা ফতে তো হলো না। শেষে একটায় তাদেরকে খুঁজে পেলাম। ফোর্টইয়কের একজন গাইড ব্রিফিং করছিল। শ্রোতা আমার সহপাঠীরা ও কেন্। লোকটা আমাকে অনুপ্রবেশকারী মনে করে বলল, এখানে একটা সেশন চলছে। কেন্ আমার পক্ষ নিয়ে জানাল যে, আমিও শিক্ষার্থীদের একজন। এখানের শিক্ষার পরই বেরিয়ে আমি ফের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। কারা কোথায় কোন্ দুর্গে ঢুকল বুঝতেই পারলাম না। শেষে মনে মনে বললাম, চুলোয় যাক শিক্ষা।

আমি জীবনভর লেখাপড়ায় চরম উদাসীন থেকেও চালিয়ে গেছি উচ্চস্তরের লেখাপড়া। আমি জানি, এবং স্বীকার করি, জীবনে আমার নানাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ আমার উদাসীন/স্বাধীন মন ও স্বেচ্ছাচারিতা।

কালচার ও হেরিটেজে পড়াশোনাকালীন ফোর্টইয়র্ক দর্শন ও শহর নামের সেই মেয়েটির সাথে আমার দেখা হবার ঘটনাবলি আমার মানসপটে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।