হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

এলোমেলো শব্দের পদাবলি-২

বালুকা বেলা কলামে আমার আগের প্রকাশিত এপিসোডের রেশ ধরে এলোমেলো শব্দের পদাবলি-২ শিরোনামে আমার কিছু অনুভূতি প্রকাশ করব। আজও সঙ্গীত প্রসঙ্গ। আগের লেখা ও কতিপয় ফোরামে আমি বলেছিলাম যে, আমার সঙ্গীত শিক্ষার গুরু ছিলেন কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী প্রয়াত বশির আহমেদ। তার কাছে শিক্ষালাভ করাটা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক বলা যায়। কেননা তিনি নিজেই ছিলেন একটা একক প্রতিষ্ঠান। রাগ বিলাওয়াল বা বিলাবল দিয়ে আমার সঙ্গীত শিক্ষার শুরু। যদিও তার মতো গুণীজনের কাছে যাবার আগেই আমি নিজে থেকেই হারমোনিয়ামে সুর তুলতে শিখে যাই। তবে, এটা বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছিল যে, হারমোনিয়ামে সুর তুলতে পারাটাই সঙ্গীত শিক্ষার একমাত্র প্যারামিটার নয়। আমি পিপাসার্ত ছিলাম। ওস্তাদজী বশির আহমেদ এর কাছে যাবার বহু আগে থেকেই আমি ওস্তাদজীর গানের ভক্ত ছিলাম। ওস্তাদজীর সান্নিধ্যে আসার পর আমার কনফিডেন্স লেভেল উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এটা একটা সাইকোলজিকেল ফেনোমেনন। আর অবশ্যই পরশ পাথরের মতো, যার সংস্পর্শে এলে সব খাঁটি হয়ে যায়।

ওস্তাদজী একবার আমার বাসায় (বিক্রমপুর হাউস, যা এখন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে) পদধূলি দিয়েছিলেন। সে অনেক বছর আগের কথা। আমি তাকে তারই বিখ্যাত গান ‘তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে’ শুনিয়েছিলাম। সে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ওস্তাজী সুরে-কন্ঠে প্রীত হয়েছিলেন; তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন আমার আগ্রহ দেখে।

এত যে আয়োজন আর তার গানের জন্য আমার এত প্যাশন, তাহলে গানে আমি কেন পিছিয়ে? কেন আমি বিলম্বিত। কেন প্রতিভা বিকাশে-স্ফুরণে আর প্রচারে এত পিছুটান। এই কারণটি আমি আগেও বলেছি। গান আমার শিরায় শিরায় বয়ে গেলেও লেখালেখির বিষয়টাও আমার রক্তে বইছিল। গানের আগেই লেখায় আমার যৎসামান্য স্বীকৃতি আসতে শুরু করে তখন। সেইসাথে যোগ হয় লেখক আড্ডা ও অন্য লেখক কবিদের সাথে ভাব বিনিময়। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি। এভাবে লেখাটাই প্রাধান্য পেয়ে যায়।

কিছুটা পারিবারিক দুর্যোগ, বিয়ে-সংসার আর কিছুটা বৈষয়িক তাড়ণায় তড়পিয়ে শেষে গানের জগতেই অনুপস্থিত থাকলাম অনেকবছর। ভুল করেছিলাম। শত ব্যস্ততা বা জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থেকে একটা-দু’টা গল্প বা প্রবন্ধ লিখতাম। প্রকাশও করতাম। কিন্তু হারমোনিয়াম নিয়ে চর্চায় বসতাম না। এই সামান্য শ্রমটুকু যদি দিতাম! আপসোস হয় আজ। কিন্তু যা গেছে, তা তো ফিরিয়ে আনবার নয়। একসময় সুদূর ক্যানেডা হাতছানি দিয়ে ডাকল। চলে গেলাম সেই দেশে। সেখানে অবশ্যি স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম নিয়ে বসতাম। গানের আসরে-স্টেজে গান করতে শুরু করি সেইদেশে, কিছুটা থিতু হবার পর। তারপর গান গাইবার গতি প্রবাহিত হতে থাকে। ক্যানেডা ও বাংলাদেশে ব্যাক অ্যান্ড ফোরথ পদ্ধতিতে গান চলতে থাকে। সেইসাথে চলল লেখালেখি ও বই প্রকাশ। জীবন তো থেমে থাকে না। কোনো না কোনো ভাবে তা চলতে থাকে। এখন জীবন বেলার এই প্রান্তে এসে গান-লেখা দুটোই চলছে। মন্দের ভালো।

আজ এখানে আমি কিংবদন্তি মান্না দে’র কথা আবারও কিছু বলতে চাই। প্রকৃত অর্থে গুরু মান্না দে সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। শতবার বলেছি, কিন্তু মান্না দে সম্পর্কে বলাটা ছোটো গল্পের মতো- ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ।’

আমি সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক মেয়াদও সমাপ্ত করিনি আবার কোনো শর্টকটাও বেছে নিইনি। তাই সঙ্গীতকে আমি আমার ‘If music be the food of love, play on.’(Twelfth Night-Shakespeare) গোত্রভুক্ত করে মান্না দে’র ভক্ত হয়েছি আর তার দুয়েকটি গান গাইবার চেষ্টা করেছি। গায়ক হতে চাইনি। যদিও আমার মাঝে ‘গায়ক হবার সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান’ বলে অনেক পোড়খাওয়া বন্ধু বা বিদগ্ধ ব্যক্তি মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যথার্থ অর্থে আমি বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হতে চাইনি। চেয়েছি নিভৃতে দুয়েকটি গান গাইতে। সাহিত্য যেমন জীবনের প্রতিচ্ছবি, তেমনি সঙ্গীতও কিন্তু মনের প্রতিচ্ছবি। এর জলজ্যান্ত একটা প্রমাণ আমি নিজে। তখন অগাস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম। স্থান কোলকাতা। সময় দুপুর। ওপেন মার্কেট আর এসি মার্কেটে ঘুরাঘুরি করছিলাম। ওপেন মার্কেটের সামনে দিয়ে বিশাল ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। আসলে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম, আরো খোলাসা করে বলতে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলাম লোয়ার সার্কুলার রোডে। দুইপাশের পুরোনো ইমারতগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এখানেই কোথাও ছিল আজাদ পত্রিকা অফিস আর তাতে বসে আমার আব্বা সাংবাদিকতা করছেন! আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই, ভালো লাগছে আবার ক্লান্তিও ভর করেছে। একটা জায়গায় দেখলাম কিম্ভূত আকারের একটা চাপকল, তাকে ঘিরে মহিলা ও পুরুষেরা ভিড় করেছে, পানি নিচ্ছে। স্নান করছে, কথা বলছে। জায়গাটা অপেক্ষাকৃত খোলামেলা ও গাছপালায় ঢাকা। তীব্র গরম, গাছপালার ফোকর দিয়ে রোদের আলপনা। এইসময় শুনতে পেলাম সেই সঙ্গীতটি। কোথায় যেন তা বাজছে। আসলে বাজছে আমার বুকের গহিনে! ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, একি বেদনার মতো বেজেছে আবার হারানো সেদিন…।’ এরকম নস্টালজায় খুব কমই আক্রান্ত হয়েছি এযাবৎ। কে গাইছিলেন গানটি? আর কে? সেই মহাগুরু, মানে মান্না দে! ছোটোকাল থেকেই মামা-খালাদের মুখে শুনেছি সতীনাথ, হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, সুবীর সেন, জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সায়গল, গীতা দত্ত, মাধুরী, সন্ধ্যা আর লতার গান। তখন মান্না দে’র গান শুনতাম না। অথচ মান্না দে’র বহু আগের হিট বাংলা গান আছে যা আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি পরপারে চলে গিয়েও এখনো তুঙ্গে।

তাহলে মান্না দে’র গান শুনতাম না কেন মামা-খালাদের মুখে? আসলে গাওয়া যায় না গুরুর গান। শুধু মন ছুঁয়ে যায়, ভেতরে অনুরণন ওঠে, কিন্তু মুখনিঃসৃত হয় না। গুরুর গায়কী, কন্ঠ, ক্লাসিক্যাল বেইজ, সর্বভারতীয় আবেদন, (অনেকের ভাষায় ‘আলাদা একটা কিছু’)-সবকিছুই যে তার একান্ত নিজস্ব। মান্না দে’র নিজের ভাষাতেই সেটা ‘একটু অন্যভাবে।’ এই ‘অন্যভাবে’টা ধরতে হলে মনে হবে মরীচিকার পেছনে ছুটছি। এসব কারণেই মান্নার গান শুনতাম না তাদের মুখে। হেমন্তের গান শুনতে পেতাম। কারণ হেমন্তের সেই সোজাসাপ্টা মিঠে ভরাট গলাটাই ছিল তার অসাধারণত্বের প্রধান মাপকাঠি। তার গান গাইতে হলে সুরটা হয়তো কব্জা করা যেত। কিন্তু কন্ঠটা কোথায় মিলবে? তেমনিভাবে কিশোরকুমারের গানও তো গাওয়া যেত, কিন্তু তার সেই স্টাইল ও ঈশ্বরপ্রদত্ত কন্ঠ কে নকল করতে যাবে? তাই কিশোরকুমারের গানও সুষ্ঠুভাবে আমাদের পক্ষে গাওয়া সম্ভব না। শ্যামল মিত্রের ক্ষেত্রেও তাই। তবু তার গান গাওয়া যায় সুরের গতিটা ধরে ফেলতে পারি বলে। কিন্তু তারপরেও কথা থাকে। শ্যামলের মতো এত মেলোডি, এত দম আর এত এনার্জি কোথায় পাব? অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন আমার সাথে। কিন্তু আমি বলব, ভারতীয় আধুনিক সঙ্গীতের (প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবেও) চার দিকপাল হলেন: হেমন্ত, মান্না দে, কিশোরকুমার আর শ্যামল মিত্র। আর যাদের গান আমরা এখনো গুনগুন করে গেয়ে থাকি, মামা-খালারা গাইতেন, তারা ছিলেন পপুলার, কিন্তু দিকপাল নন। তেমনিভাবে গায়িকাদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তারই বোন আশা ভোঁসলে আরো এক দিকপাল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলা যায় বাংলা গানের একক সম্রাজ্ঞী। তুলনাহীন এবং চিরকালিন। তার সেই ‘মধু মালতী ডাকে আয়, ফুল ফাগুনের এ খেলায়…’ বা ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারার এই মাধবী এই রাত’, কিংবা ‘পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমারে মায়াময় এই মধু সন্ধ্যায়,’ আজো মনে দাগ কেটে যায়।

২০১১ সালে টরোন্টোতে অবস্থান করে ইউটিউবে একটি একক গানের আসরে সন্ধ্যা’র গান শুনে থ’ হয়ে গেলাম। গানের আসরটি হয়তো বছরদুয়েক আগের ছিল। ২০১১-তে সন্ধ্যা’র বয়স ৮০। তার মানে ৭৮ বছর বয়সে তিনি সেই আসরে গান গেয়েছিলেন। এই বয়সে তার কন্ঠের ধার, বিপুল প্রাণশক্তি ও স্ট্যামিনা আমাকে অবাক করে দিল। চোখ বন্ধ করে ইউটিউবে তার গাওয়া ‘ঘুম ঘুম চাঁদ’ শুনলাম। মনে হলো সতেজপ্রাণ কোনো তরুণী যেন গানটি গাইছে!

চলছিল গুরুর প্রসঙ্গ। …একটু অন্যভাবে-মানে কথা-সুর-গায়কী-মেলোডি-বেইজের মেলবন্ধন দিয়ে ব্যক্ত করা আরকি। এই কাজটি একদিনে করেননি মান্না, করেছেন তার সুদীর্ঘ ষাট বছরের সাধনায়। যিনি ৯২ বছর বয়সেও প্রত্যহ দুইঘন্টা নিয়মিত রেওয়াজ করতেন এবং বলতেন যে তখনো তিনি শিখছেন, তার সাধনার ব্যপ্তি কতটা বিস্তৃত সেটা আমাদেরকে একটু ভাবতে হবে বৈকি। কিশোরকুমার-হেমন্ত-রফি’র মতো অতি অলৌকিক কন্ঠ মান্না দে’র ছিল না। কিন্তু সেটা তিনি পূরণ করেছেন সেই ‘একটু অন্যভাবে।’ ‘ডাউন টু আর্থ’ কথাটা বুঝি শুধু মান্না দে’র ক্ষেত্রেই খাটে। বাণী ও সুরের সম্মিলনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন তিনি। তাই ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো…দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই, আমি তো মানুষ’ গাইবার সময় এর টোন, এর বাণী তার মায়াবী সুরের জালে অন্যরকম ডাইমেনশন পেয়ে যায়। যেমন ‘রিমঝিমঝিম বৃষ্টি’ গানটি যখন তিনি গাইলেন তখন মনে হবে সত্যিই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির একটি ছন্দ থাকে, সেই ছন্দটি প্রকাশ পায় মান্না দে’র বৃষ্টিভেজা সুরের জাদুকরি প্রভায়। সঙ্গীত প্রসঙ্গ আজ এতটুকুনই। অন্য একদিন আরও অনেক অনুভূতির কথা বলব। বালুকা বেলায় পদচারণা আজ এতটুকুই।