হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

আরো একটি বাংলা নববর্ষের আগমন হলো। কল্পনায় বালুকা বেলায় বিচরণ করে লিখে যাচ্ছি। চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে বৈশাখী হাওয়ার পরশ নিই। ইতোমধ্যেই বালুকা বেলা কলামে অনেকগুলো এপিসোড তৈরি করেছি। বালুকা বেলায় হেঁটেছি, সাধু-যোগী-ধ্যানীদের মতো মগ্ন হয়েছি পরের সংখ্যায় কী লিখবো-কী লিখবো ভেবে। ধ্যানস্থ হয়েছি ভেবে দেখার জন্য যে কেন সময় এতো দ্রুত চলে যায়? জরা, বৃদ্ধত্ব, বন্ধ্যাত্ব ও মৃত্যুর দিকে।

সময় খুব দীর্ঘ হয় দন্ডপ্রাপ্ত আসামী বা প্রতীক্ষারত কারুর জন্য। কিন্তু আর সব ক্ষেত্রে সময় খুব বেগে ধাবিত হয়। ছোটোবেলার বৈশাখী দিনগুলো আমার করোটির মধ্যে আজও থির জলে ভাসা পদ্মের মতো মূর্ত হয়ে আছে। আমি শহুরে ছেলে, তবে বৈশাখের কথা মনে হলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে গ্রামের সেই বৈশাখী হাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো ও গ্রামের মেলা। শৈশবে ও তারুণ্যে, গ্রামে, বিশেষত নানার বাড়ির সারি সারি গাছের মগডালে, শাখা-প্রশাখায় বৈশাখী বাতাস উড়ে যাবার স্মৃতি মনে আজও ভাস্বর। মনে হয়, এই তো সেদিনের স্মৃতি!
সেইসময় ঢাকায় বৈশাখী আগমন ও পহেলা বৈশাখ বরণ অতোটা বর্ণিল ছিল না। তবুও বৈশাখের আমেজ পেতাম ঢাকা শহর অনেক ফাঁকা থাকার কারণে ও গাছপালা-বৃক্ষলতার আধিক্যের কারণে।

টরন্টোতে অবস্থান করে বেশ ক’টি বৈশাখী প্রোগ্রাম করেছিলাম। তবে ২০১৪ সালের বৈশাখী প্রোগ্রামটা আলাদা হয়ে, বিশেষ আকারে আমার মনে দোলা দেয়। ওই বছরের পহেলা বৈশাখ এমন ব্যতিক্রমী হয়ে আসবে, তা ভাবতে পারিনি। পহেলা বৈশাখ এর আগের চারটি বছর এমনিতেই ব্যতিক্রমী কারণ দিনটি পালন করেছি কানাডায় অবস্থান করে। সেই ব্যত্যয়কে অতিক্রম করে সেইবারের বৈশাখ আরো রঙিন ও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠবে তা ভাবিনি।

আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। পড়াশোনার চাপ ছিল, ফাইনাল পরীক্ষা। আমার স্ত্রী জানাল ক্রেসেন্ট টাউন ক্লাবে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে, তার বান্ধবীরা ও তাদের বরেরা উপস্থিত থাকবে। আমি এক কথায় নাকচ করে দিলাম। শরীর খারাপ আর আমার লাগাতার পরীক্ষা ছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী’র বান্ধবীরা ফোন করতে লাগল।

টেনশন আমার আজীবন সঙ্গী। তার ওপর পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপে শরীরটা নাজুক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। কানাডায় আসবার পর আমার সামান্য মেদ হয়ে গিয়েছিল। প্রতি সামারে শরীরটা চকচকে আকার ধারন করে। কিন্তু সেই বছর এপ্রিলের শুরু থেকে শারীরিকভাবে ভালো বোধ করছিলাম না। মাত্র এক সপ্তাহে আমার শরীর শুকিয়ে বৈশাখী-কাঠ হয়ে গেল। পেট মিশে গেল। আর মাথা ঘুরানো ও অতিরিক্ত দুর্বলতা সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে রইল। কোনোক্রমে কলেজে যাচ্ছিলাম আর পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, সামারে আমার জার্নালিজম প্রোগ্রাম অফ থাকায় আমি সময়টা কাজে লাগাতে আর অন্যরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সেন্টেনিয়াল কলেজে একটা প্রোগ্রামে ঢুকেছিলাম।
১৩ তারিখ ছিল রোববার। আমার শরীরটা যাচ্ছে তাই খারাপ ছিল। সম্ভবত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। পরীক্ষা শেষ হলে আর নানা ধকল সামলে তারপর ডাক্তারের কাছে যাব বলে মনস্থ করেছিলাম। আমি তেরো তারিখের অনুষ্ঠান এড়াবার উদ্দেশ্যে ড্যানফোর্থ চলে এলাম। চুল কাটালাম ইউনিসেক্স সেলনে। সে অবস্থাতেও ফোন আসতে লাগল। আমার স্ত্রী ফোন করল আর তার বান্ধবীরা ফোন করতে লাগল। কেউ বুঝল না আমার মনের ও শরীরের অবস্থা। অগত্যা বাসায় ফিরে এলাম। এসময় এলো স্ত্রী’র বান্ধবী। আমাদের বিল্ডিংএর আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। (এখানে আমি নানা কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করব)। এর আগে কয়েকটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমি গান গেয়েছিলাম। স্ত্রী’র বান্ধবী এসে বলল, ‘আপনার সাথে দ্বৈত গান গাইব।’ একটু অবাক হলাম আমি। আমার স্ত্রী তাল মেলাল, বলল, ‘তোমরা ওই গানটা গাও না-তুমি সাত সাগরের ওপার থেকে আমায় ডেকেছো।’ শায়লা তাতেই রাজি হলো। এদিকে খানিক পরেই অনুষ্ঠান। শায়লা ও আমার স্ত্রী অনুষ্ঠানে চলে গেলে আমি গানটির লিরিক ডাউনলোড করলাম ইন্টারনেট থেকে। দুই কপি করলাম। অবশেষে গেলাম অনুষ্ঠানে। প্রচুর অনুরাগীর ভিড় দেখলাম। হল ভরে গেছে। আমার বুক ধুকপুক করছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে শায়লা আমাকে বলল, ‘একটু বাইরে গিয়ে কি গানটা প্র্যাক্টিস করা যায়?’ কাচের দরোজা ঠেলে বাইরে এসে গানটা প্র্যাক্টিস করলাম, মানে করালাম। শায়লার গলায় উঠছিল না গানটা। আমি ধরিয়ে দিলাম। সুরে ছিল না গানটা। সুরটা ধরিয়ে দিলাম।

তারপর তো দ্বৈতকন্ঠের গানটা গাইলাম। আমি এরপর গাইলাম কেনি রজার্স-এর সেই বিখ্যাত ও আমার অত্যন্ত প্রিয় সেই গানটি-‘লুসিল।’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল কানাডীয় লিবারেল পার্টির একজন এমপি নমিনেশন প্রার্থী। অনুষ্ঠানে এসেছে বাঙালিদের সমর্থন আদায় করতে। এমপি নমিনেশন প্রার্থী এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি চমত্কার ইংরেজি গান গেয়েছ।’

আমি ধন্যবাদ জানালাম তাকে। আমার অসুস্থতা, ব্যস্ততা আর পড়াশোনার কাজে এটুকু যে কোনোক্রমে সম্পাদন করতে পেরেছি, সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজারো কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার মধ্যে একটা বাজে সিম্পটম দেখা দেয়-কারণে অকারণে আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি। বিশেষত কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গেলে, কোনো সেমিনারে অ্যাটেন্ড করতে গেলে কিংবা কোনো প্রেজেন্টেশন করতে গেলে। এটা আমার আজন্ম বৈশিষ্ট্য কিনা জানি না। এই অনুষ্ঠানেও নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। তবে পুরোপুরি নার্ভাস হবার আগেই গানটা শুরু করেছিলাম। গানের মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে নিজকে ফিরে পেলাম। অনেকসময়ই ছোটোখাটো অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে ভড়কে গিয়েছিলাম। তবে প্রথম দুয়েকটি গানের পর নিজকে ফিরে পেতাম। শায়লা নাকি সেই দ্বৈতকন্ঠের গান ভিডিও করিয়েছিল। ক’দিন পর আমাদের চত্বরে ওর সাথে দেখা হলে সেকথা জানিয়েছিল সে।

এরপর আবারও সেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান, এপ্রিলের ১৪ তারিখে। আমাদের কলেজে। আমি পহেলা বৈশাখের অনেক চিত্র ও গান ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে এভিএস মুভিমেকারে ডকিউমেন্টারির মতো বানিয়ে নিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করেছি। টিচারদের উপস্থিতিতে ও প্রচুর খানাপিনায় অনুষ্ঠানটা ভালোই জমেছিল।

তারপর আবারও এলো আরো একটি দিন। ১৭ এপ্রিল। আমাদের প্রোগ্রামের কয়েকটি সেকশন মিলিয়ে। এবারও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টিচার অ্যাটেন্ড করল।

আমাদের সেকশনের সবাই বিভিন্ন খাবারের আইটেম নিয়ে গিয়েছিলাম। আগের দিন আমি আর আমার দুই বাঙালি সহপাঠী খাবার কেনা, বহন ও বন্দোবস্ত করলাম। তারও আগে আমরা এই তিনজন জান্নাত সুপার মার্কেটে গিয়ে খাসির গোশত কিনেছিলাম। অনুষ্ঠানের দিন প্রচুর খাবার খেয়ে একটু নির্জীবের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। এইসময় সংগীতচর্চার রব উঠল। আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী/পাঠিনী আমার নাম বলে উঠল। আমাদের টিচার ডেভিড ও ইরানি ম্যারিয়েম মুসাফা মহা উত্সাহে আমাকে পোডিয়ামের দিকে নির্দেশ করল। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যে অনেকেই ম্যারিয়েম আর আমাকে নিয়ে অনেক রসালো আলোচনা করল। ম্যারিয়েম দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। আমি জার্নালিজম পড়ছিলাম আর বর্তমান প্রোগ্রামের পর জার্নালিজমে ফিরে যাব-এটা ম্যারিয়েম জানত। আমাদের ফাইনাল প্যানেল প্রেজেন্টেশনের আগে ক্লাসে প্র্যাক্টিসের পর ম্যারিয়েম প্রকাশ্য ক্লাসেই বলল-‘হাসান, তুমি আমার সম্পর্কে লিখবে।’ তারপর ক্লাসে ম্যারিয়েম বলেছিল, ‘ডেভিড (টিচার) আর আমি তোমার সম্পর্কে আলোচনা করি।

আসলে ডেভিড আমার রাইটিং খুব পছন্দ করত। সেকারণেই হয়তো ম্যারিয়েমের কাছে সে আমার গুণকীর্তন করেছিল। ডেভিড এমনকি আমার টেস্টপেপারেও মন্তব্য করেছিল এভাবে: ‘ইয়্যূ হ্যাভ মাস্টারি ওভার ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ।’ যাইহোক, এসবের প্রেক্ষিতে আমার কতিপয় ক্লাসমেট আমাকে আর ম্যারিয়েমকে ঘিরে অনেক রসালো এপিসোডের জন্ম দিয়েছিল।
তো ম্যারিয়েম আবার হামলে পড়ল। বলল, ‘গান তোমাকে গাইতেই হবে।’ তো আর কী করা। আবার গাইলাম ‘লুসিল’ গানটা। এরপর অনুরোধে আরো গান গাইলাম। বেশ বাহ্বা কুড়াতে লাগলাম। পরে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। আমার গাইতে ইচ্ছে করছিল সেই গানটি-‘তুমি সাত সাগরের ওপার হতে…।’ এক লাইন গাইবার পর পাওয়া গেল একজন ভলান্টিয়ার-অন্য সেকশনের এক ছাত্রী?মানে সে দ্বৈত গানে আমার সাথে গাইবে। নামটা অবশ্যি এখন ভুলে গেছি। অনেক ছাত্রীর নামের ভিড়ে এই নামটা হারিয়ে গেছে। আসলে সেখানে উপস্থিত অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষার্থিনীর সাথে এই মেয়েটার নাম গুলিয়ে ফেলেছি। তো আবার দ্বৈত কন্ঠে সেই গানটিই গাইলাম।

সেই বছর, বৈশাখী সময়ে আমার কয়েকটি লেখা ছাপা হলো ঢাকা ও টরোন্টোর পত্রিকায় ও ওয়েব ম্যাগাজিনে। এর মধ্যে আমার প্রিয় একটি গল্প ‘খড়ম পেয়ে বুড়ো’ প্রকাশিত হলো ঢাকায় একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে। আমার গল্পগ্রন্থে একটা গল্প ছিল ‘পাগলা ঘোড়া,’ আর গল্পটি লেখা হয়েছে ইয়াবার সর্বনাশা আগ্রাসন সম্পর্কে। এই গল্পটার নাম পরিবর্তন করে ‘থাবা’ নাম দিলাম অনলাইন পত্রিকায়। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। রাতেই পত্রিকায় দেখলাম কক্সবাজারে র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবা’র একটা বড় ঘাঁটি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ কারণেই কিনা জানি না, মানে ইয়াবার গুপ্ত ঘাঁটি আবিষ্কার আর আমার গল্প কোইন্সাইড করার ফলেই হয়তো পরদিনই ওয়েবম্যাগে গল্পটা প্রকাশিত হয়ে গেল। আরো বিস্ময়ের বিষয়-গল্পে আমি ইয়াবার গোপন ঘাঁটি আবিষ্কারের কথাই লিখেছিলাম!
তো আজ এই পর্যন্তই। আবার বালুকা বেলায় বিচরণ করব অন্য কোনো ভাবনা ভাবতে।