হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
একুশে ফেব্রুয়ারি: প্রাসঙ্গিক ভাবনা
এই মাসটা ফেব্রুয়ারি মাস। রক্তরাঙা শিমুল-পলাশের মাস। দখিনা হাওয়া ও বসন্তের বাহারি ফুলের মাস, কোকিলের কুহুতান ও ভ্রমরের গুঞ্জনের মাস। সবকিছু ছাপিয়ে এই মাসটা এক রক্ত ঝরানো দিনের মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী যুবকদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার মাস। এই মাসটিই আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের মাস, বইমেলার মাস এবং বসন্ত বরণের মাস। এইমাসের মাহাত্ম ও নানারকম পর্ব-পার্বণের কোনো শেষ নেই; তেমনি এইমাসে ত্যাগ ও তিতীক্ষার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই।
আজ যেখানে বসে এই নিবন্ধখানা লিখছি, সেখানেই মাতৃভাষা রক্ষার সূতিকাগার। কয়েকটি একুশে পালন করেছি সুদূর ক্যানেডার টরোন্টো শহরে অবস্থান করে। আজ সৌভাগ্য হলো ঢাকায় বসে একুশের জয়গান গাইবার। এই মহান দিবসটি শুধু যে পালিত হয় টরোন্টো আর ঢাকায় তা নয়। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষিত হবার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সুবাদে বলতে গেলে সারা বিশে^ই পালিত হয় দিবসটি।
প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হাতে প্রভাত ফেরি, টরোন্টোর স্থানে স্থানে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল ও ফুলের তোড়া প্রদান- সব রীতিনীতিই পালিত হয়। এ যে কী গর্বের বিষয়, তা সেই ফেরিতে উপস্থিত না থাকলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন, শহীদের আত্মবলিদান স্মরণ, সাংস্কৃতিক অনূষ্ঠান, মেলা- এইসব কিছুতে বিলীন হয়ে মনে হয় নিজ বাসভূমেই আছি। বস্তুত, ক্যানেডার টরোন্টো, মন্ট্রিয়্যাল, ভ্যাঙ্কুভার প্রভৃতি স্থানে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বাংলাদেশের মতোই ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধার সাথে। বাংলাদেশ হাই কমিশনও দিনটি পালন করে থাকে।
যখন একটি দেশের বৃহৎ প্রদেশের একটি রাজধানিতে এবং সেইদেশের সর্ববৃহৎ শহরের (টরোন্টো) একটি এলাকায় এমপি স্বয়ং মহান একুশে উদযাপনের আয়োজন করেন তখন সত্যিই আনন্দে উদ্বেলিত হই। কোনো এক বছর ক্রেসেন্ট টাউন এলাকায় এমপি ম্যাথিউ ক্যালওয়ে নিজ উদ্যোগে একুশের আলোচনা অনুষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালনের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেন। আর এরকম অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সত্যিই নিজকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল।
একুশের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে টরোন্টোর স্থানে স্থানে স্থাপিত হয় শহীদ মিনার। তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে সবাই আসেন শহীদ মিনারে, অনুষ্ঠানে-মেলায়।
এটা সেইস্থান যেখানে রাজধানি সুদূর ওটাওয়া থেকে ছুটে আসেন বাংলাদেশ হাই কমিশনার, বিশিষ্ট এদেশীয় ও বাংলাদেশের নাগরিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি। সবচেয়ে আনন্দের ও গর্বের সংবাদ হলো ক্রেসেন্ট টাউনের কাছাকাছি অবস্থিত ডেন্টোনিয়া পার্কে স্থাপিত হয়েছে স্থায়ী শহীদ মিনার।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি, কিন্তু অনেকেই জানি না যে, একুশে ফেব্রুয়ারি কেমন করে রূপ নিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে। এই দিবসটির বীজ রোপিত হয়েছিল ক্যানেডার কেবেক প্রদেশের ভ্যাঙ্কুভারে। রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এ দিবসটির প্রস্তাব করেন। বায়ান্নের সালাম ও রফিক যেন বাঙালির স্বপ্ন পূরণের মূর্ত প্রতীক হয়ে আবারও অংকন করলেন বাংলার আশা-আকাক্সক্ষার আরেকটি এপিকসম চিত্র!
১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালিন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তারই ফলশ্রুতিতে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে একুশে ফেব্রুয়ারি মর্যাদা পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের।
আজ শুধু ক্যানেডা নয়, বিশ্বের বহু দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।
সঙ্গীতজ্ঞ আবদুল লতিফ লিখেছিলেন এবং গেয়েছিলেন:
‘সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান, আহা যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,
এই জানের বদল রাখুম রে ভাই, বাপ-দাদার জবানের মান
ও হো.. হো.. হো….বাপ-দাদার জবানের মান…।’
তেমনি লিখেছিলেন আবদুল গফফার চৌধুরী:
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি…।’
এত আবেগ, এত ভালোবাসা ও এত মমতা যে জাতির বুকে, সেই জাতির মুখের ভাষা কেড়ে নেবে এমন শক্তি মর্ত্যলোকে নেই। আর নেই বলেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কুৎসিত ষড়যন্ত্র পৃথিবীর বুকে উদিত হয়েই ফের উবে গিয়েছিল কর্পুরের মতো। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র নস্যাতের সংগ্রামে অকালে ঝরে গেল অনেক তাজা প্রাণ। আজ আমরা যে মহান ভাষা দিবস উদযাপন করি, তার পটভূমি রঞ্জিত হয়ে আছে শহীদের রক্তে। এই দিবসটি পালন ও স্মরণের মধ্যে যে মহত্ত¡ নিহীত, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই দিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভাষা শহীদদের। আমরা এখনও রত আছি অন্য এক যুদ্ধে, দারিদ্র্র ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ভাষা চেতনা ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের উৎখাতের সংগ্রামে। আমরা যেন সেসব বাধা পেরিয়ে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত থাকতে পারি, সেই উদ্যম ও প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।