হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

একটি রেলস্টেশনের গল্প

ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছিলাম রেলস্টেশনটা। এটা কোন্ দশকে নির্মিত হয়েছিল, তা বলতে পারব না, তবে সত্তর দশক থেকে নব্বুই দশকের গোড়া পর্যন্ত এর চেহারা একই রকম ছিল। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে এই স্টেশনটার চেহারা আমূল বদলে গেছে। রেলস্টেশন বলতে এই স্টেশন এবং একে ঘিরে আশেপাশের এলাকার কথা বলছি। স্টেশনটার নাম ছয়সূতি। আমার নানাবাড়ির স্টেশন। একটা ছোট্টো স্টেশন কত ছিমছাম, নিরিবিলি ও কতটা মোহনীয় হতে পারে, তা এই স্টেশনটাকে দেখলে বুঝা যেত। আত্মিক টান ও নস্টালজা অনুভব করতাম স্টেশন ও একে ঘিরে গড়ে ওঠা বাজারের প্রতি। একটা লাল ইটের ঘর। একটা চওড়া বারান্দা, করোগেটেড ছাউনি দিয়ে বারান্দাটা ঢাকা। ছাদ থেকে ঝুলত একটা লোহার ঘন্টা। বারান্দায় দু’টি সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চ।

স্টেশনটাকে ঘিরে একটা ছোট্টো বাজার গড়ে উঠেছিল। সন্ধ্যে নামলেই কুপি, হারিক্যান জ্বলত। তখন ইলেটিক্ট্রক বাতির কথা কেউ কল্পনাতেই আনতে পারত না। চায়ের স্টল, মুদির দোকান, জরাজীর্ণ ওষুধে ভরা ফার্মেসি, কেরোসিন তেল ও লাকড়ির দোকান, ভাত তরকারির দোকান, মিষ্টির দোকান আর কামারশালা। সোনালি ব্যাংকের একটা শাখা ছিল। এটাকে প্রশাখা বলা যেতে পারে; টালির ছাদ আর দেয়ালে ঘেরা একটা ছোটো ঘর। সত্তর দশকের গোড়ায় সম্ভবত এটা ছিল না। এই শাখাটাকে লক্ষ্য করে আসছি আশির দশক থেকে। অনতিদূরে ছয়সূতি ইউনিয়ন হাই স্কুল। ছোটোবেলায় খুব সকালে উল্কা বা গ্রীনঅ্যারো নামের ট্রেনে চেপে ভৈরব আসতাম। ভৈরবে অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পর লোকাল ট্রেন মিলত।
অতিরিক্ত ভিড় থাকত ট্রেনটায়। গাদাগাদি করে আসতে হতো। লোকাল ট্রেন উত্তরে ময়মনসিংহে যায়। ভৈরবের পরের স্টেশনই আমাদের কালিকাপ্রসাদ স্টেশন। আমাদের দেশের বাড়িতে যেতে হলে কালিকাপ্রসাদ স্টেশনে নামতে হতো। নানাবাড়ি যেতে হলে পরের স্টেশন ছয়সূতিতে নামতাম। ছয়সূতি নেমে গ্রাম্য পথে দেড়মাইল হেঁটে ধূপাখালি ফকিরবাড়ি পৌঁছাতাম। আমের দিনে বা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে নানাবাড়ির রূপ বদলে যেত। স্টেশন থেকে যেতে দুইপাশের ধানখেত, পেছনের গ্রাম, গ্রাম্য পথের দুইপাশের গাবগাছ, পলাশ-শিমূল ও আরো নাম না জানা গাছ মন কেড়ে নিত। গ্রামের ঘন গাছপালার গায়ে লেগে থাকা থোক থোক পলাশ ও শিমূলের রাঙা ফুল, পাখির ডাক আর অবারিত নীলাকাশ স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করত। আমকাঁঠালের দিনে পাকা কাঁঠাল, লিচু ও আমের মৌ মৌ গন্ধে মন হয়ে যেত পাগলপারা। বৈশাখে দেখা যেত আরেক চিত্র। সারি সারি গাছপালার মাথায় বয়ে যেত বাতাস। ঘুড়ি ওড়াতাম, আঠার ফাঁদ দিয়ে মাছরাঙা পাখি শিকার করতাম। বর্ষার সময় দুইপাশের নিচু জমি পরিণত হতো টলটলে বিলে। লাল-নীল-শাদা শাপলায় বিল যেন হয়ে যেত কোনো দক্ষ শিল্পীর আঁকা ছবি। মাছ ধরার ধুম পড়ত চারিদিকে। রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক-কোয়াক’ ডাক ভেসে আসত। স্থানীয়ভাবে ডাহুক পাখির নাম ছিল কোড়া।
আমার জন্ম ও বড় হওয়া ঢাকা শহরে। তাই যতবারই গ্রামে যেতাম, একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করত আমার মধ্যে। অ্যাডভেঞ্চার মনে হতো। যেমন বিলের গন্ধ, বিলে ও পুকুরে সাঁতার কাটা, রাতের রূপ, অন্ধকারের ভয় আর বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। এগুলো বলে বুঝাবার নয়।

একবার নানাবাড়িতে গিয়েছিলাম। সেটা ১৯৭৯ সালের ঘটনা। ঢাকায় আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল আমার ছোটো মামা ও আরেক মামা, যার নাম ছিল অখিল মামা। তারা কয়েকদিন ঢাকায় থেকে তারপর চলে গেল। যাবার আগে আমাকে বিশেষভাবে যেতে বলে গেল। এক বসন্তকালে চলে এলাম নানাবাাড়ি। তখন আমার একাকী নানাবাড়ি যাবার প্রথম দিকের ঘটনা। এখানে উল্লেখ্য যে, আগে নানাবাড়ি যেতাম মামা-মামি বা নানি (যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন) প্রমুখদের বাড়িতে বেড়াতেই। কিন্তু আমার ইমেডিয়েট বড়বোন প্রয়াত ইভা আপা’র বিয়ের পর যে ক’বছর ইভা আপা নানার বাড়িতে ছিল, আমার যাতায়াতটা বেড়ে গিয়েছিল সঙ্গত কারণেই। তার হাজব্যান্ড চাকরিসূত্রে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। ইভা আপা সঙ্গত কারণেই ভাটি অঞ্চল, তথা তার অচেনা অঞ্চলে যেতে চায়নি। সে সংসার পাতল নানির বাড়তে।

সেবার নানাবাড়ি গিয়ে বসন্তকালের প্রকৃত রূপ দেখলাম। কী অপরূপ চারদিক! সবুজ গাছ, লাল পলাশ, নীল আকাশ, ধানখেত আর সর্ষে ফুলের চোখ ধাঁধাঁনো বসন্ত রঙ। কবিতার চেয়েও সুন্দর সেই দৃশ্যাবলি।

নানাবাড়ির সেইবছরের সেই দৃশ্য আমার মস্তিষ্কের সেল্যূলয়েডে আটকে আছে চিরকালের তরে।

বাংলাঘরে শুয়ে ছিলাম। ভ্রমণজনিত কারণে ও অনভ্যস্ততায় ঘুম আসছিল না। চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধার, ঝাঁ-ঝাঁ নিস্তব্ধতায় কেমন যেন অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিলাম। একসময় ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভাঙল তারস্বরে চেঁচানিতে। কোকিলের চিৎকার। কোকিলের ডাক সাধারণত মিষ্টি, সেটা চিৎকার হয় না। কিন্তু একসাথে যদি কয়েকটা কোকিল চেঁচাতে থাকে, তাহলে বোধহয় তেমন একটা মধুর মনে হয় না। ঘড়ি দেখলাম, ভোর সাড়ে ছ’টা। বাড়ির চৌহদ্দির বাঁশঝাড়ের মাথায় প্রবল বাতাসে দুলছে কোকিলগুলো আর গলা ফাটিয়ে ডাক ছাড়ছে! সকালে বোধহয় তাদের স্বরে তেজী ভাব থাকে। ঠিক দুপুরে তাদের কন্ঠ উদাস আর প্রলম্বিত হয়। সেই সময়টার সুরই আমার কাছে সবচেয়ে উন্মনা আর আবেশজাগানিয়া মনে হয়।

নানাবাড়ি আসবার পথে শিমূল-পলাশের সেই রাঙা প্রকৃতি দেখেই আমি পরবর্তীতে একটা গল্প রচনার সময় এক ছত্র কবিতা সৃষ্টি করে তা গল্পের ভেতরে বসিয়ে দিয়েছিলাম। গল্পটি প্রথমে ছাপা হয় ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে। পরে গল্পটি আমার গল্পগ্রন্থ ‘প্রত্নপ্রাচীন দেবী’তে স্থান পায়। গল্পটির নাম ছিল-‘আত্মা, বৃক্ষ ও ড্রাইঅ্যাড।’ এটি ২০১২এ ফের প্রকাশিত হয় টরোন্টোর ‘দেশে বিদেশে’ নামের একটি পত্রিকায়। ছত্রটি নিম্নরূপ:
‘বন-বীথিকার শরীর ঘেঁষে দোলে শর্ষেদল/নীল আকাশের বুক ছুঁয়ে যায় লাল পলাশের মল…।’

বিভিন্ন পর্বে নানাবাড়ি গমন, ও নানাবাড়ি থেকে দূরদূরান্তের আত্মীয় বাড়িতে ভ্রমণ আর নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাওয়া- প্রভৃতি আমার মনে একটি স্থায়ী আসন করে নেয়। আমি আর মামাতো ভাই ছোট্টো বহুবার বহু স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি আর অনেক আনন্দঘন মুহূর্তের জন্ম দিয়েছি।
মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত গ্রামগঞ্জের জীবনযাত্রা অতটা কর্মমুখর ছিল না। জটিল হিশেবনিকেশের জালে মানুষ তখনও জড়িয়ে যায়নি। তথ্য ও প্রযুক্তির উন্মেষ, গার্মেন্ট শিল্পের উত্থান, জীবিকার সন্ধানে বিদেশ গমন, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের স্পর্শ মানুষকে নতুন ও ব্যস্ত জীবনের সন্ধান দিল। এগুলো অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু এই ভালো দিকগুলোর সাথে ঢুকে গেল প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, অনৈতিক কর্মকান্ড, লোভ ও কালো টাকা। গাঁয়ের মানুষজন ব্যস্ত ও বর্হিমুখী হলো। অর্থ উপার্জনে সংগ্রামে রত হলো।

আগে মানুষজন সুখি ছিল, অল্পতে তুষ্ট ছিল আর রসিক ছিল। ১৯৮৬ বা ৮৭ সালের দিকে ছয়সূতিতে বাসের রাস্তা হয়। রাস্তাটা মাটি ও কাঁকর বিছানো ছিল। কোনো যাত্রী ছাউনি ছিল না। সেইসময় আমি ইত্তেফাকের চিঠিপত্র বিভাগে কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রী ছাউনি দাবি করে একটি পত্র পাঠাই। সেটি ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। তার ক্লিপিং এখনও আমার কাছে আছে। এই রাস্তা ধরে ততদিনে স্বল্প পরিসরে বাস, টেম্পু ও রিকশা চলাচল করছিল। এটা ভৈরব থেকে শুরু হয়ে সোজা উত্তরে চলে গেছে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত। আমি আর ছোট্টো এক বিকেলে স্টেশনের দোকানে চা খেয়ে কাঁকর বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমাদের পেছনে এক বৃদ্ধ আসছিলেন। নানাবাড়ির পাশের বাড়ির বাসিন্দা তিনি। নাম মনে নেই। ছোট্টো জিজ্ঞেস করল, ‘চাচা কই যাইন?’ চাচা জবাব দিলেন, ‘কুইল্লারচর (কুলিয়ারচর) যাই।’

পরদিন বাড়িতে দেখা চাচার সাথে। ছোট্টো জিজ্ঞেস করল, ‘কাইল কোম্বালা (কোন্ বেলা) পৌঁছাইছ্লেন?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘বেইল (বেলা) যখন পড়পড়, আমি তখন কুইল্লারচর।’ এমন কথায় কথায় ছন্দ মেলানো বা রসিয়ে বর্ণনা করাটা একাধারে প্রশান্তি, রসবোধ ও উদ্বেগহীন জীবনেরই বহিঃপ্রকাশ। ৮৭ সালেই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমি আর ছোট্টো যথারীতি হাঁটছিলাম রেললাইন ধরে। ছয়সূতি স্টেশনের রেললাইনটা ছিল নিচে কাঠের পাটাতনের পরিবর্তে ইস্পাতের পাটাতন। রোদে এবং চাঁদের আলোয় লাইন থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো। এই লাইন ধরে হাঁটছিলাম। রাত তখন দশটা। স্টেশনের দোকানগুলোর আলো একে একে নিভে যাচ্ছিল। আমরা গল্পে মশগুল ছিলাম, এমন সময় বিপরীত দিক থেকে তিনজন ষণ্ডামার্কা লোককে আসতে দেখলাম। তাদের গায়ে চাদর জড়ানো। একজনের হাতদু’টো পেছনে লুকনো। তারা রুক্ষস্বরে বলে উঠল, ‘ক্যাডা? বাড়ি কই?’ ছোট্টো ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘ধূপাখালি ফকির বাড়ি।’ আমি বললাম, ‘ওর বাড়ি ধূপাখালি, কিন্তু আমার বাড়ি কালিকাপ্রসাদ।’ তারপর কয়েকটি নাম বললাম। জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। লোকগুলো সুড়সুড় করে চলে গেল। পারলে দৌড়ে পালায় আরকি। ছোট্টো তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লোকগুলো কারা? কেন তারা কালিকাপ্রসাদের নাম শুনে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল? কারণ বহুকাল আগে থেকে কালিকাপ্রসাদ গাঁয়ের একটা দুর্নাম ছিল। সেটা হলো কালিকাপ্রসাদের একটি অংশ ভয়ঙ্কর ডাকাতসমৃদ্ধ গ্রাম।

কালিকাপ্রসাদ গ্রাম দুইভাগে বিভক্ত। একটা হচ্ছে পুব পাড়া, অন্যটি পশ্চিমপাড়া। পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দারা বংশানুক্রমে ডাকাতি পেশার সাথে জড়িত ছিল। আর পুবপাড়ার আদর্শপাড়ায় ছিল আমাদের বসতি। সেখানে কিছু ভদ্র গৃহস্থ বাস করত। আমার দাদা তাদের অন্যতম। ভয়ঙ্কর লোকগুলোকে আমি পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা বলে জানিয়েছি। দুয়েকজন কুখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে জানিয়েছিলাম তারা আমার আত্মীয়। এখন লোকগুলো, যারা আমাদের ওপর হামলে পড়েছিল, তাদের হাতে ছিল রাম-দা আর ছোরা। তারা পেশায় ডাকাত এবং আশেপাশের অঞ্চলের লোক বলেই কালিকাপ্রসাদ সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল। তাই তারা পালিয়েছিল।

আমি আর ছোট্টো বহু স্থানে ঘুরে বেরিয়েছি বিভিন্ন পর্যায়ে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভাটি অঞ্চলের হুমায়ূনপুর, ছোট্টোর মামার বাড়ি সাতবাড়িয়া। সরারচর, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর প্রভৃতি স্থান বহুবার ঘুরেছি।

সর্বশেষ যখন ছয়সূতি গিয়েছিলাম, স্টেশনটাকে আমি চিনতে পারিনি। সাভারের দোকানপাটসমৃদ্ধ কোনো বাজারের মতো মনে হয়েছিল। বুকের ভেতরটা গুমড়ে উঠেছিল। সেই সত্তর দশকে স্টেশনটা কেমন নিথর পড়ে থাকত। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা লোকাল ট্রেন আসত। বাকি সময়টায় গোটা এলাকাটায় একটা আলস্যের চিত্র ফুটে উঠত। এমনকি আমি যখন ভৈরব ও ছয়সূতিতে অসংখ্যবার বিচরণ করেছি তখনও সেইসব এলাকা প্রাচীন জনপদের মতোই ছিল। যে সড়ক পথ এখন জমজমাট, সেটা ছিল ডাকাতদের দখলে। অনেক গ্রামবাসী সন্ধ্যার পর তটস্থ থাকত ডাকাতদের ভয়ে।

ধূপাখালি ফকিরবাড়ির পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রকৃতির খানিকটা চিত্র পাওয়া যাবে ‘চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে বুড়ো কাদায় ডোবে’ নামে আমার লেখা একটা গল্পে। সত্যি বলতে কি, গল্পটা লেখবার পর এটি কোথাও ছাপাতে দেবার সাহস পাইনি। একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম গল্পগ্রন্থে দিব; কিন্তু সে সিদ্ধান্তও বাতিল করে দিলাম। কেন? কারণ গল্পের শরীরটা খানিকটা মশলা মাখানো। আবার একেবারে ছাপানো যাবে না তা-ও ঠিক নয়। কিন্তু শুরু থেকেই মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। প্রথম কথা হলো, আমাদের এই অঞ্চলের ভাষা এবং সেই ভাষায় শব্দাবলি যাকে বলে ঠিক সুদিং না। কেমন যেন শ্রুতিকটু। নমুনা দেখুন। তরকারি বা ফিরনি পরিবেশনের যে পাত্র, সাধারণত সেটাকে আমরা বাটি বলি। এই অঞ্চলে বলে ‘কডরা।’ শব্দটা আমার কাছেও অপরিচিত ছিল। আমার হাসি পেত। সেটাই স্বাভাবিক। ধূপাখালি বা কালিকাপ্রসাদের মতো স্থানে আমার জন্ম হয়নি; এমনকি থাকিও নাই কখনও। শুধু বেড়াতে যেতাম। আমার কোনো খালা, বা মামি অথবা অন্য কেউ এই কডরা শব্দটা প্রয়োগ করেছিল। যে প্রয়োগ করেছিল, সে মহিলা ছিল- এটা আমার স্মরণে আসছে কিন্তু ঠিক কে ছিল, সেটা মনে পড়ছে না। কডরা শব্দটার প্রয়োগ ছিল এরকম: ‘কডরার মধ্যে আরেকটু সালুন বাইড়া দে।’ আরো একটা শব্দ শুনুন। একবার তারাভরা রাতে উঠোনে পাটি বিছিয়ে গল্প-কিচ্ছার আসর বসেছিল। আমার এক খালা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘উই যে ‘ভুইত্তা’ তারা উঠছে।’ বুঝলেন কিছু? ভুইত্তা মানে বিরাট! আকাশে শতকোটি তারা থাকে। এরমধ্যে সবচে কাছের যে তারা, মানে বড় দেখা যায় যে তারা, সেটা শুক্রগ্রহ। যদিও এটা তারা নয়; শুধুই গ্রহ। তবে এটাকে তারার সামিল করা হয়। এই তারাকে খুব ভোরে বলা হয় মর্নিং স্টার আর রাতে বলা হয় সন্ধ্যা তারা বা ধ্রুব তারা। তো ‘র’ ভাষা ব্যবহার করেছি আমি এই গল্পটায়। দ্বিতীয় কারণ হলো, কিছু অশালীন শব্দ ব্যবহার করেছি। যদিও তা করেছি গল্পের প্রয়োজনেই। কাঠামো, বাণী, রস ও লোকাল কালারে গল্পটা কিন্তু অনবদ্য। নিজেই বলছি।

আমার অন্তরে চিরকালের জন্য ভাস্বর হয়ে আছে সেই ছোট্ট রেলস্টেশনটা। মাঝেমধ্যে মনে হয় তেমনি যদি থাকত সবকিছু। সাধারণ, নীরব-নির্জন, ঋদ্ধ, নির্ভেজাল ও জটিলতাহীন!
সামনে বালুকা বেলা কলামে নানার বাড়ি ছয়সূতি ও দাদার বাড়ি কালিকাপ্রসাদ সম্পর্কে আরও কিছু বিস্তারিত বলার ইচ্ছে আছে। প্রথমবারের মতো আমার লেখা ব্যাপক পঠিত ও বহুলপ্রচারিত অঞ্চলভিত্তিক ‘ভৈরব পুরাণ: শেকড়ের সন্ধানে’ গ্রন্থে নানা-দাদা বাড়ি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করেছি। এই লেখাটা যখন সমাপ্ত করলাম তখন ফ্রান্স-আর্জেন্টিনার মধ্যে বিশ^জয়ের প্রতিযোগিতা চলছিল। ব্যাপক নাটকীয়তার পর মেসিদের জয় হলো। আমি অবশ্যি ব্রাজিল ভক্ত। কনগ্র্যাচুলেশন আর্জেন্টিনা।