হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
জীবনে দেশে-বিদেশে অনেক ভ্রমণ করেছি। অনেক দেশে, আর দেশের ভেতরে অনেক স্থানে গিয়েছি। অনেকসময় অবাক হয়ে দেখি যে, আমার ভেতরে আরেকটি আমি কাজ করে। সেটা বোধহয় নিয়তি। নিয়তির টানেই ঢাকার ভেতরেই ঢাকা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমার বহুবার পদচিহ্ন পড়েছে। হেঁটে পা ধরে গেলে অনেকবার প্রতিজ্ঞা করেছি, আর আসব না এই দুই স্থানে। তারপরও নিয়তি আমাকে এ দু’টি স্থানেই অনেকবার নিয়ে গেছে।
আরেকটি অভ্যাস আমার আছে। যেখানেই যাই না কেন (তা অতি সাধারণ মানের হলেও) আমি সব খুঁটিয়ে দেখি।
এই প্রসঙ্গেই কবিগুরুর সেই কবিতাটি মনে পড়ছে:
‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।’
কবিতাটির মোদ্দা বিষয় হচ্ছে-আমাদের ধারেকাছে, নাগালের মধ্যেই অনেক অপূর্ব দৃশ্য, বহু অমূল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অবহেলা করে দূরের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে দূরে, বহুদূরে চলে যাই আমরা। কবিতাটিতে প্রকৃতির যেমন সূক্ষ¥ বর্ণনা আছে, তেমন আছে কাছের অনেক মূল্যবান দ্রষ্টব্য বস্তুকে অবহেলা করে দূরে পাড়ি দেয়ার প্রতি প্রচ্ছন্ন তিরস্কার। দেখার মতো চোখ থাকতে হবে, উপলব্ধি থাকতে হবে, যা দেখা হলো তার মর্ম বুঝার মানসিকতা থাকতে হবে। তা আপনি কাছেই যান আর বহুদূরে যান। একটা অনুসন্ধিৎসু মন থাকতে হবে। সবার তা থাকে না, থাকতেই হবে-এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে, মানে যন্ত্রণার যুগে, এতকিছু দেখা বা ভাববার সময় কোথায় মানুষের। তবে ভ্রমণ-পিপাসু বা সাহিত্যমনা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সবকিছু দেখেশুনে নেয়াটা ভালো।
যাইহোক, আমার জীবনে অসংখ্য ভ্রমণ আমি করেছি। সেসবের একটি ভগ্নাংশ আজ আমি উল্লেখ করব।
আমি আর বন্ধু আলম (প্রয়াত) একটা অদ্ভুত ভ্রমণ করেছিলাম। আমার প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘ইশাপুরার নিশাচর’-এর লোকাল কালার ও ব্যাকগ্রাউন্ড এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই ফুটিয়ে তুলেছিলাম। জায়গাটার নাম ছিল ইছাপুরা। নামের মধ্যে একটা মিল, সৌন্দর্য ও ছন্দ খুঁজে নিতে ইছাপুরাকে পরিণত করলাম ইশাপুরায়। আইডিয়াটা মাথায় আসে রাজউক-এর (ভূতপূর্ব ডিআউটি) একটা ঘোষণা থেকে। তারা আনঅফিসিয়্যালি ঘোষণা দেয় ইশাপুরায় একটি উপশহর গড়ার। ব্যস, রাজউকের তৎকালিন চেয়ারম্যান, আমার আপন মেজো দুলাভাই মরহুম এস.এইচ.এম. আবুল বাশারের অনুমতি নিয়ে আমি আর আলম রওনা দিলাম সেখানে। অনুমতি নেয়ার অর্থ হলো, ইছাপুরার স্থানীয় লোকজন সম্ভবত তাদের সম্পদ, জমি, বসতভিটা ও খেতখামার হারাতে চাচ্ছিল না। তাছাড়া আমরা কারা, কেন এসেছি- এই প্রশ্নটি জাগতে পারে। কোনো চ্যালেঞ্জেরও হয়তো সম্মুখিন হতে পারি। তাই প্রয়োজনে রাজউকের চেয়ারম্যানের রেফারেন্স দিতে পারব। সাধারণত কোনো প্রজেক্ট করার আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই, স্থানীয় গোষ্ঠির মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই ধারণাটি আমার ছিল। সেটা ১৯৮৯ সালের কথা সম্ভবত। আমি ইতোমধ্যেই পরিবেশ বিষয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি শুরু করেছিলাম।
স্থানটি ঢাকার খুব কাছেই, জোয়ারসাহারা পেরিয়ে ইঞ্জিন নৌকো ও সাধারণ নৌকোয় যেতে হয়। কয়েকটি জলাভূমি পেরিয়ে তারপর আমরা যে স্থানটিতে এলাম, সেই জায়গাটা দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হলো, কোনো এক আদি জনপদে পা রেখেছি। যতটুকু মনে পড়ে যে স্থানটিতে গেলাম সেটা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের একটি ইউনিয়ন। ইছাপুরা নামে বাংলাদেশে আরো কয়েকটি স্থান আছে, তার একটি হলো মুন্সিগঞ্জের ইছাপুরা। এতবছরে স্থানকাল সব গুলিয়ে ফেলছি। কোন্ ইছাপুরায় গেলাম, নারায়ণগঞ্জের নাকি মুন্সিগঞ্জের?
সেটা নারায়ণগঞ্জের ইছাপুরাই হবে। আমরা ইঞ্জিন নৌকো আর দুয়েকটি সাধারণ নৌকোয় চড়ে স্বল্পসময়ে নিশ্চয়ই মুন্সিগঞ্জে যাইনি। যাইহোক, যে স্থানটিতে গেলাম সেটা একটা জংলাস্থান। বাঁশবন, উঁচুনিচু স্থান আর নানা গাছগাছালিতে ঘেরা। আমি আর আলম ছবি তুলে চললাম। ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কিছু মাটির ঘর আর গোরৃ-ছাগল দেখতে পেলাম। খবর পেয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছুটে এলেন। তার আর কয়েকজন গ্রামবাসীর সাথে উপশহরের সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা বললাম। এরকম কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে, তার কোনো ধারণাই ছিল না গ্রামবাসীদের মধ্যে। তারা বিস্মিত বোধ করল। জলাভূমি, জঙ্গুলে স্থান আর নির্জনতা ছাড়িয়ে আমরা ইছাপুরার বাজারে এলাম। সেখান থেকে ফিরতি পথ ধরলাম।
জায়গাটায় অবস্থানকালে আমার মধ্যে অদ্ভুত সব জাদুবাস্তবীয় আইডিয়া খেলে গেল। জায়গাটা এতোই নির্জন যে, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। কাউন্ট ড্রাকুলার কাহিনি মনে পড়ল। কিন্তু ড্রাকুলা কেন জানি যাচ্ছিল না জায়গাটার সাথে। হঠাৎ মনে উদিত হলো ডাইনির কথা। রক্তচোষা ডাইনি। ব্যস, বানিয়ে ফেললাম ডাইনির কাহিনি। এরকম একটি ডাইনি বানাতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। ফিরে গিয়েছিলাম উনিশ শতকের প্রথমভাগে। সেইসময়ের জীবনযাত্রা ও প্রাচীন আবহের ওপর পড়াশোনা করলাম। এই ডাইনিকে আমি ইশাপুরাতেই রাখলাম।
যৌবনে তার সাথে যোগ দেয় এক তান্ত্রিক। তাদের ফসল হয় জন্তু সদৃশ সন্তান। তারাই নব্বই দশকের ঢাকায় এক প্রফেসরের শখের গড়া চিড়িয়াখানায় গভীর রাতে এসে জীবজন্তুর গলা চিরে রক্ত চুষে খেতে শুরু করে।
কাহিনির শুরু এখান থেকেই। তারা রাতের আঁধারে হানা দেয়। রক্ত খেয়ে ফিরে যায়। চিড়িয়াখানার জীবজন্তুর মৃত্যু রহস্য অবশেষে ভেদ করে প্রফেসরের দুই শিক্ষার্থী নিশাত ও রাতুল।
আমার জানা নেই, ইছাপুরায় উপশহর হয়েছিল কিনা, কিংবা ইছাপুরা কি সেই আদিম আদলেই আছে নাকি তার উন্নতি হয়েছে। ঢাকার সাথে এর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা সেটাও আমার জানা নেই। জানা সম্ভবও হয়নি। পরবর্তীতে আমি সরকারি চাকরি ও সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর পাড়ি দিই সুদূর ক্যানেডায়।
বালুকা বেলায় আগামী দুই চারটি পর্বে আমার বিবিধ ভ্রমণ কাহিনি সংক্ষেপে বয়ান করব। যেহেতু ভ্রমণ প্রসঙ্গটি এসেই গেল, তাই।