Home কলাম বালুকা বেলা : একজন পারভিন, ছোট্ট একটি ভ্রমণ কিংবা এক উপস্থাপনার কথা

বালুকা বেলা : একজন পারভিন, ছোট্ট একটি ভ্রমণ কিংবা এক উপস্থাপনার কথা

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আমার জীবনে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ ও ঘটনার পাশাপাশি চাকরিক্ষেত্রেও বৈচিত্রের কমতি ছিল না। প্রথমে যোগ দিয়েছিলাম কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনস লি. এ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে। পরে দি নিউ ন্যাশন পত্রিকায় সাব এডিটর পদে (পরবর্তীতে সি. সাব এডিটর ও শিফ্ট ইনচার্জ)। নিউ ন্যাশন ছেড়ে যোগ দিই সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরে। সে চাকরি ত্যাগ করে আওয়ার টাইম নামে ইংরেজি পত্রিকায় ডেপুটি এডিটর হিসেবে যোগ দিই। মূলত পত্রিকাটি আমিই বের করতাম প্রকাশক ও এডিটরের হয়ে। এই চাকরি যখন করছিলাম তখন ক্যানেডায় পাড়ি দেবার সুযোগ ঘটে যায়।
যখনই যে চাকরি করেছি, লেখালেখি ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। যদিও পুরোদমে পারছিলাম না। কারণ গানের চর্চাও যৎসামান্য চলত।

পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই প্রমোদ-তরীতে ভ্রমণের একটি অভিজ্ঞতা হলো। পরিবেশ অধিদপ্তর একটি অধিদপ্তর হিসাবে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করছিল। লোকবল ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। একেকজনকে তার দায়িত্বের বাইরে আর প্রয়োজনের তাগিদে একাধিক বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে হতো। তো সেইসময় এসকাপ (ESCAP) ও বাংলাদেশ সরকার তথা, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়-এর উদ্যোগে পরিবেশ বিষয়ে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার হলো। একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করতে যে পরিমাণ লোকবল, সময় ও সমন্বয় থাকা দরকার, তার কোনোরকম প্রস্তুতি প্রায় ছিল না বললেই চলে। সুতরাং জোড়াতালি দিয়ে কাজ করতে হলো রাতদিন।

বিস্ময়কর বিষয় ছিল সেমিনারের উদ্বোধনী সেশনের উপস্থাপক হতে হয়েছিল আমার মতো এই অধমকেই। আর আমি কীভাবে সেটা সম্ভব করেছিলাম, তা আজও আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। সেই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিল ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিগণ। যাহোক, সেমিনার-পর্বের পরে ছিল মেরি অ্যান্ডারসনে নৌবিহার। পাগলা থেকে আমরা আর বিদেশিরা প্রমোদতরীতে চেপে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে শীতলক্ষ্যায় পড়লাম, আমাদের তরী মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত গিয়ে সন্ধ্যেয় আবার ফিরে এলো পাগলায়।

আমি, আলম ও শিমুল-এই ত্রিরত্ন বহুবার নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়তাম, সেই কথা আগের কোনো এক পর্বে বলেছি। কয়েকবার আমরা জয়দেবপুরের সেই শ্মশানঘাটে গিয়ে শ্মশানচারী হয়েছিলাম। এমনকি রাতের আঁধারেও শ্মশানের আশেপাশে ঘুরে বেরিয়েছি। বেশ ক’বার ঢুঁ মেরেছি গজারিবনে। ঘুরেছি ভাওয়ালের গড়ে। গারো পাহাড়ে যাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেই সাধটি আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু অস্বাভাবিক-আকস্মিক-অদ্ভুত ভ্রমণ দিয়ে সেই অভাব প্রায় পুষিয়ে নিয়েছি বলা যায়। এই প্রসঙ্গে গারো মেয়ে অবাঞ্ছিতা মেরির কথা বলা যায়। সে ছিল ক্যাথলিক। ওর দেখা পেয়েছিলাম আমার বান্ধবী পারভিনের বাসায়। পারভিন ছিল ভালো মনের একটি মেয়ে এবং অভিযানপ্রিয়। সঙ্গীতপ্রেমিক ও রোম্যান্টিক। আমি গান গাইতাম এবং সাহিত্যচর্চা করতাম আর আমার এই দিকগুলো পারভিন খুব পছন্দ করত। পারভিন নিজেও গান করত। যাহোক, মেরির কাছে গারো সমাজ, তাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতির গল্প শুনতাম। একদিন পারভিন আমার বাসায় (বিক্রমপুর হাউস) এসে জানাল, সে নাকি দিনকয়েকের জন্য গাজীপুরে তার এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করতে যাচ্ছে। আমার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে আমি যেন সেখানে ওর সাথে দেখা করি, মানে বেড়াই। রাজি হলাম, দিন তারিখ সময় জানিয়ে দিলাম। কোনো এক ছুটির দিন। যথারীতি সেই দিনটি এলো। কিন্তু সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারছিলাম না। আগের রাতে জ্বর হলো। সেই জ্বরটা পুরোপুরি যায়নি। থার্মোমিটার দিয়ে দেখলাম, তখনও একশ’ দুই এর কাছাকাছি। তবু রওনা দিলাম। কথা দিয়েছি, তার মান রাখতে গুলিস্তানে এসে বাসে চড়ে বসলাম।

ছুটির এক রোদ করোজ্জ্বল বসন্তের দিন। চারিদিকে কেমন একটা অতিপ্রাকৃত লুকোনো উৎসবের আমেজ। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। কেমন ঘোরের মধ্যে চললাম, উপভোগ করতে পারছিলাম না দুইপাশের অপরূপ প্রকৃতিকে, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম এত সুন্দর-স্বর্ণালোকিত দিন আগে কমই দেখেছি। ঠিকানাটা ছিল গাজীপুরের বিআরটিসির কোয়ার্টার। একসময় নির্দিষ্ট স্থানে নেমে কোয়ার্টার খুঁজে বের করলাম। পারভিনের সাথে দেখা হলো। কিন্তু সবকিছু বরবাদ করে দিয়ে মিনিট দশেক পরেই ফিরতি পথ ধরলাম। পারভিন মলিন হেসে বিদায় জানাল। সেই সন্ধ্যায় জ্বরের ঘোরে কেমন করে ফিরে এলাম, নিজেই জানি না। রাতে জ্বর বেড়ে একশ’ তিনে গেল। কয়েকদিন ভুগেছিলাম।

পারভিন একটু বোহেমিয়ান প্রকৃতির হলেও ভালো মেয়ে ছিল। গান গাইত, আর আমার গানের ভক্ত ছিল। পরে সে আরেক সঙ্গীতশিল্পীকে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছিল। জানি না, পারভিন কোথায়-কেমন আছে। বন্ধু আলম প্রয়াত। আর শিমুল যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

গত পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম, আসছে পর্বগুলোতে ভ্রমণ বিষয়ে লিখব। সংক্ষিপ্ত আকারে লিখলাম এবারের সংখ্যায়। সামনের পর্বগুলোতে সংক্ষিপ্ত কলেবরেই চলবে। কেননা, ভ্রমণে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বা ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। আমার এই স্বল্প পরিসরে বেশি কিছু লেখার খুব একটা অবকাশ নেই।

Exit mobile version