হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
নিজ ভুমে আমি বিভিন্ন প্রকারের চাকরি করেছি। সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি। সরকারি চাকরি ছেড়ে ফের ঢুকেছিলাম ইংরেজি একটা পত্রিকায়। তারপর তো চলে আসি ক্যানেডায়। আমার হরেক রকমের চাকরির কথা অন্য কোনো এক পর্বে অন্যসময় বলবো।
সরকারি চাকরিরত অবস্থায় আমি বিভিন্ন দেশে ট্রেইনিং, সেমিনার ও ওয়ার্কশপে যোগ দেয়ার সুযোগ আমার ঘটেছিলো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রায় ছয়মাস সময়ের পরিবেশ বিষয়ে একটি ট্রেইনিং। এতো দীর্ঘসময়ের ট্রেইনিং-এর ঘটনাবলি স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। আমি শুধু এখানে জাপানের এক স্বর্গীয় উদ্যানে ভ্রমণের কথা বলবো। সাধারণত সরকারি চাকুরেরা বিদেশ সফর করে এসে একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকেন। ফলো আপ করেন না, বা যে ট্রেইনিং বা সেমিনারে তিনি গিয়েছেন, সে সম্পর্কে উদাসীন থাকেন (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই)। আমি জাপান সফর করে এসে, মিনিস্ট্রিতে রিপোর্ট দাখিল করেছি, জাইকা’র সাথে যোগাযোগ রেখেছি, এমনকি ফলো আপ মিটিং-এ বক্তব্য রেখেছি। শুধু তাই নয়, আমি মিয়াজিমা নামের জাপানি হেরিটেজ সাইটে ভ্রমণের ওপর দি ডেইলি স্টার পত্রিকার উইকএন্ড ম্যাগাজিনে ‘আ ড্রিম ট্রিপ টু মিয়াজিমা’ শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম।
আমার মতো প্রকৃতিপ্রেমিকের কাছে তো বটেই, বিশ্বের যেকোনো বয়সের যেকোনো দেশের ব্যক্তির কাছেই জাপানের মিয়াজিমা-ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটি প্রাণ ভরে উপভোগ করার মতো।
মিয়াজিমা মনুষ্যসৃষ্ট বাগান ও প্রাকৃতিক উপাদানের মিশেল অনন্য ও অদ্বিতীয় একটি স্থান। মিয়াজিমা সাইটে দ্ইুবার গিয়েছিলাম, একবার ফিল্ডট্রিপে, অন্য একবার আক্ষরিক অর্থে ভ্রমণের জন্যই। হিগাশি-হিরোশিমা থেকে প্রথমে সাইজু রেলস্টেশন এলাম। সেখান থেকে ট্রেনে গেলাম মিয়াজিমা-গুচি রেলস্টেশনে। এখান থেকে ফেরিতে চেপে যেতে হয় মিয়াজিমা দ্বীপে। ফেরি মানে পাটুরিয়াঘাটে আমাদের শাহ আমানত ফেরির মতো নয়। এটি একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরীর মতো। মাত্র দশ-বারো মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায় মিয়াজিমায়। এখানে একটু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এবং সামান্য ভৌগোলিক বর্ণনা না দিলেই নয়।
জাপান একটি দ্বীপরাষ্ট্র। অথবা দ্বীপপুঞ্জ বা আর্কিপেলাগো; দ্বীপপুঞ্জখচিত সমুদ্র। জাপান হলো ভূ-ভাগে ঢুকে পড়া সমুদ্রের দেশ (Inland Seas). জাপানের মূল চারটি বড় বড় দ্বীপ আছে- হন্শু, কিয়োশু, শিকোকো ও হোক্কাইডো। এসব দ্বীপে অন্তহীন সমুদ্রের অংশবিশেষ আবার দ্বীপের স্থলভাগে ঢুকে গেছে। তেমনি একটি ইনল্যান্ড সী অতিক্রম করে যায় ফেরি।
যেতে যেতে চোখে পড়ে বনানীঘেরা অনেক ক্ষুদ্র দ্বীপ। গাঢ় নীল বা সবুজ জলরাশির বুকে জেগে ওঠা সবুজ অরণ্য ছাওয়া দ্বীপ মন কেড়ে নেয়। ফেরিতে উড়ে এসে বসে সী-গাল। ওপরে অন্তহীন অবারিত নীল আকাশ। প্রথমবার আমরা মিয়াজিমার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে যাইনি। গিয়েছিলাম অন্য অংশে?রিসার্চ ও ফিল্ডট্রিপের কাজে।
দ্বিতীয়বার গেলাম বেড়াতে। এবার বাসে করে। বাসসহ ফেরিতে উঠলাম। ওপারে মিয়াজিমা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে নামতেই একদল বুনো বাসিন্দা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল। তারা আর কেউ নয়; মিয়াজিমার হরিণের পাল। বিশাল, ছোটো, মাঝারি আর নানা বয়সের বন্ধু হরিণেরা আমাদের পাশে ঘুরতে লাগল খাবারের সন্ধানে। যা পায়, তা-ই খায় তারা। বার্গার থেকে শুরু করে কোল্ড ড্রিংক পর্যন্ত- সবকিছু। কোনোটাতেই আপত্তি নেই। আমাদের সাথে ছিলেন এক চমৎকার জাপানি ভদ্রলোক। নাম ইতু, তিনি আমাদের গাইড। তার সাথে থেকে অনেক তথ্য জেনে নিচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে খাবার ছিল। সেই খাবার খেতে বসেছি পিকনিক টেবিলে, এমন সময় হরিণেরা এসে হাজির হলো। দিয়ে দিলাম আমার স্যান্ডউইচ একটা হরিণকে। মনের আনন্দে সেটা খেয়ে আমার প্লাস্টিকের প্যাকেটের দিকে নজর গেল তার। কিন্তু প্লাস্টিক তো আর খেতে দেয়া যায় না। শেষে হরিণের অত্যাচারে উঠে পড়লাম স্থানটা থেকে। মিয়াজিমার অন্তহীন এলাকায় অর্ধেক মানব-সৃষ্ট সুবিস্তৃত বাগান, অর্ধেক আদ্যকালীন অরণ্য (Primeval Forests). এই ফরেস্টে বানর ও অন্যান্য প্রাণী বাস করে। সব মিলিয়ে মিয়াজিমা একটা সুবিশাল বাগান। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত রোপকার ভ্রমণের ফ্যাসিলিটি। আমরা রোপকারে চড়লাম। স্থানে স্থানে বিশ্রামাগার ও টয়লেট। এছাড়া আছে পাহাড়ের চুড়োয় অবস্থিত অবজারভেটরি ও বিশ্রামস্থল। আছে দুইপাশের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা। আছে কয়েকটি আবাসিক এলাকা?বসবাসের বাড়িগুলো ছবির মতো থরে থরে সাজানো। আছে মিউজিয়াম।
পানির ওপর দণ্ডায়মান টংঘরের মতো কমলা রঙের কাঠের পাটাতন ও তাতে অসংখ্য ঘরের ইতসুকুশিমা শ্রাইন। এখানে প্রবেশ করলে জাপানের ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা যায়। আরো আছে শ্রাইন আর প্যাগোডা, বিশাল সব সাইপ্রেস, সিডার আর চেরিগাছের আড়ালে। আর আছে ঝর্ণা ও স্বচ্ছ জলধারা। আছে অসংখ্য গাছের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ক্যানোপির নিচে আলো-আঁধারি স্থানে সাজানো পিকনিক টেবিল।
সাগরের ওপর নিঃসঙ্গভাবে যে স্থাপনাটি দাঁড়িয়ে আছে তার নাম ও-তরি বা গ্র্যান্ড গেট (O-Torii, Grand Gate). শ্রাইন হলো কোনো পূণ্যস্থান বা সমাধিমন্দির। ইতসুকুশিমা শ্রাইনের (যেখানে আমরা প্রবেশ করেছি) তলায় বয়ে যাচ্ছে সাগরের শান্ত পানি। এই স্থাপনা এবং ও-তরি প্রাচীন শিন্ডেন সাম্রাজ্যের স্থাপত্যবিদ্যার আদলে তৈরি। সাগরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা সিঁদুরে রঙের এই স্থাপনাটি মনে সমীহ ও শ্রদ্ধার ভাবের উদ্রেক করে।
জাপান থেকে ফিরে এসে মিয়াজিমা ভ্রমণের ওপর একটি ফিচারধর্মী লেখা লিখেছিলামম সেকথা শুরুতেই বলেছি- ‘A Dream Trip to Miyajima’ শিরোনামে।
আমার জীবনে দেশবিদেশ ভ্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ের একটি শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ ছিল মিয়াজিমায় ভ্রমণ। এছাড়া, ভ্রমণ করেছিলাম কাগুরায়? যেখানে দেখেছিলাম জাপানের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও প্রাচীন জাপানের রীতিনীতির ওপর মঞ্চনাটিকা। দেখেছিলাম ড্রাগনের নাচ ও মুখোশের নৃত্য প্রভৃতি।