হাসান জাহিদ: কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

আগের রাতে পটকাবাজির শব্দ শুনেছিলাম। সেই শব্দ, বাতাসের কুঁ কুঁ শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের প্রশস্ত বারান্দার সাথের স্লাইডিং ডোর কাঁপছিল আর সোঁ সোঁ শব্দ শুনছিলাম। টরোন্টোর মাইনাস তাপমাত্রার সময়কার হাওয়া খুবই দুর্বিনীত ও দুরন্ত।

বাংলাদেশে থাকতে আমার আর আমার ছেলের প্রিয় একটি বিষয় ছিল টেনিদা সমগ্র নিয়ে আলোচনা। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় সেই চার চরিত্র টেনিদা, হাবুল, প্যালা ও ক্যাবলার কাজকারবার নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। একবার প্ল্যানচেট-এ বসেছিল চার মূর্তি। তার আগে আলোচনায় পণ্ডিতগোছের ক্যাবলা বারবার প্ল্যানচেটের প্রকৃত উচ্চারণ সম্পর্কে বাকি তিন মূর্তিকে জ্ঞানদান করেছিল, শুদ্ধ করে বলে দিয়েছিল যে, এটি ফরাসি শব্দ আর এর প্রকৃত উচ্চারণ ‘প্লাঁসেত’।

তো অন্য এক গল্পে তারা হিমালয়ের ‘ইয়েতি’ আর বিলজার্ড নিয়েও গল্প করছিল। সেই ব্লিজার্ড নিয়েই আমার আজকের গল্প? মানে, সত্যিকারের গল্প ও অভিজ্ঞান।
National Geographic Society-এর এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:
‘A blizzard is a dangerous weather event, bringing with it frigid temperatures, howling winds, and decreased visibility. Blizzards can be deadly, which is why it is important that meteorologists accurately measure atmospheric conditions and provide the public with timely warnings.’

এই যে, এই বর্ণনায় ‘howling winds-এর কথা বলা হলো, ঠিক তেমনি যেন হাজারো নেকড়ের গর্জন। টরোন্টো ছাড়া আরও উত্তরের হেমিস্ফিয়ারের ব্লিজার্ড দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়নি; টরোন্টোতেই যা দেখলাম তাতে বোধহয় উত্তুরে ব্লিজার্ড দেখার শখ বা ইচ্ছে কারুর জাগবার কথা নয়।

এমন দৃশ্য দুই চোখ সার্থক করে দেয়, যদিও আগের রাতটা ছিল বিভীষিকাময়। আইস স্টর্মে অনেক ক্ষতি-ভোগান্তি হয়ে গেছে। আমিও ভোগান্তির শিকার হয়েছি কিন্তু আইস স্টর্মের পরের দিনটা দেখার মতো ছিল। যদিও সূর্য ওঠেনি কিন্তু চারিদিকে ফর্সা ছিল। সকালে উঠে আমি আমাদের চত্বরে হ্যাস্টি মার্কেটে গিয়েছিলাম। ফিরে আসবার সময় ভাবলাম, এমন মনোমুগ্ধকর কিছু দৃশ্য ধারণ করে রাখি না কেন? অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আবার নামলাম ডিএসএলআর ক্যামেরাসহ। অনেকদিনের অনভ্যস্ততায় ক্যামেরার শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, আইএসও ঠিকভাবে অ্যাডজাস্ট হয়তো হয়নি। তবু একের পর এক ছবি তুলে চললাম। সমস্ত গাছপালা কাচের গাছে পরিণত হয়েছে। পত্রশোভিত ও পত্রবিহীন- দুইরকম গাছই গায়ে ক্রিস্টালের জড়োয়া জড়িয়ে নিল। গাছপালার কালো ডালগুলোতে বরফের পুরু প্রলেপ। মনে মনে নাম দিয়ে দিলাম- কাচগাছ।

রাতে (২১ ডিসেম্বর, ২০১৩) বোমা ফেটেছিল। আধো জাগরণে, আধো ঘুমে সেই পটকাবাজি শুনলাম রাতভর। তখনও কিন্তু ভাবতে পারিনি টরোন্টোর কতোটা ক্ষতি হয়ে গেছে। দমকা হাওয়া, তীব্র ঠান্ডায় গাছের ডালগুলি পটপট শব্দে ভেঙেছে। ছবি তুলতে গিয়ে চেনা দু’চারজনের সাথে দেখা হয়ে গেল। তারা এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়নি কখনও। আমাদের ৭ ক্রেসেন্ট প্লেসসহ আরো অনেক জায়গায় বিদ্যুত ছিল না। সাইডওয়াকে, রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে। বৈদ্যুতিক পোল ভেঙে পড়েছে। ট্রান্সমিটার অকেজো হয়ে গেছে। অনেক ঘরবাড়ি ও গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক গাড়ি গাছচাপা পড়ে দুমড়েমুচড়ে গেছে।
আমাদের ডেন্টোনিয়া পার্ক থেকে ড্যানফোর্থের দিকে যেতে থাইরা অ্যাভেনিউ পর্যন্ত দুইপাশের সাইডওয়াক ও বাড়িঘরের ওপর গাছ পড়ে একেবারে বিতিকিচ্ছি অবস্থায় দাঁড়াল। ড্যানফোর্থের বাংলাদেশি রেস্তরাঁয় আলুচপ ও পেঁয়াজি খাচ্ছিলাম। মালিক ভদ্রলোক গাছগুলোর জন্য আফসোস করছিলেন। বলছিলেন, এবার সামারে টরোন্টো বোধহয় আর অতোটা সুন্দর দেখাবে না। তিনি আরো জানালেন যে, ব্যালকনিতে তার মেয়ের শখের বহু মূল্যবান গাছগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।

যারা বাংলাদেশি, তারা তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে তাদের অভিজ্ঞতা বলছেন। একজন সাতবছর ধরে কানাডায় আছেন, তিনি আমাকে বললেন, ‘গত সাতবছরে এমন দেখিনি।’ রেস্তরাঁয় আরেকজন বলছিলেন যে, তিনি তেইশবছর যাবত কানাডায় আছেন, এরকম অভিজ্ঞতা তার হয়নি।

এই অভিজ্ঞতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোনো কানাডীয় বলছেন, গত বিরানব্বই বছরে এরকম আইস স্টর্ম হয়নি। আবার কেউ বলছেন, পঞ্চাশ বছর আগে একবার এরকম স্টর্ম হয়েছিল। ক্রিসমাসের আগে এমন একটি স্টর্ম টরোন্টোবাসীকে বেকায়দায় ফেলে দিল। ক্রিসমাসের আনন্দ ম্লান হয়ে গেল বিদ্যুতবিহীন এলাকাগুলোতে। অনেকেই নিজ বাসস্থান ছেড়ে চেনাজানা বা আত্মীয়ের বাসায় উঠলেন। আইস স্টর্মের রেশ অনেকদিন ছিল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে।

আইস স্টর্মের কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত জমাটবাঁধা বরফে পরিণত হয়েছে! যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ার বিভাগ অত্যন্ত চিন্তিত ছিল এই ভেবে যে, কোথাও আগুন লাগলে পাইপ দিয়ে যে পানি ছুড়ে মারা হবে, সেই পানিও তো মুহূর্তেই জমে যাবে! বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রেও ঠান্ডার এমন প্রকোপ একশ’ বছরে হয়নি।

একটি পত্রিকায় ভারী মজার একটা নিউজ পড়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের এক কারাগার থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি পালিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। সে বাইরের অসহ্যকর ঠান্ডায় টিকতে না পেরে ফের কারাগারে ঢুকে গিয়েছিল!

ব্লিজার্ডের কবলে যে শুধু সেবারই পড়েছিলাম তা নয়; আরও কয়েকবার পড়েছিলাম। তবে সেসব কারাগারে ঢুকে যাবার মতো অতোটা ভয়াবহ ছিল না।
আজ এই পর্যন্তই। আগামী সংখ্যায় কী বিষয়ে লিখব, সেটা ভাবতে লেগে গেলাম এখন থেকেই।