Home কলাম বালুকা বেলা – অ্যালিস মানরো: ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত গল্পকার

বালুকা বেলা – অ্যালিস মানরো: ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত গল্পকার

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

বালুকা বেলায় লেখা শুরু করার পর থেকে ভাবনায় ছিল যে, নোবেলবিজয়ী কানাডীয় গল্পকার অ্যালিস মানরো সম্পর্কে লিখব। অ্যালিস মানরো সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়ে তিনি ২০০৯ সালে যখন ম্যানবুকার পুরস্কার পেলেন। ম্যানবুকার প্রাপ্তির আগে তিনি কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার ও অন্যান্য কয়েকটি পুরস্কারে ভুষিত হন।

অ্যালিস অ্যান মানরো (ইংরেজি: Alice Ann Munro; জন্ম: ১০ জুলাই, ১৯৩১) অন্টারিও প্রদেশের উইংহ্যামে জন্মগ্রহণকারী কানাডার বিশিষ্ট ছোটোগল্প লেখিকা। তিনি সারা জীবনের সাহিত্যের জন্য তিনি ২০১৩ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এবং ২০০৯ সালের ম্যানবুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনকারী; এছাড়াও তিনি গদ্যের জন্য তিনবার কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পেয়েছেন।

অ্যালিস মানরো একমাত্র সাহিত্যিক যিনি মূলত ছোটোগল্প লিখে নোবেল জয় করেন। এর অবশ্য শক্তিশালী ও ব্যতিক্রমধর্মী কারণ আছে; তা হলো তার গল্পে রয়েছে উপন্যাসের ব্যপ্তি। একটি গল্পেই তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ঘটনাবহুল কাহিনী।
তিনি তার গল্পে দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিও এলাকা, স্কচ-আইরিশ বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগাথা বর্ণনা করেছেন। মানরো’র লেখাগুলোয় উপমার ব্যবহার ও বর্ণনাত্মক ভঙ্গিমায় স্তবকাকারে ছন্দোবদ্ধ। তার গল্পে অর্থনৈতিক দিক ও জীবনবোধ প্রগাঢ়তা লাভ করেছে; পাশাপাশি সাধারণ মানুষের গভীর ও জটিল মনোগত দিক প্রকাশ পেয়েছে।
২০১০ সালে আমি অনুবাদ করি মানরো’র ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’ বইটি। মূলত এই গ্রন্থ থেকেই আমি মানরো’র ভক্ত হয়ে পড়ি। অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করে অন্যধারা প্রকাশনা সংস্থা। আমি যে সংস্করণ থেকে অনুবাদ করি, তা ব্রিটেনের ভিনটেজ প্রকাশনা সংস্থা ১৯৯৬ সালে প্রকাশ করে। নতুন ধারা নামের ম্যাগাজিন ও অন্য একটি পত্রিকায় এর সমালোচনা প্রকাশিত হয়। আর একুশে বইমেলায় বইটি ভালোই বিক্রি হয়। অনেকের প্রশংসাও পেয়েছি।
যাইহোক, টরন্টোতে আমার এক ঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক বন্ধু বইটি কানাডা থেকে বাংলায় প্রকাশ করার আগ্রহী হয়ে আমাকে বেশ কয়েকবার তাগাদা দিলেও আমি অনেকটা আলস্যের কারণেই এগিয়ে যাইনি।

২০০৯ সালে অ্যালিস মানরো’র ম্যানবুকার পুরস্কার প্রাপ্তি বিশ্বের পাঠকদের কানাডার সাহিত্য সম্পর্কে কৌতূহলী করে তুলেছিল আর তার অবস্থানকে করেছিল সুদৃঢ়। নিজ দেশ কানাডা এবং প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিতি পেলেও বহির্বিশে^ তেমন পরিচিত ছিলেন না তিনি। এর কারণও আছে। মানরো উপন্যাস নয়, ছোটোগল্প লেখেন। সৃজনশীল সাহিত্যের আসরে ছোটোগল্প সবসময়ই পেছনের সারিতেই অবস্থান করেছে। জনপ্রিয়তার ধারায় উপন্যাসই সবদেশে বহুলপঠিত। এর সঠিক কারণ আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। এবং আমি নিজে ছোটোগল্প লেখক হিসেবে এই বাস্তবতাটুকু আজও মেনে নিতে পারিনি। তবে, আনন্দ ও আশার কথা যে, মানরো-ই পেরেছেন ছোটোগল্পকে বড় আসনে স্থান দিতে।
বার্ষিক ম্যানবুকার পুরস্কারের জন্য ছোটোগল্প তো বিবেচিত হওয়ার কথা না। ওই ধারার জন্য মানরো’র আগে নোবেল পুরস্কারও পাননি কেউ। তাহলে মানরো’র গল্প বিবেচিত হলো কেন এতবড় একটা পুরস্কারের জন্য? ঠিক কী কারণে তাকে এই পুরস্কারে সম্মানিত করা হলো? একটু গভীরভাবে ভাবলে বেরিয়ে আসবে যে, আসলে মানরো’র সামগ্রিক সাহিত্যকর্মকে সম্মানিত করা হয়েছে এই পুরস্কারের মাধ্যমে। আর মানরো’র সাহিত্যকর্ম বলতে আমরা বুঝি উপন্যাসের ব্যপ্তি নিয়ে তৈরি হওয়া মানরো’র ছোটোগল্পগুলোকে। আরেকটি জোরালো কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ দক্ষিণাঞ্চলীয় লেখক উইলিয়াম ফকনার কিংবা ফ্ল্যানারি ও’কনরের মতো মানরো’র গল্পের চরিত্রেরা ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত নিয়ম-নীতি ও আচার-আচরণের মুখোমুখি হয়।

মানরো’র ছোটোগল্প গুলোকে ‘শর্ট ফিকশন’ বলা হচ্ছে সঙ্গত কারণেই। কারণ তার গল্পগুলো থিম ও বর্ণনায় উপন্যাসের সমকক্ষ অথচ ব্যপ্তিতে বড় গল্পের চেয়ে বড় নয়। ঠিক নারীবাদী লেখিকা বলতে যা বোঝায়, অ্যালিস মানরো তেমন কোনো অভিধা না পেলেও, তিনি একজন লেখিকা বলেই সম্ভবত মেয়েরাই তার প্রায় সব গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে। দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিওর মফস্বল-শহুরে অঞ্চলে জীবনযাপনের যে সমস্যা, একটি মেয়ের নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মুখোমুখি হওয়া, জীবন নিয়ে এগিয়ে চলা- এ সবই তার লেখার মূল উপজীব্য, বিশেষ করে তার প্রথম দিকের গল্পগুলোতে। তার মেয়ে চরিত্রগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ জটিল এবং আধুনিক; যদিও গ্রামীণ এক ধরনের সহজবোধ্যতা যেন তাদের পরিচিতির বিশেষ ছাপ। তার আগের দিকের গল্পগ্রন্থ বিশেষত ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’ সে স্বাক্ষর বহন করে।

বিগত তিন দশক ধরে কানাডীয় এই ছোটোগল্পকার নিজকে সবচাইতে আদৃত লেখিকারূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। মানরো প্রধানত শর্ট ফিকশন বা বড় গল্পের পরিধিতে উপন্যাসের স্বাদ দেবার কারিগর হিশেবে পরিচিত। তাঁর ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ ‘ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ূথ’ সে স্বাক্ষর বহন করছে। আমেরিকার ঔপন্যাসিক/ ছোটোগল্পকার সিনথিয়া ওজিক বলেছেন- ‘মানরো আমাদের চেখভ।’ জন্মস্থানের (দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্টারিও) স্মৃতিচারণে মুন্সিয়ানা প্রদর্শন, অভিজাত ও প্রকৃতিপ্রদত্ত স্টাইল আর চরিত্রগুলোর সূ²াতিসূ² বর্ণনা, তাদের আবেগের আকস্মিক পরিবর্তন ইত্যকার বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ মানরোভীয় ঘরানা দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে যায়।

মানরো’র এসব বৈশিষ্ট্য ছোটোকাল থেকেই লেখক হবার বাসনা থেকে উৎকলিত। এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, নয় বছর বয়স থেকে একজন লেখিকা হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে চাননি তিনি। মজার বিষয় হচ্ছে- নয় বছর বয়স হবার আগে পর্যন্ত তিনি সিনেমার নায়িকা হতে চেয়েছিলেন।

মানরো’র ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’ ২০১০ সালে অনুবাদ করেছি। মানরো’র বই অনুবাদ আর আমার কানাডায় আগমনের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই, এটি সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তবে এমন কাকতালীয় বিষয় ঘটে যাওয়ায় পুলকিত বোধ করছি। গ্রন্থটির প্রথম গল্পের নাম ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’। মানরো’র গল্পগুলোকে সমালোচকগণ প্রকারান্তরে শর্ট ফিকশন বলেছেন, আগেই বলেছি।

বাস্তবিকই তাই। শর্ট ফিকশন কথাটা বুঝি শুধু মানরো’র ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অনেক সমালোচক মানরো’র এই ধরনটার সমালোচনা করেছেন যে, তার গল্পে উপন্যাসের আবেগ ও উপাদান আছে। তারা মানরো’র গল্পকে ঠিক কী বলবেন- বড় গল্প নাকি শর্ট ফিকশন, না উপন্যাসিকা, সেদিকটা নির্ধারণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে, মানরো’র গল্পগুলোর বেশিরভাগই দক্ষিণ পশ্চিম অন্টারিও প্রদেশের ভাবধারায় আবর্তিত, যা গল্পে ফুটিয়ে তুলতে গেলে হয়তো বা উপন্যাসের বিস্তার এসে যেতে পারে, কিন্তু মানরো উপন্যাস লিখতে চাননি। তাঁর ঘটনা ও চরিত্র এত অসংখ্য যে, তিনি একের পর এক গল্প রচনা করে গেছেন তার মনের মাধুরী মিশিয়ে। তাই মানরো’র গল্পগুলো বড় গল্প, অথচ উপন্যাসিকার মতো প্রশস্ত নয়। কিন্তু কী দারুণভাবেই না ভাবগাম্ভীর্যে ও বর্ণনায় প্রশস্ত! প্রায় সব ক’টি গল্পেই একটা ব্যপ্তি রয়েছে, যেখানে স্বল্প ভাষায় এবং আকারে ইঙ্গিতে কয়েক পুরুষের চিত্র আঁকা হয়ে যায়।

গল্প না উপন্যাস? এরকম পরিস্থিতে Eclectica ম্যাগাজিনে Alex Keegan এককথায় শেষ করে বলেছেন: ‘Who cares?’ তিনি কথাটা বলে মানরো’র লেখা পড়ার একটা গাইডলাইন দিয়েছেন পাঠককে। আমরাও বলতে পারি- তাতে কী আসে যায়?

‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’-এর প্রথম গল্পের শুরুটা শাদাসিধেভাবে। গ্রামীণ পারিবারিক জীবন। হতাশা, বেদনা আর আশায় ভরা। গল্পটার গুরুত্ব কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গিতে যাচাই করা দুঃসাধ্য। মায়ের আত্মহত্যা করার প্রবণতা এক মেয়ে দেখছে প্রবল হতাশার কারণ হিশেবে। আবার একই গল্পে মেয়ে মায়ের আত্মহত্যা-প্রবণতাকে দেখছে তার বাবাকে ভীত করার এক ধরনের প্রচেষ্টা রূপে। নিউইয়র্ক টাইমসে (সেপ্টেম্বর ১৯৮৬) মিচিকো কাকুতানি গল্পটিকে ‘utter subjectivity of truth’ রূপে বর্ণনা করেছেন।

মানরো’র আরো অন্যান্য গল্পের মতো দি প্রোগ্রেস অব লাভ গল্পটিতেও বর্তমান যেমন আবর্তিত তেমনি অতীতটাও উঠে এসেছে উত্তম পুরুষের বিবরণে। মানরো এখানে বিধৃত করেছেন তিন প্রজন্মের মা ও মেয়ের কাহিনী। মানরো এই গল্পে অনেকটা যেন নারীবাদী।
বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটির নাম লিচেন বা ছত্রাক। এই গল্পে দেখা যায়, ডেভিড ও ক্যাথেরিন প্রেমিক-প্রেমিকা। তারা বেড়াতে এসেছে লেকের পাড়ে স্টেলা নামের এক মহিলার সামারহাউসে। স্টেলা এখানে একা বসবাস করে। স্টেলার বাবা এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এখন থাকেন একটা নার্সিংহোমে। মজার বিষয় হলো, ডেভিড প্রেমিকাকে সাথে করে বেড়াতে এসেছে প্রাক্তন স্ত্রী স্টেলার বাড়িতে। অনেকটা মনস্তাত্তি¡ক গল্প এটি। শহুরে ডেভিডের বিপন্নতাবোধ আর ক্যাথেরিনের টানাপোড়েন নিয়ে। ক্যাথেরিন বুঝতে পারে ডেভিড হয়তো তাকে ভালবাসে না। আর ডেভিড তো অন্য একটা মেয়ের বাজে ছবি স্টেলাকে দেখিয়ে বলেই ফেলল, আমার নতুন বালিকা। স্টেলা ছবিটা দেখে মন্তব্য করল- ছত্রাক। মানরো এখানে গল্পের অন্যতম চরিত্র স্টেলার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন লিচেন (ছত্রাক) শব্দটি। গল্পটিতে ডেভিড ঘুরে বেড়ায় এক লিচেন থেকে অন্য লিচেনের সন্ধানে।

মানরো সর্বদাই একটা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এগিয়েছেন। কীভাবে চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন, কেমন করে ফুটিয়ে তুলবেন তাদের পরম আর ভেতরের সাধারণত্বকে, একই সাথে কেমন করে তাদের মধ্যে একটা অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত রাখবেন, সেসব।
আজ এই পর্যন্তই। বালুকা বেলায় বিচরণ করতে করতে ভাবতে থাকব পরবর্তী সংখ্যায় কী লিখব।

Exit mobile version