ভজন সরকার : শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং-এর দু’টো পথ। কার্সিয়াং হয়ে ঘুম এবং দার্জিলিং। অন্য পথটি মিরিক হয়ে ঘুম এবং দার্জিলিং। কার্সিয়াং হয়ে যে পথটি চলে গেছে সেটি সরাসরি পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে গেছে। সমস্ত পথটিই দুর্গম কিন্তু দূরত্ব অনেকটাই কম। মিরিক হয়ে যে পথটি চলে গেছে তার অনেকটাই নেপালের সীমান্ত ঘেঁষে চলে গেছে। দূরত্ব একটু বেশী হলেও অনেকটাই পাহাড়ের উপত্যকা ঘুরে ঘুরে ঘুম এবং দার্জিলিং-এ উঠে গেছে।
দার্জিলিং যাওয়ার পথে কার্সিয়াং হয়ে গেলেও পাহাড় থেকে নামার অর্থাত ফেরার পথে মিরিক হয়েই এসেছি। ঘুম থেকে সড়ক নম্বর ১২ শুরু হয়েছে। খানিকটা সমতলে বানানো হয়েছে এ রাস্তাটি। অনেকটা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা ঘুরে ঘুরে নির্মিত । তাই বাম দিকে তাকালে কয়েক শ’ ফুট নিচু খাদ। খাদের ওপারেই আকাশছোঁয়া পাহাড়। ডান দিকে উঁচু উঁচু পাইন গাছের জংগল। প্রকৌশল প্রযুক্তির এমন ব্যবহার সত্যি অবাক করার মতো।
উত্তর আমেরিকার অনেক সড়ক পথে গাড়ি চালিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো লেক সুপিরিয়রের পাড় ঘেঁষে সর্পিল পথে; কখনো রকি মাউন্টেনের ভিতর দিয়ে; কখনো বা আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁষে বানানো কয়েক শ’ কিলোমিটারের সড়ক পথে। ঘুম থেকে ‘লেপচা জগত’ নামক ছোট লোকালয় ধরে নেপাল সীমান্তের শহর ‘পশুপতিনগর’ পর্যন্ত এ রাস্তাটুকু ধরে চলার সময় আমার উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি নন্দন সড়ক পথের কথাই মনে হয়েছে। কী যত্ন করে প্রকৃতিকে সাথে নিয়েই উন্নয়ন হয়েছে, এবারের ভারত সফরে অনেক মেগা-প্রকল্প দেখে সে কথাই মনে হলো। এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ এ সড়ক পথটি।
দার্জিলিং থেকে ঘন্টা দেড়েক চলার পর নেপালের সীমান্তের ধারেই একটা নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি থামালাম। নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখার একটি পাহাড়ের উঁচু জায়গা থেকে নিচে তাকালেই অনেক দূরের যে বসতিগুলো দেখা যায়, সেগুলোই নেপাল। পাহাড়ের গ্রামগুলোকে স্থানীয় ভাষায় বস্তি বলা হয়। হয়ত বসতির চলিত সংস্করণ থেকেই বস্তি শব্দটি এসেছে। যদিও পাহাড়ের গ্রামগুলোর অধিবাসীরা অধিকাংশই চা-শ্রমিক। চা শিল্পের উন্নতি হয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে কিন্তু চা শ্রমিকদের জীবনযাপনে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন লাগেনি।
যতবার পাহাড়ে যাই, যতবার চা বাগানে যাই; ততবার স্মৃতির সরণী বেয়ে পেছনে চলে যাই। তখন সবে মাত্র বুয়েট থেকে পাশ করেছি। দার্জিলিং থেকে এক আত্মীয় জানালেন যে, বিশ্বব্যাংকের একটা বড় প্রকল্প চলছে চা-বাগানের বস্তি উন্নয়নের জন্য। প্রকল্প পরিচালক ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আমার সেই আত্মীয় ভদ্রলোকের বন্ধু। বুয়েট থেকে ফার্স্ট ক্লাশ নিয়ে পাশ করেছি শুনেই ভদ্রলোক বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে চাকুরী করবো কিনা জানতে চেয়েছেন। পাহাড়ের প্রতি আমার উত্সাহ বরাবরের।
তাই চাকুরীর কথা শুনেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেনাপোল থেকে কলকাতা হয়ে দীর্ঘ একদিন এক রাত বাস জার্নি করে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে পৌঁছিলাম। তখন সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ উপন্যাস দু’টো পড়ে জলপাইগুড়ি, ধুপগুড়ি, স্বর্গছেঁড়া এ নামগুলো মুখস্থ। তাই এ জায়গাগুলোতে যাচ্ছি, সে এক অভাবনীয় ভালোলাগা।
ডুয়ার্সের বিশাল অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য চা বাগান। এই চা বাগানের ব্যবস্থাপনাগুলো এখনো সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই আমলাতান্ত্রিক। অফিসার এবং মালিকদের জীবনযাপন পাশ্চাত্য ধাঁচের। ক্লাব কালচারের চূড়ান্ত রূপ। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অঢেল পানীয় আর পার্টি চলে অফিসার্স ক্লাবে। খেলাধুলা, শরীরচর্চা, তাস-জুয়া সবই চলে এ ক্লাবগুলোতে। অথচ তারই পাশে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন। আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর বস্তি বা চা-শ্রমিক কলোনী। পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকলেও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অফিসার্স ক্লাবের মতো বস্তিগুলোতেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে দেশীয় মদে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারী-পুরুষেরা। চিত্কার-চেঁচামেচি-খেউর-খিস্তিতে এক দুর্বিসহ মধ্যযুগীয় জীবন-যাপন চা-শ্রমিকদের।
বিশ্বব্যাংক তাই ডুয়ার্স ব্রাঞ্চটি এসোসিয়েশনের সাথে মিলে সে সময় কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। তেমনি একটা প্রকল্পে স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকুরীর ইন্টারিভিউ দিলাম। মিঃ মিত্র প্রকল্প পরিচালক এবং বিশ্বব্যাংকের এক বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার- এই দুইজনে মিলে প্রায় ঘন্টাখানিক ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ বলতে তেমন কিছু নয়, বাংলাদেশ নিয়ে গল্প, সাথে টুকটাক প্রকৌশল বিদ্যা নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা।
বিকেলে প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন।চা শ্রমিকদের বঞ্চনা এবং দুর্দশার কথা শুনেছিলাম কিন্তু মানবেতর শব্দটি যে মানবতার প্রতিশব্দ-সেটি আক্ষরিক অর্থেই সেদিন বুঝলাম।
অফিসারদের চা বাগানে সাহেব বলা হয়। সাহেবদের সাথে শ্রমিকদের পার্থক্য আকাশ আর পাতালের মতো – সে অবস্থা চাক্ষুষ করে মনটা বিষাদে ভরে গিয়েছিল সেদিন। নিতান্তই ব্যক্তিগত কারণে সেদিনের সে লোভনীয় সুযোগটি আমি গ্রহন করিনি। কিন্তু আমি ডুয়ার্সের নৈর্সগিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছিলাম সেদিন। যেমন কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায় এবং কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের মতো অনেকেই ডুয়ার্সের সবুজ-সৌন্দর্যের মোহাবিষ্ট হয়েছেন।
যা হোক, ভারতের সাথে নেপালের সম্পর্ক ঐতিহাসিক কারণেই ভালো। যদিও চিনের প্ররোচনায় সে সম্পর্ক এখন একটু শীতল। তবুও এখনো ভারত-নেপালের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে উভয় দেশের মুদ্রাই চলে। ভারতে এ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর অধিকাংশ বাসিন্দাই নেপালী বংশোদ্ভুত। তাই তো শিলিগুড়ি তো বটেই দার্জিলিংয়ে এলে মনেই হবে না যে, এটি নেপালের কোন শহর নয়।
দার্জিলিং- ঘুম-মিরিক-শিলিগুড়ি সড়ক পথে পশুপতিনগরে বাঁশ ফেলে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে দেখেছি এবার। ওপারে নেপালের বাজারে অনেক ভারতীয় নাগরিক শীতের জামা-কাপড় কিনতে যায়। নেপালীরাও এপারে ভারতে আসে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটার জন্য।
আধুনিক সভ্য সমাজে সীমান্ত নামক বাতাবরণটিই তুলে ফেলা প্রয়োজন। যতদিন বর্ডার বা সীমান্ত প্রথা না-উঠবে, এ রকম ন্যূনতম ব্যবস্থাপনাটুকু রাখলেও মানুষের স্বাধীন চলাচলের অধিকারটুকু খানিকটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় বৈষম্য নামক আরোপিত ব্যবধান এ বিশ্বকে যে কতো রকমে ভাগ করে রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভারত-নেপাল সীমান্ত দিয়ে মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি পথটুকু পাড়ি দিতে দিতে সে কথাই মনে হচ্ছিল। খুব মনে পড়ছিল মানুষের মৌলিক অধিকারের কথাও। এ পৃথিবীর যে কোন স্থানেই যে কোন মানুষের বসবাস করার অধিকার আছে। আধুনিকতার নামে, উন্নতির নামে আমরা কতভাবে যে ব্যক্তির অধিকারগুলোকে অবদমিত করে রাখি!
মিরিক আরেকটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। প্রায় ১৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এ মিরিকে আছে একটা সুন্দর লেক। বছর দশেক আগে মিরিক গিয়েছিলাম। যে অব্যবস্থাপনা দেখেছিলাম তখন মিরিকে, এবারে এসে দেখলাম সত্যি এক অপরূপ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে মিরিক লেকটিকে। একপাশে ফুলের বাগান এবং অন্যপাশে প্রাকৃতিক পাইন গাছের বন। লেকটির জলও অনেকটাই পরিষ্কার। নৌবিহারের ব্যবস্থাও খুব সুন্দর।
তখন পড়ন্ত বিকেল। মিরিক থেকে পাহাড়ের খাদ বেয়ে বেয়ে নেমে এলাম সমতলের শহর শিলিগুড়ি। ডাইনে-বায়ে তাকালেই দূরের পাহাড়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বানানো বাড়িঘর। অন্যদিকে চা-বাগান। পাহাড়ি পথ এক সময় দুধিয়া বাজারের কাছে এসে পাহাড় মিশে গেছে সমতলে। পাহাড় থেকে নেমেই স্বচ্ছজলের একটি পাহাড়ি নদী। দুধ সাদা রঙের পাথর। পাথরের পাশ দিয়ে বহে চলা স্বচ্ছ জলের স্রোত। এক কথায় প্রকৃতির এ এক অন্দিন্য সুন্দর উপহার। (চলবে)
(ভজন সরকারঃ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)