মণিজিঞ্জির সান্যাল : শরৎ মানেই খুশির হাওয়া, শরৎ মানেই ধূপের ধোঁয়া, শরৎ মানেই শিউলি সকাল, পদ্ম,কাশফুল, নীল আকাশ। শরৎ মানেই দুর্গা পুজো,পাড়ার মন্ডপে মন্ডপে আড্ডা, পুজোয় নতুন জামা-কাপড়, ঢাকের আওয়াজ আর? অবশ্যই ধুনুচি নাচ। গ্রাম বাংলায় যা ‘আরতি’ নামে প্রসিদ্ধ।

আহা! এই সময়টা বড্ড ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, বিশেষ করে কিশোরী বেলার কথা, মেয়েবেলার কথা। সবচেয়ে ভাল লাগে ঢাকের আওয়াজ। মনটা আকুল বিকুল করে ওঠে। ঢাকিরা দূর দূরান্ত থেকে কতদিন আগে থেকেই চলে আসে এই দুর্গাপুজোকে উপলক্ষ্য করে। একটা ঢাকির কাঠির আওয়াজেই পুজো প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে জমজমাট। সুরে সুরে বেজে ওঠে কত গান। তার সেই ঢাকের তালেই শুরু হয় ধুনুচি নৃত্য। পুজোর উৎসব আনন্দময় হয়ে ওঠে, চারপাশে তখন খুশির ছোঁয়া। এই ধুনুচি নাচ ছাড়া সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটিই বর্ণহীন, রঙহীন মনে হয়। বিশেষ করে নবমীর রাতে আগে প্রতিটি পুজো মন্ডপে এই ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা হত। এখনো হয় বেশ কিছু পুজো মন্ডপে। তাছাড়া পুরোহিতও ধুনুচি নিয়ে আরতি করেন।

বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মন্ডপে আজকের দিনেও একইভাবে চলে ধুনুচি নাচ। বাঙালির ঐতিহ্য মায়ের সামনে ধুনুচি নাচ। মা দুর্গা বাপের বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে শুরু হয় উৎসব। উত্তর-পশ্চিম ভারতে যা নবরাত্রি, পশ্চিমবঙ্গে তাই দুর্গাপুজো। আর বঙ্গের ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত প্রতিমার সামনে ধুনুচি নাচ। বয়স, লিঙ্গ, পদমর্যাদা নির্বিশেষে বাঙালি মেতে ওঠে ধুনুচি নাচে।
কিন্তু কেন হয় মায়ের সামনে এই নাচ?

ধুনুচি নৃত্য আমাদের প্রাচীন পরম্পরা। যে কোনও পুজো প্যান্ডেলে আগে সন্ধের সময় হোতো এই নাচ। এখনো কিছু কিছু পুজো মন্ডপে তা হয়ে থাকে। মাটির সরায় রাখা থাকে নারকেলের ছোবড়া, জ্বলন্ত কয়লা, কর্পূর, ধূপ আর যজ্ঞের নানা সামগ্রী। এরই নাম ধুনুচি। তা হাতে তুলে শুরু হয় নাচ। অনেকে দুহাতে দুটো ধুনুচি নিয়ে, আবার মুখেও নিয়ে নাচ শুরু করেন। তার সঙ্গে পুজোর ঢাক, কাঁসি।

মূর্তিপূজক এই জাতির শক্তিপূজার ঐতিহ্য বয়ে চলে প্রাচীন ধুনুচি নাচ। মনে করা হয়, এর সঙ্গে মহিষাসুর বধের সম্পর্ক আছে। পুরাণে রয়েছে, অতি বলশালী মহিষাসুরকে হত্যার জন্য দেবতারা মা দুর্গাকে জাগিয়ে তোলেন। মা অসুর বধের আগে নিজের শক্তি বাড়ানোর জন্য ধুনুচি নৃত্য করেন। আজও চলছে সেই পরম্পরা। সপ্তমীর সন্ধে থেকে শুরু হয় এই নাচ, চলে অষ্টমী, নবমীতেও। ধুনুচিতেই হয় মা দুর্গার আরতি।

একটা সময় প্রায় প্রতিটি প্যান্ডেলেই একইভাবে চলত ধুনুচি নাচ। এই নাচের জন্যে কোনও ক্লাস, বা অনুশীলনের প্রয়োজন পড়ে না, একজনকে নাচতে দেখে অন্যরাও এগিয়ে আসেন। বেজে ওঠে ঢাকের বাদ্যি। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে যায় প্রতিমা। মায়ের সামনে শুরু হয় বাংলার ধুনুচি নাচ।

ধুনুচি নৃত্য বা ধুনাচি নৃত্য হল প্রথাগত অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত বাঙালী এবং বেনারসী ধুনো প্রজ্বলন করে নৃত্য। এটি আরতি বা আনুষ্ঠানিকভাবে নাচের উপাসনার সময়গুলির একটি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রায়শই প্রদীপ দিয়ে আরতির পরে ব্যবহৃত হয়। বিজোড় সংখ্যার সলতে সহ প্রদীপ। তবে আজকের দিনে মানুষের মনের আনন্দের চেয়ে বাইরের লোকের কাছে নিজের আনন্দকে প্রকাশ করার তাগিদ অনেক বেশি। সবকিছু কেমন যেন উপর উপর। অন্তরের সেই টান, সেই অনুভূতি কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। লালপেড়ে সাদা শাড়ি, এক কপাল সিঁদুর আর দুর্গা প্রতিমার অপরূপ মুখ?

আর নব্য বাঙালির পুজো মানে, অষ্টমীর দিন সকালে শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি পরে পুষ্পাঞ্জলি,আর জনাকয়েক বন্ধু মিলে কোনও ডিজাইনার রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া আর সেলফি? এর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্গাপুজোর ছোট ছোট বিশেষত্ব? বারোয়ারি মন্ডপে পুজোর সময় মন মাতানো ধুনুচি নাচ? এ ছবি আজকাল আর কত জায়গায় দেখা যায় বলুন তো!

বনেদিবাড়ি আর গুটিকয়েক ফ্ল্যাটবাড়ির দুর্গাপুজো ছাড়া ধুনুচি নাচ সব জায়গায় দেখা যায় না। বাঙালির পরিধি বেড়েছে, আধুনিকতাও বেড়েছে। সেখানে জাতির বিশিষ্টের বাজনা বাজালে বাঙালি হয়ে থেকে যেতে হবে ভারতীয় বা বিশ্ব ভারতীয় হওয়া যাবে না। সেই দৌড়ে দৌড়াতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই অমূল্য সংস্কৃতি।
এবার নাচের কথায় আসা যাক।
ধুনুচি নাচ কি? পূর্ব ভারত মূলত বাংলায় দুর্গা পূজা চলাকালীন ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে যে আরতি নৃত্য করা হয় সেটিই ধুনুচি নৃত্য। এটিকে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি নৃত্য বললেও ভুল বলা হবে না। মাটির তৈরি ধুনুচিতে, নারকেল ছোবড়া আর ধুনো দিয়ে যে আরতি নৃত্য করা হত, সেই নস্ট্যালজিয়ায় এখনও ডুব দেন পাড়ার বয়োজ্যাষ্ঠরা? সেই কথা বলতে বলতে বুঁদ হয়ে যান অনেকেই। পাড়ার মন্ডপে ধুনুচি নাচে জিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার গুরুত্বটা তো এক্কেবারে আলাদা।

এই ধুনুচি নাচ বা আরতি আজ সংকটে। নতুন প্রজন্ম আর মাতে না ঢাকের তালে ধুনুচি নাচে।
কিছুদিন আগে অবধিও প্রতিটি পূজো মন্ডপে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা হত। সেই ধুনুচি নাচ দেখতে আট থেকে আশি সবার যেমন অগ্রহ দেখা যেত, ঠিক তেমনি এই ধুনুচি নাচ আর ঢাকের তাল আর ধুনোর গন্ধে ভরে উঠতো মন্ডপ প্রাঙ্গণ। সেইদিন আর নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে ধুনুচি নাচের আনন্দ দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক নাচ-গান, ডিজে ও অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থায় বর্তমান সময়ে ধুনুচি নাচকে অনেকে ভুলতে বসেছে।

কালের বিবর্তনের ধারায় অন্যান্য অনেক শিল্পের মতো হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প। ধুনুচি নাচের সময় যেভাবে ঢাকিরা ঢাক বাজিয়ে ওঠেন, তা রীতিমতো শাস্ত্রীয়।
তবে কিছু কিছু পুজোর প্রাঙ্গণে নারী পুরুষ সবাই ঢাকের তালে ধুনুচি নৃত্য পরিবেশন করেন।
কথায় বলে যে রাধে চুলও বাঁধে। শুধুমাত্র রান্না আর চুল বাঁধায় বঙ্গনারী সীমাবদ্ধ নেই। আজ ধুনুচি নাচে পুরুষের টেক্কা দিচ্ছে বঙ্গের নারীরা। পুজোর সব কাজে তো বটেও নাচেও নারীরা টেক্কা দিচ্ছে সকলকে।

কিছু কিছু পুজোয় থিমের লড়াইয়ে না গিয়ে মধ্যবিত্ত পুজো কমিটিগুলো দর্শনার্থী টানতে জোড় দিয়ে থাকে ঢাকের তালের সঙ্গে ধুনুচি নাচে। যা এক সময় প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল।

অনেকেই এই ধুনুচি নাচকে লোকনৃত্য বলে আখ্যায়িত করতেই পছন্দ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁদের যুক্তি-লোকনৃত্যের যদি একটি সাধারণ সংজ্ঞা খোঁজা হয়, তা হলে সেটি এ রকম হল যে, কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ, কোনও অনুষ্ঠান কোনও আচার বা উৎসবকে কেন্দ্র করে মনের আনন্দে দলবদ্ধ ভাবে যে নৃত্য করে তাই লোকনৃত্য। এই ছকে যদি ধুনুচি নৃত্যৃকে রাখা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে এটি দুর্গা পূজার সময় বাঙালিরা মনের আনন্দে ঢাকের সঙ্গে দলবদ্ধ বা এককভাবে নেচে থাকে। সুতরাং একে উপলোক নৃত্য বলাই যায়। আজ থেকে দশ – পনেরো বছর আগেও বাঙালী ছেলেরা ধুতি পরে দু হাতে ধুনুচি নিয়ে ঢাকের তালে নাচ করত।

বলা হয়, ধুনুচি নাচের সময় যেভাবে ঢাকিরা ঢাক বাজিয়ে ওঠেন, তা নাকি রীতিমতো শাস্ত্রীয়? তবে এখন ধুনুচি মানেই তো অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি। এখন তো থিমপুজোর মাতামাতিতে সাবেকি আবেগগুলো হারাতে বসেছে? কথায় আছে, ‘একে তো মা মনসা, তায় আবার ধুনোর গন্ধ’? তেমনি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদ্ভুত সব মিউজিক। আর এ সবের মধ্যে পড়ে ধুনুচি নাচ দিয়ে মা দুর্গার আরতি একটু ফিকে হয়েছে বইকি!

বাঙালি ঐতিহ্য গুলির যেমন সংরক্ষণ দরকার তেমন এই নৃত্য ধারারও সংরক্ষণ প্রয়োজন। এর জন্য নিজেদের উদ্যোগী হওয়া দরকার। বিভিন্ন গান বাজনা তো সারা বছর হয়েই থাকে, দুর্গাপুজার চারটে দিন তাই সবাই মিলে ঢাকের তালে ধুনুচি হাতে নাচার মজাই আলদা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিখিয়ে দিতে হবে এই অসাধারণ নাচের মনোমুগ্ধকর কৌশল।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত