ফরিদ আহমদ : উত্তরে গারো পাহাড়। তারও উত্তরে ছিলো হিমানী পর্বত। সেই পর্বতের উত্তরে সপ্ত সমুদ্দর। সেখানে গহীন অরণ্যে ছিলো বাঘ ভালুকের বাস। ভয়ংকর সেই বিজন বনে বাস করতো হুমরা বাইদ্যা। বেদেদের সর্দার সে। ভোজবাজি খেলা দেখানোই ছিলো তার দলের পেশা। তবে, এই পেশার বাইরেও চুরি-ডাকাতি করাও ছিল হুমরা বাইদ্যার আরেক পেশা। সেই কুকর্মে মানিকজোড় হিসাবে থাকতো তার ‘ছুডুভাই’ মানিক বাইদ্যা। নানা অঞ্চলে গিয়ে নানা ধরনের খেলা দেখাতো হুমরা বাইদ্যা, সেই সাথে তার অন্য পেশার কাজও চলতো।

একবার সে তার বাইদ্যার দল নিয়ে হাজির হলো ধনু নদীর পারে। সেখানে কাঞ্চনপুর নামে এক গ্রাম রয়েছে। সেই গ্রামে বাস করতো এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছয় মাসের কন্যা মহুয়াকে রাতের আঁধারে চুরি করে হুমরা বাইদ্যা। তারপর কাঞ্চনপুর থেকে পালিয়ে যায় সে। এই এক ঘটনা মহুয়ার জীবনকে পালটে দেয়।

হুমরা বাইদ্যার কোনো সন্তানাদি ছিলো না। এটাই হয়তো বাচ্চা চুরির কারণ। শিশু মহুয়াকে নিয়ে নিজের স্ত্রীর হাতে প্রতিপালনের জন্য তুলে দিলো হুমরা। হুমরার স্ত্রীই এই চুরি করে আনা বাচ্চার নাম দিলো মহুয়া সুন্দরী।

ছয় মাস পেরিয়ে ষোলতে গিয়ে ঠেকলো মহুয়া। রূপ যৌবন পাহাড়ি ঢলের মতো বাসা বেঁধেছে তার শরীরে তখন। হুমরা বাইদ্যার ভোজবাজি খেলার একজন খেলোয়াড়ও হয়ে উঠলো সে। মহুয়া শিখেছিলো বাঁশবাজি খেলা। এই খেলাই হয়ে উঠলো হুমরা সর্দারের ভোজবাজি খেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম। মহুয়ার বাঁশবাজি খেলা দেখার জন্যই বেশিরভাগ দর্শক আসা শুরু করলো। তবে, সেখানে যতোটা না তার নৈপুণ্য দেখার কারণে আসতো, তার চেয়ে বেশি আসতো অপূর্ব সুন্দরী এই ষোড়শীকে দেখার আশায়। দর্শকদের পয়সার কারণে হুমরা বাইদ্যার ব্যবসা জমে উঠলো।

হুমরা বাইদ্যার দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড় হবার পরেও মহুয়ার সাথে দলের অন্যদের সম্পর্ক ছিলো ক্ষীণ। একমাত্র পালং নামের একটা মেয়ে ছাড়া আর কারো সাথে মিশতো না সে। নিজের মতো করেই থাকতো মহুয়া।

বেদের দল এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। চির যাযাবর তারা। ব্যতিক্রম হচ্ছে বর্ষাকাল। এই সময়টাতে ভোজবাজির খেলা দেখানোর কোনো সুযোগ থাকে না গ্রাম বাংলায়। ফলে, ওই সময়টা কাটানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ঘর-দুয়ার করে তারা। হুমরার দলের বর্ষাকালীন বাসস্থান ছিলো হিমালয়ের পাদদেশের জৈতা পাহাড়ের বনভূমিতে।

বর্ষা শেষে সেবার ব্যবসার উদ্দেশ্যে বামনকান্দা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলো হুমরা বাইদ্যা আর তার দল। বামনকান্দা গ্রামের জমিদার ছিলেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। বার্ধক্যের কারণে জমিদারী দেখাশোনা করায় অসামর্থ্য ছিলেন তিনি। তাঁর ছিলো এক রূপবান নবীন ছেলে। নাম নদের চাঁদ। মায়ের পরামর্শে জমিদারী পরিচালনা করতো সে।

হুমরা বাইদ্যা তার এলাকায় এসেছে ভোজবাজির খেলা দেখাতে। স্বাভাবিকভাবেই সেই খেলা দেখার আগ্রহ জন্মালো নবীন জমিদারের মনে। খেলা দেখার চেয়েও বেশি আশা মহুয়াকে দেখার। কারণ, মহুয়ার রূপ যৌবনের খবর তার কানে চলে গিয়েছে এর মধ্যেই। মহুয়াকে দেখার পরে নদের চাঁদ মোহিত হয়ে পড়লো। মহুয়ার বাঁশবাজি খেলা আর গান শোনার পরে মহুয়া যখন তার কাছে ইনাম বখশিশ চাইলো, তখন উচ্ছ¡সিত নদের চাঁদ নিজের গায়ের হাজার টাকার শাল আর অনেক টাকা কড়ি তুলে দিলো তার হাতে। নবীন জমিদার নদের চাঁদের এমন চন্দ্রাহত অবস্থা দেখে ধূর্ত হুমরাও ইনাম চেয়ে বসলো। তার ইনাম হচ্ছে বাইদ্যাদের জন্য বাড়ি করে দিতে হবে। হুমরার এই চাওয়াতেও সায় দিলো নদের চাঁদ। কবুলিয়ত নামা করে বেদের দলের কাছে উলুইকান্দায় জমি দিয়ে দিলো সে বাড়ি বাঁধার আর চাষের জন্য।

হুমরা বাইদ্যার দলে সুজন নামে একটা ছেলে ছিলো। সে-ও দলের একজন ভালো খেলোয়াড়। গায়ে অসুরের মতো শক্তি। এ কারণে তাকে সবাই ‘কালা দেওয়া’ বলে ডাকতো। হুমরা বাইদ্যার ইচ্ছা ছিলো সুজন বাইদ্যার সাথে মহুয়ার বিয়ে দেবে। সুজন মহুয়াকে পছন্দ করে, ভালও বাসে। তার মন পাবার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি নেই তার। কিন্তু, মহুয়ার এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই।

একদিন বাড়ি ফেরার পথে নদের চাঁদের সাথে একান্তে দেখা হয়ে যায় মহুয়ার। উতলা মনের নদের চাঁদ মনের সব কথা খুলে বলতে চায় তাকে। মহুয়ার জন্য এটা একটা অভাবনীয় ব্যাপার। সেই দিন কিছু না বলে চলে এলেও নদের চাঁদের সাথে দেখা করার জন্য তার নিজের মনও উচাটন হয়ে ওঠে। পরদিন অসুস্থতার ছল করে দলের সাথে যাওয়া থেকে বিরত থাকে সে। সবাই চলে গেলে জল আনার ছল করে ঘাটে যায় সে। সেখানে আবার দেখা হয়ে যায় তার নদের চাঁদের সাথে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।

নদের চাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হলেও মহুয়ার স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পায়নি। বেদের ঘরে প্রতিপালিত সে। নিজের জাত-পাত কিছুই জানে না। আর্থিক এবং সামাজিকভাবে নদের চাঁদের সাথে তার আকাশ পাতাল তফাৎ। ফলে, দুজনের যুগল মিলন সম্ভব নয়। তারপরেও দিনান্তে নদীর ঘাটে তাকে দেখার লোভ সে সামলাতে পারে না। ঘটনা ক্রমে এ কান ও কান হয়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হুমরার কানে গিয়েও এ কথা পৌঁছায়। চিন্তিত হয়ে পড়ে সে। নদের চাঁদের জমিজমা পেয়ে ভবঘুরে জীবন ছেড়ে স্থিত হয়েছে তারা। বাড়িঘর বানিয়েছে, চাষবাস করে খাচ্ছে, সুখের দিন কাটছে। আগের ভোজবাজির ব্যবসাটাও চালু রেখেছে। এই সময় মহুয়াকে হারানো মানে তার নিজেরও উপার্জন কমে যাওয়া। ভোজবাজি খেলার মূল আকর্ষণ মহুয়া। ছুডুভাই মানিকের সাথে পরামর্শ করলো সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার। এই সুখের জীবন ছেড়ে পালাতে অস্বীকৃতি জানালো মানিক। হুমরা পড়লো উভয়সংকটে। দেশ ছেড়ে পালাতেও পারছে না, আবার ওদিকে নদের চাঁদের সাথে মহুয়ার মিলনে বাধা দেবার সাহসও তার নেই। তার এই উভয়সংকট অবশ্য বেশিদিন থাকলো না।
একদিন রাত দ্বিপ্রহরে উলুইকান্দার নদীর ঘাটে বেজে উঠলো বাঁশির সুর। বাজাচ্ছে নদের চাঁদ। সেই বাঁশির টানে ঘর থেকে বের হয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যায় মহুয়া। হুমরার কানেও গিয়েছিলো বাঁশির আওয়াজ। মহুয়াকে অনুসরণ করে নদীর ঘাটে চলে আসে সে। আড়াল থেকে দুজনের ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা শোনে সে। বুঝতে পারে এখানে থাকা মানে মহুয়াকে নিশ্চিতভাবে হারাতে হবে তার। এই প্রেমিক যুগলকে ঠেকানো যাবে না কিছুতেই। মানিক কিংবা অন্য কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য তার কাছে আর থাকে না। নিজের সর্দারির হুকুম দিয়ে এক রাতে সবাইকে নিয়ে উলুইকান্দা থেকে পালিয়ে যায় হুমরা বাইদ্যা।

বেদের দলের নিরুদ্দেশ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নদের চাঁদের হতো না। কিন্তু, মহুয়া নেই, এটা জানার পরে পাগলের মতো দশা হলো তার। পাগল হয়ে বেদেদের পরিত্যক্ত পাড়ায় এলোমেলো ঘোরে আর কাঁদে নদের চাঁদ।

কিছুদিন পরে একটু সুস্থির হলে তার মনে পড়লো মহুয়া তাকে বলেছিলো বর্ষাকালে জৈতার পাহাড়ে ঘর বেঁধে বেদেরা বসবাস করে। ওখানে গেলে নিশ্চয় মহুয়ার হদিস পাওয়া যায়। এটা ভেবে তীর্থযাত্রায় যাবে এই মিথ্যা বলে মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘরে ছেড়ে বাইরে চলে আসে নদের চাঁদ।

সত্যি সত্যিই বর্ষাকালে গিয়ে জৈতা পাহাড়ে ঘর বেঁধেছিলো হুমরার দল। কিন্তু, মহুয়া তখন অসুস্থ। নদের চাঁদের সাথে বিচ্ছেদ ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। পালিয়ে আসার ছয় মাস পরে একদিন বংসাই ঘাটে গিয়ে আচমকাই নদের চাঁদের সাথে আবার দেখা হয়ে যায় তার। নানা জায়গায় বেদের দলের সন্ধান নিতে নিতে নদের চাঁদ ঠিকই উপস্থিত হয়েছে জৈতার পাহাড়ে। আনন্দে আত্মহারা মহুয়া নদের চাঁদকে হুমরার বাড়িতেই আতিথ্য নেবার পরামর্শ দেয়।

মহুয়ার জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলো হুমরা। এমন মরণাপন্ন মেয়েকে শুধু নদের চাঁদের দর্শন পাবার পরে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখে হুমরাও অবাক। নদের চাঁদকে তাই সে বেদে দলে যোগ দেবার আহবান জানায়। সেই আহবানে সাড়াও দেয় নদের চাঁদ। দেশে গিয়ে জমিদারী চালানোর চেয়ে মহুয়ার কাছে থাকাটাই তার কাছে বেশি সুখকর। ভোজবাজির খেলাও সে শিখতে থাকে কঠোর পরিশ্রম করে। বেদের দলে থাকলেও বেদেদের খাবার খায় না নদের চাঁদ। ওই খাবার তার মতো ব্রাহ্মণের রোচে না। বেদেদের বাড়িতেও সে থাকে না। থাকে বৃক্ষতলে। এগুলো দেখে হুমরার মনে ঢুকে গেলো গভীর ভয়। তার ধারণা জন্মালো নদের চাঁদ তার দলে থাকবে না। কোনো একদিন সুযোগ পেয়ে মহুয়াকে নিয়ে পালাবে সে।
একদিন গভীর রাতে মহুয়াকে ইমোশোনালি ব্লাকমেইল করে সে। দীর্ঘদিন তাকে সন্তানের স্নেহে মানুষ করেছে, এই দাবিতে বিষলক্ষের ছুরি তুলে দেয় সে মহুয়ার হাতে। নদীর ঘাটে গিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করার জন্য কাকুতি-মিনতি করে।

ছুরি নিয়ে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো নদীর ঘাটে ঘুমন্ত নদের চাঁদের কাছে যায় মহুয়া। নদের চাঁদের শিয়রে বসে সিদ্ধান্ত নেয় সে। প্রেমিককে মারা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং তাকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো কাজ। নদের চাঁদকে জাগিয়ে তাকে দেশে ফিরে যেতে বলে সে। না গেলে, বিষলক্ষের ছুরি নিজের গলায় চালাবে বলে হুমকি দেয় সে। নদের চাঁদ আকুল হয়ে বলে যে তোমার জন্য মা-বাবা, দেশ সব ছেড়ে এসেছি। দেশে ফিরে যাবার কথা বলার চেয়ে আমার গলাতেই বরং ছুরি চালিয়ে দাও। এই রকম আবেগী প্রেমে কেউ-ই আত্মাহুতি দেয় না। বরং বেদের দলের সবচেয়ে বড় ঘোড়াটা চুরি করে দুইজনে পালায়।

ঘোড়া চালিয়ে বড় এক নদীর পারে আসে তারা। এই নদী পার হতে পারলেই বিপদমুক্তি। সমস্যা হচ্ছে নদী পার হবে কী করে? নদীর পার ধরে ঘুরে ঘুরেও কোনো নৌকা খুঁজে পায় না তারা। অবশেষে এক ডিঙ্গার দেখা পায়। ডিঙ্গাতে ছিলো এক সাধু। নদী পার করিয়ে দেবার জন্য মহুয়া আর নদের চাঁদকে ডিঙ্গায় তোলে সে।

ডিঙ্গাতে ওঠানোর পর, মহুয়ার চেহারা দেখে সাধুর গেছে মাথা খারাপ হয়ে। মাঝ নদীতে গিয়ে মাঝি-মাল্লাদের নিয়ে নদের চাঁদকে ধরে পানিতে দিয়েছে ফেলে। মহুয়াকে নিয়ে উজান স্রোতের দিকে ভেসে যেতে থাকে ডিঙ্গা। ডিঙ্গা এক ঘাটে ভিড়েছে। সেখানে মহুয়ার প্রতি সাধু তার প্রণয় প্রস্তাব দিয়েছে। তাকে হিরামণি দিয়ে ভরে দেবে বলে লোভ দেখালো। সাধুর কথা শুনে সবার জন্য পান সাজালো মহুয়া। চুলের মধ্যে পাহাড়ি তক্ষকের বিষ লুকানো ছিলো। পান আর খয়েরের সাথে সেই বিষ মিশিয়ে দিলো সে। পান খেয়ে সাধু আর তার মাঝি-মল্লারা যখন ঢলে পড়েছে, মহুয়া তখন পালালো সেখান থেকে।

নদের চাঁদ তাকে রেখে মরতে পারে না, এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে নদীর কুল ধরে ছুটতে থাকে মহুয়া। দিনের পর দিন নদের চাঁদের সন্ধান করতে থাকে সে। তখন আর সুস্থ কোনো মানুষ না সে, উন্মাদিনী একজন। বনের পশু-পাখি, গাছ-পালা, সবাইকে সে জিজ্ঞেস করে নদের চাঁদের কথা। এভাবে কতো দিন গেছে, কেউ জানে না। হতাশ হয়ে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয় সে। ঠিক সেই সময়ে মানুষের আর্তস্বর কানে ভেসে আসে তার। বনের ভিতর থেকে কার যেনো কাতর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে থেমে থেমে। বনের ভিতরে গিয়ে এক ভাঙা মন্দির আবিষ্কার করে সে। মন্দিরের ভিতরে গিয়ে দেখতে পায় মৃতপ্রায় কেউ একজন শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখে, ওটাই তার ভালবাসার মানুষ নদের চাঁদ। আগের সেই রূপকান্তির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শুকিয়ে হাড্ডিসার এক লাশে পরিণত হয়েছে সে। সেই মড়ার পাশেই বসে থাকে মহুয়া সারারাত। সকালে এক সন্ন্যাসী আসে। সন্ন্যাসীর পা ধরে কেঁদে ফেলে মহুয়া। নদের চাঁদকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য করুণ আর্তি জানায়। জঙ্গল থেকে নানা ঔষধি পাতা এনে ওষুধ বানিয়ে খাইয়ে নদের চাঁদকে খানিকটা সুস্থ করে তোলে সন্ন্যাসী।

এ পর্যন্ত ভালোই ছিলো। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অন্য জায়গায়। ডিঙ্গার সেই সাধুর মতো, মন্দিরের এই সন্ন্যাসীরও নজর পড়ে মহুয়ার ‘যইবনের’ প্রতি। নদের চাঁদকে কিছুটা সুস্থ করে তুলেছে, এর বিনিময়ে ‘যইবন’ প্রার্থনা করে সে। মহুয়া তাকে শর্ত দেয়, আগে আমার সোয়ামীকে পুরো সুস্থ করে তোলো, তারপর আমার যৌবন তোমাকে দেবো আমি। সন্ন্যাসী অবশ্য এই শর্তে রাজি হয় না। মাত্র দুই দিনের সময় দেয় মহুয়াকে সমর্পণের জন্য।
সাধুর ভাব-গতিক সুবিধার না দেখে, নিশি রাতে শীর্ণকায় নদের চাঁদকে কাঁধে নিয়ে মন্দির থেকে পালালো মহুয়া। বহুদূর অতিক্রম করে তবেই নিশ্চিন্ত হলো সে। একটা জায়গা দুজনের বেশ পছন্দ হলো। কাছেই লোকালয় এবং হাটবাজার আছে। বন থেকে লতাপাতা, বাঁশ কুড়িয়ে এনে ছোট্ট একটা কুটির বানালো তারা। পাখির পালক, লতা, পাতা, ঘাস দিয়ে নানা ধরনের শিল্পদ্রব্য তৈরি করে মহুয়া। নদের চাঁদ সেগুলো হাটে নিয়ে বিক্রি করে। সুখেই দিন কেটে যেতে থাকে তাদের।

এই সুখের দিনেও একদিন বিষের বাঁশি বেজে ওঠে। দূরে শোনা যায় বাইদ্যাদের বাঁশি। এই বাঁশির আওয়াজ শুনে সাপে না কাটলে বিষের ভারের আক্রান্ত হয়ে পড়ে মহুয়া। তার সুখের দিন যে শেষ হতে চলেছে, এটা বুঝে যায় সে। বাইদ্যার দল শিকারি কুকুর নিয়ে ঘিরে ফেলে মহুয়াকে। কুটির থেকে বের হয়ে দেখতে পায় বিষলক্ষের ছুরি হাতে যমের মতো দাঁড়িয়ে আছে হুমরা বাইদ্যা। পাশেই সুজন বাইদ্যা ওরফে ‘কালা দেওয়া’। তার হাতেও ছুরি ধরা। মহুয়াও প্রস্তুত। আজ সে কিছুতেই ধরা দেবে না। তার হাতেও রয়েছে কাঙ্কালেয় ছুরি। মহুয়াকে ছুরি হাতে দেখে কালা দেওয়া আর এগোনোর সাহস পেলো না। নদের কাছ থেকে দ্রæত বিদায় নিয়ে নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দিলো মহুয়া। নদের চাঁদ ছুটে এসে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে। এই সুযোগে কালা দেওয়া তার পিঠেও ছুরি বসিয়ে দেয়। দীর্ঘ এক পথ পরিক্রমার সমাপ্তি ঘটে দুই প্রেমিক প্রেমিকার। পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবেসে আলিঙ্গনরত অবস্থায় একই সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা।

‘বাইদ্যা কন্যা মহুয়া’ বা ‘মহুয়া’ পালাটির রচয়িতার নাম দ্বিজ কানাই। দ্বিজ কানাই সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। জন্ম ভাওয়াল পরগণায়। প্রবাদ আছে যে এই পালার সাথে তাঁর নিজের জীবনেরও মিল রয়েছে খানিকটা। দ্বিজ কানাই ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি নমশূদ্র সমাজের অতি হীনকুল জাতের এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই প্রেম সফল হয়েছিলো কিনা জানা যায় না। না হবারই কথা। সেই প্রেমের কারণে যে কষ্ট তিনি সহ্য করেছিলেন, সেটাই তিনি করুণ রসে সিক্ত করে ঢেলে দিয়েছিলেন মহুয়া পালাতে।

১৬০০ থেকে ১৬২০ সালের কোনো এক সময়ে এই পালাটা রচিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’-র সংগ্রাহক ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিকের ভাষ্য অনুযায়ী এটা আরো পুরনো সময়ে লেখা। সপ্তদশ শতাব্দীর লেখা এটা নয় বলে তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাঁর মতে এটা পঞ্চদশ শতাব্দীর লেখা। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন যে, ‘এই ভাষা ও ছন্দে দেখা যায়, উহা বর্তমান মৈমনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩৬০-৪০০ বৎসরের মধ্যে প্রচলিত ভাষা ও ছন্দ নহে, মধ্য মৈমনসিংহে পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রচলিত ভাষা ও ‘ভাওয়ালী’ ছন্দ। মধ্যে মধ্যে তদপেক্ষা প্রাচীন ভাষা ও ‘সুষঙ্গী ধাঁচের’ ছন্দও দেখা যায়। ইহাতে মনে হয় ঘটনাটি পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ঘটিয়াছিল।’

মহুয়া পালার একটা চমৎকার গীতিকা তুলে দিচ্ছি এখানে। এই অংশটা দেখলেই এই পালার যে কাব্যরস সুধা, সেটার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। মধ্যযুগে রচিত হবার পরেও এর কাব্যগুণ অসাধারণ, ছন্দ লালিত্যময়, উপমাগুলো অনিন্দ্য সৌন্দর্যময়। এই অংশটা কোলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলো গান হিসাবে ব্যবহার করেছিলো কয়েক দশক আগে। ময়মনসিংহ গীতিকা নামের সেই অসাধারণ গানটা এখনো দারুণভাবে জনপ্রিয়।
নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইগন।
সেই বাইগন তুলিতে কইন্যা জুড়িল কান্দন।
না কাইন্দ না কাইন্দ কইন্যা না কান্দিয়ো আর।
সেই বাইগন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার হার।।
নয়া বাড়ী কইর্যা রে বাইদ্যা লাগাইলো উরি।
সে উরি বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের চুড়ি।।”
নয়া বাড়ী কইর্যা রে বাইদ্যা লাগাইলো কচু।
সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু।।
নয়া বাড়ী লইয়্যা রে বাইদ্যা লাগাইলো কলা
সেই কলা বেচ্যা দিয়া তোমার গলার মালা।।
নয়া বাড়ী পাইয়্যা রে বাইদ্যা বানাইলো চৌকারী।
চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া ঘরে আয়না সারি সারি।।
হাঁস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া।
ভালা কইর্যা রাইন্দো বেনুন কাল্যা জিরা দিয়া।।