ফরিদ আহমেদ : বিএসএফের পাবলিক রিলেশন অফিসার ছিলেন সমর বসু। তিনি উপেন তরফদারকে পরিহাস করে বলতেন, “কি হে! বাংলাদেশের যুদ্ধ তো তোমরা ত্রিমূর্তিই জিতিয়ে দেবে।”
সমর বসু যে ত্রিমূর্তির কথা বলতেন তাঁর একজন তো অবশ্যই উপেন তরফদার। বাকি যে দুইজন, তাঁর একজন হচ্ছেন প্রণবেশ সেন, এবং অন্যজন হচ্ছেন দেব দুলাল বন্দ্যোপাধায়। এঁরা তিনজনই আকাশবাণী কোলকাতার সংবাদ বিভাগে কাজ করতেন। প্রণবেশ সেন পরিচালনা করতেন ‘সংবাদ পরিক্রমা’, অন্যদিকে উপেন তরফদার ছিলেন ‘সংবাদ পরিক্রমা’ নামের একটা অনুষ্ঠানের প্রযোজক। দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অসামান্য কণ্ঠের একজন সংবাদ পাঠক।
এঁরা ভারতীয় হলেও এবং আকাশবাণীতে কাজ করলেও, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ওতপ্রোতভাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ভারত শুরু থেকেই নিজেকে যুক্ত করেছে। পঁচিশে মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংস এক গণহত্যা পরিচালনা করে বাঙালিদের উপরে। প্রাণভয়ে ভীত হয়ে মানুষ ছুটতে থাকে সীমান্তের দিকে। বাংলাদেশের তিন দিকে ঘিরে থাকা ভারত বাংলাদেশের মানুষদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। পাকিস্তানি আক্রমণে শুধু যে পলায়ন ঘটে, তাই নয়। প্রতিরোধ যুদ্ধও শুরু করে বাংলাদেশ। ঘোষিত হয় স্বাধীনতা। প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রাথমিক রসদ আসে ভারতের কাছ থেকে।
মুজিবনগরের প্রবাসী সরকার গড়ে উঠলেও, সেটা মূলত কাজ করতে থাকে কোলকাতায় ঘাটি গেড়ে। শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প, ফিল্ড হাসপাতাল, এগুলোও তৈরি হয় ভারতের মাটিতে। একই ভাষাভাষী হবার কারণে পশ্চিম বঙ্গ এবং ত্রিপুরার মানুষরা এগিয়ে আসে আপনজনের মতো। নিজেদের সমস্ত সমস্যাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশের মানুষদের জন্য এগিয়ে দেয় সাহায্য এবং সহযোগিতা। পশ্চিম বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন ভালো ছিলো না। এর উপরে সেখানে তখন চলছিলো নকশাল আন্দোলন। সেই অবস্থাতেও পশ্চিম বঙ্গের মানুষেরা অকুণ্ঠ সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এদের সাহায্য না পেলে, শুধুমাত্র ভারত সরকারের পক্ষে এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না।
আকাশবাণী, বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রও বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। কলম অস্ত্র এবং শব্দের বাণ নিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধে তারাও নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এটা ছিলো আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় এক অধ্যায়। উপেন তরফদার লিখেছেন, “আমার কর্মজীবনে এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায় বলে মনে করি। নির্যাতিত নিপীড়িত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে ওপার বাংলার সংগ্রামী ভাই-বোনেদের সঙ্গে আমরাও এক একজন সৈনিক হয়ে লড়াই করছি। অবশ্য আমাদের লড়াইটা ছিল রণক্ষেত্রে নয়- বেতারের মাধ্যমে।”
‘ওপার বাংলার’ ভাইবোনদের সঙ্গে নিজেরও সৈনিক হয়ে যাওয়াটা উপেন তরফদারের জন্য অনেকখানি সহজই ছিলো। তিনি নিজেও ওই ‘ওপার বাংলার’-ই একজন। তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি পদ্মার পারে, মানিকগঞ্জে। মাইনর স্কুল শেষ করে কোলকাতা চলে গিয়েছিলেন উচ্চতর পড়াশোনা করতে। এর মধ্যে দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতির ক‚ট খেলায়। নাড়ি পোতা নিজের জন্মস্থানই হয়ে গিয়েছে ভিন্ন দেশ। তবে, তিনি দেশভাগের কারণে কোলকাতায় যাননি, গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। সেই যাওয়াটাই একমুখী যাত্রা হয়ে গিয়েছে। আর ফেরা হয়নি তাঁর। যে কারণে ভিন্ন দেশ হলেও, বাংলাদেশের যুদ্ধে নিজেও কলম হাতের সৈনিক হতে তাঁর বেশি বাঁধেনি। নাড়ির টানকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তিনি নিজেও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বলেছেন, “আজ অবসর জীবনে মাঝে মাঝে ভাবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমনভাবে সামিল হবার পেছনে শুধু কি আমাদের পেশাগত দায়বদ্ধতাই কাজ করেছিল? শুধুই কি কর্তব্যনিষ্ঠা আমাদের সেদিন এমনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে অতীতের স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হয়, হাতড়াতে হাতড়াতে আমি পৌঁছে যাই আজকের বাংলাদেশের অজানা এক গ্রামে।”
এই কলম যুদ্ধ করতে গিয়ে উপেন তরফদারকে ঘুরতে হয়েছে নানা জায়গায়। যেতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে এবং রণাঙ্গনে। সেখান থেকে শব্দ ধারণ করে কিংবা নানা গল্প জোগাড় করে সেগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে এবং গভীর আবেগ ঢেলে পরিবেশন করতেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে, “আমাদের দেশে তখনও দূরদর্শন আসেনি আর সেই সময় ‘সংবাদ বিচিত্রা’ই ছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বাইরে থেকে রেকর্ড করে আনা একমাত্র সংবাদ-ভিত্তিক অনুষ্ঠান। স্বভাবতই এর জনপ্রিয়তা ছিল খুবই বেশি।”
তিনি তাঁর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এবং অংশুমান রায়ের গাওয়া শোন, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিই আকাশে বাতাসে ওঠে রণি, পালাক্রমে চালিয়ে অনুষ্ঠান সাজিয়েছেন। সেটা দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। অংশুমান রায় এবং তাঁর গান বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। তাঁর অনুষ্ঠানে তিনি পঁচিশে মার্চ ঢাকা শহরে পাকিস্তান আর্মি যে নির্যাতন, ধ্বংস এবং হত্যা-লীলা চালিয়েছে সেটার অডিও চালিয়েছেন। এটা তাঁকে দিয়েছিলো ঢাকার এক তরুণ। সেই শব্দাবলী এতোই নৃশংস যে মানুষ টেলিফোন করে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছে।
এই ধরনের নৃশংস ঘটনা অবশ্য তাঁকে অনেক শুনতে হতো শরণার্থী শিবিরে আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপের সময়ে। সেগুলো শুনে রেকর্ড করে নিয়ে আসতেন তিনি। প্রচারের আগে সেই রেকর্ড বারবার শুনতে হতো তাঁকে। তাঁর জন্য এটা একটা ভয়ংকর অত্যাচার ছিলো। তারপরেও তিনি সেই লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেননি। কারণ, তারচেয়েও অনেক বেশি অত্যাচার সহ্য করেছে এই মানুষগুলো। উদাহরণ হিসাবে আয়েশার কথা বলা যায়। মাত্র দশ বছরের মেয়ে আয়েশা। তাঁর চোখের সামনে পাকিস্তান বাহিনী তার বাবা-মা-ভাই-বোন সবাইকে দল বেঁধে এসে কুপিয়ে হত্যা করে গিয়েছে। এই ঘটনায় মেয়েটা এতোই আতঙ্কিত ছিলো যে তার মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরতেও সে ভয়ে লাফিয়ে উঠেছিলো।
তবে, সবটাই যে আতঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে যাবার গল্প নয়, সেটাও তিনি বলেছেন আমাদের। বনগাঁ সীমান্তে তিনি গুলিবিদ্ধ এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছেন। সবে তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তার জামা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তার জরুরী অস্ত্রোপচারের জন্য রেডি হচ্ছেন। সেই তরুণ উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে চলেছে, “আমাকে আপনারা বাঁচান, আমাকে বাঁচান। আমার মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে ওরা শেষ করেছে। আমি ওদের ছাড়বো না। আমি বদলা ৃ. এই কথা বলতে না বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো সেই তরুণ। ব্যথাকে জয় করে, মৃত্যুকে এক পাশে সরিয়ে রেখে প্রতিহিংসার আগুনে নিজেকে পোড়াচ্ছিলো সেই নাম না জানা তরুণ।
এ রকম অসংখ্য বেদনাবিধুর, প্রতিরোধমূলক, প্রতিহিংসা পরায়ণ ঘটনার তুলে এনেছেন তিনি হাটে-মাঠে ঘুরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক দিনের সংগ্রাম না। বিজয় সহজেও আসেনি। অনেক ত্যাগ, রক্ত আর নিরলস সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে। তাদের সেই ত্যাগ আর সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়গুলোকেই উপেন তরফদার তাঁর লেখা বই “বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ”- এ তুলে এনেছেন।
ক্ষীনদেহী এই বইটা তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ হতে পারে। কারণটা হচ্ছে, একাত্তরই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ভিত্তিভ‚মি। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস আছে, কিন্তু আসল বাঁকবদলটা ঘটেছে ওই একাত্তরেই। ভিত্তিটাকে তাই ঠিকমতো না জানলে, উপরিকাঠামোটা তৈরি করা যায় না।