সাজ্জাদ আলী : খানিকটা হেঁটে এগুতেই দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুরটি কানে লাগলো। “ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া” মনকাড়া সেই গানটির সুর। কেউ একজন অযতেœ থেমে থেমে গানের পদগুলো বাজাচ্ছে। ছন্দ বা লয়ের দিকে বাদকের যেন মনোযোগ নেই। তবে যতটুকু বাজাচ্ছে তাতে সুরের কারুকাজ এবং বাদকের মুন্সিয়ানা দুটোই নিখুঁতভাবে ফুটে উঠছে। হয়তোবা মনের কষ্টগুলো সুরে সুরে বলতে পেরেই তার সুখ, সে তাল লয়ের ধার ধারে না। ধ্বনিটি ঠিক বাঁশের বাঁশির মতো শোনাচ্ছে না। অনেকটা সানাই আর বাঁশির মিশ্রণ বলে মনে হলো। বাঁশিয়ালকে এখনও দেখতে পাচ্ছি না। তবে সুরের উৎসের দিকেই এগুচ্ছি আমরা।
রাস্তায় ইট বিছানোর কাজ চলছে। রাজমিস্ত্রী, জোগাইলা, সবাই ব্যস্ত। ছড়ানো বালি আর ইটের পাঁজার মধ্য দিয়ে পা বাঁচিয়ে আমরা দুই ভাই লঞ্চঘাটের দিকে এগুচ্ছি। বাহার উদ্দিন খাঁন, আমার নাটু ফুফুর মেজ ছেলে। বয়সে আমার থেকে ৮/৯ বছরের বড় হবে। তবে আমরা পরস্পরের ঘনিষ্টতম বন্ধু। তার স্নেহ, প্রশ্রয়, আর মানিব্যাগ আমার জন্য সদা উন্মুক্ত। টুঙ্গিপাড়া থেকে পাটগাতী লঞ্চঘাট পর্যন্ত রাস্তায় ইট বিছানো কাজের ঠিকাদার সে। ব্যবসার তদারকি করতে ওখানটায় গিয়েছে, আমি খামাখাই তার সাথী। বাঁশির সুরটি আমাকে আউলা করেছে। বাউলা মনে পা ফেলতে গিয়ে ইটের আধলায় গুতা খেয়ে বালির উপর চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম। দ্রæত আমার হাত দুখানা ধরে টেনে তুলতে তুলতে বাহার ভাই চেঁচিয়ে উঠলো,
আরেকটু হইলেই তো তোর মাথাডা ইটের পাজার উপর গিয়া পইড়তো। আইজই তো খ্যালা শ্যাষ হইছিলো। কী এমন বালের বাঁশি যে তা শুইনা গুণগুণাইস, আর আছাড় খাইস?
অ্যাই তুমি গান-বাজনা নিয়া কথা কইও নাতো, পিঠের বালি ঝাইড়া দাও। এটুকু বলে নিজে প্যান্টের বালি ঝাড়তে লাগলাম।
ক্ষেপিস ক্যা ভাডি, আইজ তুই বড় একটা বিপদ থেইকা বাঁচলি। মাথাডা ইটের উপর পড়লি আর রক্ষা ছেলো না।
তা না হয় বুঝলাম! তয় আছাড় খাওয়ার মধ্যি তুমি গানের দোষ খোঁজ ক্যা? আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত যে তুমি গানের কদর করো না! যদি কইরতা তয় গাঁও গেরামে আর “সুর” খুঁইজা পাওয়া যাইতো না।
সময়টা গত শতকের। সেই ১৯৮১ বা ’৮২ সালের মাঘ মাস সেটি। গোপালগঞ্জ-টুঙ্গীপাড়া এলাকা তখন চরম অনুন্নত। সড়ক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। জলপথই যাতায়াতের মাধ্যম। পাটগাতি লঞ্চ স্টেশনটিতে তখন কোন স্থায়ী মোকাম বা বাজার গড়ে উঠবার উপায় নেই। মধুমতি নদীর ভাঙ্গনে লঞ্চ ঘাটটি আজ যেখানে আছে কাল তো সেখানে থাকবে না। ঢাকা-বরিশাল-খুলনাগামী বড় বড় লঞ্চগুলো পাটগাতী ঘাটে থেমে এ এলাকার যাত্রীদের নামায় উঠায়। দিনে হয়তো চার-পাঁচখানা লঞ্চ ঘাটে ভেড়ে। এই লঞ্চ আসবার আধাঘন্টা আগে ও পরে ঘাটে কিছু লোক সমাগম হয়। বাকি সময় এখানটা জনশুণ্য।
বাঁশের খুটির উপর ছনের ছাউনি দেওয়া একচালা ছাপড়া ঘর। এটাই মজিদ মিয়ার খাবারের হোটেল। লঞ্চ ঘাটে আর কোনো দোকানপাট নেই। খরিদ্দারদের বসবার জন্য দোকানের সামনেই একখানা শীতল পাটি পাতানো। গাছের গুঁড়ি মাটিতে পুঁতে তার উপরে তক্তা ফেলে একখানা বেঞ্চিও বসানো রয়েছে। সেই বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে ৭/৮ বছরের এক বালক চোখ মুদে পাতার বাঁশিতে সুর তুলছে। আর রোদে পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাঁটুতে মাথা গুজে বসে মজিদ মিয়া মাঘি-শীত উপভোগ করছে। নিঝুম দুপুর, নদীর কলতান, আর বাঁশীর সুর -সব মিলিয়ে সে এক মোহনীয় পরিবেশ!
বেলা তখন দুইটা আড়াইটা বাজে, আমরা ভারি ক্ষুধার্ত। হোটেলের সামনে যখন পৌঁছেছি তখনও বাঁশি বাজছে এবং মজীদ মিয়ার পিঠে রোদ আছড়ে পড়ছে। দোকানের ছাপড়ার মধ্যে দুটো আগলা মাটির চুলায় নিভু নিভু ধোঁয়াটে আগুন। একটিতে মাটির পাতিল বসানো, আরেকটিতে সিলভারের ছচপেন। পাশেই রাখা মাঝারী সাইজের আরো দুটো ডেকচি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। ঘরের এক কোনে গামছা পেতে তার উপর ৫/৭ খানা টিনের থালা, ফুল আঁকা ৪টি কাঁচের গøাশ, ভাত/তরকারী বাড়ার ৩/৪টি পিতলের চামচ, টিনের ছোট্ট বাটি ভর্তি লবন, ইত্যাদি রাখা। তারই পাশে দুটো মাটির ঘড়া ভর্তি সম্ভবত খাবার জল। ছাপড়া ঘরের এক কোনায় গাছের শুকনো ডাল আটি করে বাঁধা, বোধ হয় চুলার লাকড়ি ওগুলো।
আমাদের উপস্থিতি টের পেতেই ছেলেটির বাঁশি থেমে গেল। আর সুর থামতেই মজীদ মিয়া মাথা উঁচু করে চাইলো। ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো সে। বললো, অ্যায় রন্টু উইঠা খাড়া, সাবগো বইসতে দে। আমি দু-কদম এগিয়ে ছেলেটির কাছে গিয়ে স্বস্নেহে বললাম,
তোমার নাম রন্টু?
হ’ রন্টু, তাতে আপনের কী ? মহা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো সে।
না, কিছু না ভাডি। এমনেই তোমার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। তুমি তো ভারি ভাল বাঁশি বাজাও! শিখলে কীভাবে?
শিহি নাই, এমনে এমনেই পারি, তাতে আপনের কী?
না, আমার কিছুই না। কিন্তু তুমি রাগতেছো ক্যান? আমি না হারমোনি বাজাতি পারি, তাই তোমার বঁিশি বাজানোর কথা জানতি চাইছি।
আমি তো গোসা করি নাই, তাতে আপনের কী? এবারেও রাগত জবাব তার।
প্রত্যেক কথার শেষে এই “তাতে আপনের কী, তাতে আপনের কী” বলে ছেলেটার উগ্র জবাবে বাহার ভাই’র মাথা পুরাই গরম হইছে। বললো,
ওই ফাজিল তুই কথার শ্যাষে বেয়াদবের মতো “তাতে আপনের কী, তাতে আপনের কী” কইতিছিস ক্যান? তোর সমস্যা কি?
ছেলেটি এ কথার কোন জবাব না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। যেন বুঝতেই পারেনি যে “তাতে আপনের কী” বলাটা অস্বাভাবিক কিছু। তবে রন্টু কী বলেছে না বলেছে তা আমি কানে তুলিনি। আমার কান জুড়ে রয়েছে ওর বাঁশির সুর। কী মনোমুগ্ধকর বাদন রে বাবা! আর তা সে শেখেনি কারো কাছে, একেবারে প্রকৃতির দান। ছেলেটির নিস্পাপ মুখ, মাথায় লম্বা বেনি করা চুল, আর বুদ্ধি ভরা ডাগর চোখ দুটোর উপরে জোড়া ভুরু! গ্রাম্য প্রকৃতি যেন সর্বস্ব জড় করে রন্টুকে কলাকার বংশিবাদক তৈরি করেছে।
আমার সবদিনই বিশ্বাস যে, সৃষ্টিশীল মানুষদের কিছুটা “অসামাজিক (!)” হওয়ার অধিকার থাকে। আর সমাজকে তা সহ্য করতে হয়। নইলে শিল্পকলা বিকশিত হয় না। সেই বিবেচনা থেকে আমি মনে করি বংশিবাদক রন্টুর আমাদের মতো সামাজিক (!) হওয়ার দরকারই নাই। তবে আমি যাই ভাবি না কেন বাহার ভাই ছেলেটাকে “আদব” শিখিয়েই ছাড়বে। মজীদ মিয়ার দিকে ফিরে বললো,
চাচাজান, এইডা আপনার পোলা? ওরে কিচ্ছু শিখান নাই? ওর কতাবার্তা তো ফাউল!
হ’ বাজান, আমারই ছাওয়াল। আবার হে আমার কেউ না! তয়, ভারি ভাল পোলাডা, স্বভাব চরিত্রির সৎ, ম্যালা কাজের কাজী। রান্দা, বাজার করা, হোইটেল চালানো, টাহা-ফয়সার হিসাব রাহা, সব কামে পোক্ত। তাগাদা দিতি ওয় না, নিজি নিজি বুইজা করে। বুদ্দি আছে।
মানে কি? ও আপনের ছাওয়াল না? বাহার ভাই মজিদ মিয়ার পাশ ঘেষে শীতল পাটিতে গিয়ে বসলো।
মধুমতির জলে উদাস দৃষ্টি মেলে মজীদ মিয়া বললো,
ও আমার ছাওয়াল না তয় কার ছাওয়াল? ওরে আমি পোলাই মানি। বছর পাঁচেক আগে একদিন খুলনার লঞ্চখান ছাইড়া যাওনের পরে দেহি ঘাটে খাড়াইয়া পোলাডা “মা মা” কইয়া কাইনতাছে। মন কয় লঞ্চের সিঁড়ি বাইয়া ঘটে নাইমা আইছিল। হ্যার পর খালাশি সিঁড়ি উঠাইছে, সারেং লঞ্চ ছাইড়া চইলা গ্যাছে। পোলাডা পইড়া রইছে ঘাটে! কি করবো বাজান, রাখছি আমার কাছে। অহন এই হোইটেলডা রন্টুই চালায়, এইখানে খায়, এইখানেই ঘুমায়। লঞ্চ আইলেই আইজও আমি ঘাটে যাইয়া দাঁড়াইয়া থাহি, যদি ওর মা ছাওয়ালের খোঁজে আহে?
ঘটনা শুনে বাহার ভাই থ’মেরে বসে রইলো, মুখে রা’টি নেই। আমার শিরা-উপশিরা দিয়ে কষ্টের শীতল শ্রোত দ্রুত বইছে, দাঁড়াতে পারছি না আমি। ধপাস করে বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। হায় খোদা, কোন বিবেচনায় তুমি এই কিশোরটিকে এমন ভাগ্য বিড়ম্বিত করেছ? এমন গুণি একটি অবুঝ ছেলেকে তুমি কিনা পথের কাঙ্গাল বানালে? সে জানেও না যে সে কে? অযত্নে বেড়ে উঠবার কারণেই ছেলেটির স্বভাব খিটখিটে হয়েছে। তাই হয়তো সে মুদ্রাদোষের ছলে “তাতে আপনের কী, তাতে আপনের কী” প্রশ্নবাণে বিশ্বব্রাণ্ডকে অভিযুক্ত করছে।
রন্টু ছাপড়ার এক কোনায় বসে নারকেলের খোসায় ছাই মেখে থালা গøাস মাজছিলো। মজীদ মিয়া তাড়া দিলেন, “ও রন্টু মিয়া, সাবরা কি খাইবো জিগাও”। ছাই মাখানো হাতে সে দৌঁড়ে এসে বললো,
কী খাইবেন সাব? দাঁত বের করে হাসি দিয়ে ছেলেটি গালে টোল ফেললো!
কী কী আছে রন্টু? বাহার ভাই কথা বলছে।
আইজ রানছি হাঁসের বয়জা কুপ্তা, ফুটি মাছ আর নাইলের চচ্চড়ি, ট্যাংরা মাছের ছালুন, আর “মুরগির সেট”। পানি ডাইল আর গুড়ের শরবত মাগনা। যেন মুখস্ত বলে গেল ছেলেটি।
আচ্ছা, তাইলে আমারে তুমি ডিম আর ট্যাংরা মাছ দাও। আমার দিকে ফিরে বাহার ভাই বললো, তুই কি খাবি?
এই রন্টু, তুমি যে কইলা “মুরগির সেট” রানছো, ওইডা কি রকমের খাবার কও তো? জানতে চাইলাম আমি।
সাব, মুরগীর “গিলা, কইলজা, মাইটা, গলা আর মাথা” এই কয়ডা মিলা হইলো একটা সেট। ওই গুলান দিয়া কষাইয়া ছালুন রানছি।
রন্টুর ছেটের ব্যাখ্যা শুনে আমাদের দুভাইয়ের তো হাসতে হাসতে পেটে খিল। রন্টুও হাসছে আমাদের সাথে। কোনো মতে নিজেদের সামলে নিয়ে আমরা উভয়েই “সেট” খাবো বলে রন্টুকে জানালাম।
খাওয়া শেষ করে বাহার ভাই’র মানিব্যাগ হাতড়ে পাঁচটা টাকা নিয়ে বকসিশ হিসেবে রন্টুর হাতে গুঁজে দিলাম। বললাম ভাইডি, তুমি আরেকটা গান বাজাও, শুনে ফিরে যাই। খুব বিরক্ত হলো সে। বললো,
এই ট্যাকাটা দ্যান ক্যা? খাবারের দাম তো দেছেনই!
তোমার বাঁশি বাজানো শুইনা খুশি হইয়া দিছি। তুমি এটা রাখ ভাই।
না, নিমু না। ট্যাকা লাগবো না। তাতে আপনের কী ?
এই রে সেরেছে! ক্ষেপিয়ে দিলাম বুঝি ছেলেটাকে! শিল্পীর আত্মসম্মান বলে কথা! খানিকটা নতসুরে বললাম,
আচ্ছা, টাকা থাক তাইলে। বাশিঁ বাজাবে তো?
বাজামু, তাতে আপনের কী?
বেঞ্চিখানিতে গিয়ে বসলো রন্টু। হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বাঁশপাতা বের করে পেচিয়ে পেচিয়ে বাঁশি বানালো। তারপরে তাতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সুর টিউন করলো খানিকক্ষণ। অবশেষে বাজনা ধরলো,
“নবী মোর পরশমণি, নবী মোর সোনার খনি
নবী নাম জপে যেইজন সেই তো দোজাহানের ধনী-”
চোখ বন্ধ রেখে, গাল ফুলিয়ে পাতার বাঁশিতে সুর তুলছে রন্টু। কী নিখুঁত সে সুর, একেবারে মরমে এসে বিঁধছে! তার ঠোঁট আর বাঁশপাতা যেন সুর নিয়ে খেলছে। সকরুণ সে বংশিধ্বনি নিশ্চয়ই মদিনায় নবীজি’র রওযায় পৌঁছে থাকবে।
সে বাদন শুনতে শুনতে মজীদ মিয়ার দুচোখে জলের ধারা, আমি মোহিত, আর বাহার ভাই বিরক্ত!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)