মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
আটচল্লিশ.
‘কানাডা’ বলতে বহুজাতিক দেশের যে চিত্র আমাদের সামনে ভেসে উঠে, পাপিনিউ’র সেই নির্বাচনী প্রচারণা সেই বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং অন্যকে এই বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করানোর জন্য আমার কি করা প্রয়োজন, সেই ব্যাপারে এক রকম গভীর চিন্তা আর কাজের মধ্যে আমাকে ঠেলে দেয়। যদিও চার্টারে এই বিষয়ে পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে, তারপরও এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভুল বুঝাবুঝি আছে। শুধু রেডিও’তে এ ব্যাপারে কিছু ভাসা-ভাসা কিছু শুনে বা সংবাদপত্রে এ সম্পর্কে কিছু দৃষ্টিনন্দন সংবাদ দেখে যদি ভাবা হয়, বহুসংস্কৃতি বলতে সমাজে যার যে ইচ্ছে তাই করবে এবং কেউ যদি তার সংস্কৃতির চর্চা করতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করে বা অন্যকে অপমান করে এবং এর জন্য তাকে কিছু বলা যাবে না, সেটা কিন্তু সত্যি নয়। পাপিনিউ’তে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা হচ্ছে এটা কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভীতিকর। আমি যে সব অভিবাসীদের সাথে কথা বলেছি, তাদের বেশির ভাগই অনুধাবন করে কানাডার সংস্কৃতি কোন দিকে যাচ্ছে। তারা উপলব্ধি করেছে, কানাডা এমন একটি দেশ যেখানে বহু ধর্মের মানুষ নিজ নিজ স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে যেমন বসবাস করবে, ঠিক তেমনি এখানে কোনো লিংগ বৈষম্য আর কারো প্রতি কোনো রকম ঘৃণা বাক্য ব্যবহার করা যাবে না। সব অভিবাসীরাই কানাডার এই সব নিয়ম-নীতি আনন্দের সাথে মেনে নিয়েছে। তারা সবাই এটাও অনুধাবন করে কানাডার যে আইন তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। যখন ক্রিমিনাল কোড বা পারিবারিক আইন -এর বিষয় আসে, তখনও কানাডায় কোনো বিশেষ কোন জাতি বা গোত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আমি পাপিনিউ’তে অনেক পরিবারের সাথে মিশেছি এবং লক্ষ্য করেছি, তাদের অনেকেই তাদের মধ্যে পূর্ব পুরুষের সময় থেকে জিইয়ে থাকা কোনো দ্ব›দ্ব বা শত্রæতা মনের মধ্যে পুষে রাখে, কিন্তু কানাডায় এসে এবং বসবাস করে তারা অন্তত এটা পরিস্কারভাবে বুঝে ফেলে যে, কানাডা এমন এক দেশ যেখানে পূর্ব পুরুষ-পরম্পরায় যে দ্ব›দ্ব মনের মধ্যে জিইয়ে আছে, তা ঝেড়ে ফেলতে হবে, এই ভূমিতে বাস করলে সেই পুরনো শত্রুতা জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না।
তাহলে সেই সব মানুষ এবং আমার কাছে বহু-সংস্কৃতি বলতে কি বুঝাচ্ছে? এটা এমন এক ধারণা যেটা সমাজের সবাই নিজের নিজের সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে পালন করবে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে অবশ্যই কোনক্রমেই সমাজের আসল মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা যাবে না। এটার ফলে একজন ইহুদী যেমন তার মাথায় সেই ছোট্ট টুপি ‘কিপ্পা’ পড়তে পারবে, তেমনি একজন শিখ তার মাথায় পাগড়ী পড়তে পারবে। একজন মুসলিম যেমন তার মাথায় ওড়না পড়তে পারবে, ঠিক তেমনি একজন খ্রীস্টান ক্রুশশোভিত পোষাক পড়তে পারবে। আমি যখন ২০০৭ সালে আমার নির্বাচনী প্রচারণা চালানো শুরু করি, তখন কুইবেকের ক্ষমতায় জ্য চারেস্ট’এর লিবারেলরা। আর তখনই পার্টি কুইবেকস পরিকল্পনা করছিলো ‘কুইবেক চার্টার অব ভ্যালুজ’ নিয়ে মাঠে নামবে, যাকে তারা বলতে যাচ্ছিলো ধর্ম নিরপেক্ষ এক চার্টার। কিন্তু তাদের এই চোখ ধাঁধানো কাজ কর্ম আর ফাঁকা বুলি নতুন অভিবাসীরা তখনই ধরতে পেরেছিলো এবং এই নিয়ে যে কোনো আলোচনায় চায়ের কাপে ঝড়ও উঠতো। ২০০৭ সালে যখন তারা কুইবেকে নতুন অভিবাসীদের জন্য বসবাসের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলো, তখনই হিরোক্সভিল নামে একটা ছোট্ট শহরে একটা নিয়ম পাশ করলো যে কোনো অভিবাসী মহিলা ধর্মীয় লেবাস পড়ে কাজে যেতে পারবে না। কিন্তু সবচেয়ে হাসির বিষয় হচ্ছে, তারা যে শহরে এমন নিয়ম-কানুন চালু করেছিলো, সেই শহরে কোনো অভিবাসী বাস করতো না, আর তারা কখনো সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি চর্চা ফলে কোনো ঝামেলা হতে পারে, এমন কোনো পরিবেশ কখনো অবলোকন করেনি।
ভীতির কারণ হতে পারে এমন যে কোনো নিয়ম-নীতি বা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলাম আমি, এবং আমি এখনো সেটার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। সত্যি বলতে কি, আমি সত্যিই গর্ববোধ করি কারণ আমি হচ্ছি ফেডারেল পার্টির কোনো একজন নেতা যে প্রথম ২০১৩ সালে সরাসরি পার্টি কুইবেকস এর ধর্ম নিরপেক্ষ সেই চার্টারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম। একজন মা যদি তার বিশ্বাসের প্রতি অটুট থেকে সেই মত নিজের জীবনে চালাতে চাই এবং উপার্জন করতে চাই, তবে কেনো সে নিজের বিশ্বাস পালন করে কাজ করতে পারবে না? তার এই লেবাসের জন্য যদি তাঁকে পাপিনিউ’তে আর কাজ করতে না দেয়া হয়, তাহলে সেটা কি ধরনের মানবিক বিষয় হবে? পাপিনিউ অভিবাসীরা কি তাদের ধর্মীয় পোষাক ঝেড়ে ফেলে কি পার্টি কুইবেকস এর সেই চার্টার মেনে নিবে। আমি জানি, তারা কাজ করতে চাই, উপার্জন করতে চাই আর ভালোভাবে বাঁচতে চায়, আর সবকিছুই করতে চাই তাদের স্ব স্ব ধর্ম ও বিশ্বাস বজায় রেখে। আমরা চাই আমরা সবাই মিলে নতুন এক কানাডা তৈরী করবো যা পুরনো সব খারাপ নিয়ম-কানুনকে দূর করে দিবে। কানাডার এই সুন্দর নতুন পথে চলার জন্য আমরা সহায়কের ভূমিকা পালন করবো, কখনোই আমরা কানাডাকে পিছনের দিকে টেনে ধরবো না।
আমার মনে হয়, বহু-সংস্কৃতি কিভাবে আমাদের ভালো ফল দিতে পারে, তার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, সামাজিক চুক্তির একটা চিত্র তুলে ধরা। এই সামাজিক চুক্তি অন্যুায়ী, কানাডায় আসা নতুন অভিবাসীরা এখানকার নিয়ম-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হবে এবং তারা তাদের সন্তানদের এই সমাজে ভালোভাবে মিশে যাবার জন্য যে ভাষা জানা দরকার সেটা খুবই ভালোভাবে শিখে নিবে, এবং সমাজের যে সব রীতিনীতি ফলে কানাডার বিভিন্ন ব্যক্তি মানুষ এবং দলের মধ্যে যে সুন্দর বিরাজ করে সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে। অন্যদিকে, যারা এ ভূমিতে নতুন আসছে, তাদের সংস্কৃতির প্রতি আমরা সবাই সম্মান জানাবো। যেটা তাদের কাছে অনেক মূল্যবান এবং যা কখনো অন্য কারো প্রতি ক্ষতিকর নয়, এমন বিষয়কে কখনো আমরা কোনো রূপ অমর্যাদা করবো না। মাথায় পাগড়ী পরার জন্য যদি নয় বছরের কোনো ছেলেকে ফুটবল খেলার মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়, বা মাথায় হিজাব পরার জন্য যদি কাউকে ডে-কেয়ারের চাকরী থেকে বহিস্কার করা হয়, অথবা কোনো কার্ডিওলজিস্ট’কে যদি শুধু ‘কিপ্পা’ পরার জন্য অপারেশন কক্ষ থেকে বের করে দেয়া হয়, সেগুলো কখনো নতুন কানাডার জীবনে কাম্য হতে পারে না, এবং সেই সামাজিক চুক্তিতে এই বিষয়গুলোও থাকতে হবে যেগুলো আমাদের পক্ষ থেকে যেন কখনো না ঘটে।
সম্ভবত কানাডায় হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটা তার বহু বৈচিত্রের জন্য এত বেশী শক্তিশালী, এই বৈচিত্রতা এই দেশকে দূর্বল বা বিভক্তির দিকে নিয়ে যায় নি। বৈচিত্রতাই আমাদের জীবনের ধ্যান-ধারণা আর দর্শনকে গড়ে তুলেছে, আর আমাদের সফলতার মূল কারণও হচ্ছে এই বৈচিত্রতা। এই বৈচিত্রতার সুবাস ছড়িয়ে আছে কানাডার ছোট-বড় সব শহরে। আমি যদি বলি, তবে এটা অবশ্যই সত্যি যে, আমাদের এই ধ্যান-ধারণা আর দর্শন গোটা পৃথিবীর কাছে এক অনন্য বিষয় এবং পৃথিবীকে এক সুন্দর আগামীর দিকে চালিত করতে এটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই কারণে, আমি সব সময় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় এত বেশী তৎপর থাকি, আর চার্টার অব রাইটস আর মুক্তির কথা সবাইকে সবাইকে জানিয়ে দেবার চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি, কানাডিয়ান হিসেবে আমরা একে অপরের অধিকারের প্রতি যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশ করি, তা করি আমাদের হৃদয়ের একেবারে অন্তঃস্থল থেকে। আর এই ভালোবাসা আর প্রচেষ্টার ফলেই কানাডা হয়েছে তার অধিবাসীর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে মুক্ত, সুন্দর আর পরম বাসযোগ্য এক স্থান।