মুরশাদ সুবহানী : মানুষের বাস কোথায়? এককথায় মানুষের বাস সমাজে। মানুষ সমাজবদ্ধ। এই সামাজিক মানুষের বুদ্ধি-বৃত্তি-প্রজ্ঞার কারণে মানুষের মনে নানান প্রশ্ন আসে। মানুষের চারপাশে কি? কি ঘটছে? কেন ঘটছে? মানুষকে কে বানিয়েছেন? এই পৃথিবী এতো সুন্দর করে কে গড়ে তুলেছেন? কোন শিল্পী ফুলে নানা রঙ দিয়েছেন? এই সব নানা প্রশ্নই মানুষের মন ও মননে, চিন্তা-চেতনায় দার্শনিকভাবের উদ্ভব ঘটিয়ে চলেছে। চিন্তা যেমন স্থিতিশীল নয়; তেমনি দার্শনিক চিন্তাও স্থিত নয়। বিবর্তনশীল। মানুষ আজ যে দর্শনকে আগলে ধরছে, কিছুকাল পর সেটা পরিত্যাগ করে আর এক দর্শনের দিকে যাচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় চিন্তার মধ্যেও দর্শন আছে। ধর্ম দর্শনের বাইরে নয়। সামাজিক মানুষ তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞার সমন্বয়ে সব কিছু জানাতে চায়। এই চাওটা তাঁর কৌতূহল। কৌতূহল এক ধরণের দর্শন। প্রাচীন গ্রীসে, ভারতে, চীনে দেখা দেয় আমাদের চারদিকে বিশ্ব নিয়ে নানা ধরণের মত, এই মতকে বলা হলো দর্শন। দর্শন হল বিশ্ব, অস্তিত্বের মর্মার্থ, মানবিক চেতনা নিয়ে সর্বাধিক সাধারণ ধারণাগুলির একক সমষ্টি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক মহামতি সক্রেটিসের মতে, “জ্ঞান অনুরাগ থেকে দর্শনের উৎপত্তি।” সাম্যবাদ দর্শনের উন্মেষ ঘটে প্রাচীন কালেই। মহামতি সক্রেটিস ও তাঁর ছাত্র প্লেটো ছিলেন সাম্যবাদী দর্শনের ধারক বাহক। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের জনক অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, “যতগুলো শাসন ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে মন্দের ভালো গণতন্ত্র।” গণতন্ত্র হলো সেই শাসন ব্যবস্থা যেখানে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে কয়েকজনকে নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছে রাষ্ট্র পরিচলনার ভার তুলে দেন।

এই দর্শনের আড়াই হাজার বছর পরে মার্কসবাদের দর্শনের উদ্ভব হয়। জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ড. কার্ল মার্কস, জার্মানের সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁরা ছিলেন সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদের বস্তুবাদী দার্শনিক। ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সে যখন সব রকমের মধ্যযুগীয় ‘জঞ্জাল’-এর বিরুদ্ধে, প্রথা প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণায় নিহিত ভূমিদাস-বৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই ফুঁসে উঠেছিল, তখন বস্তুবাদ এক নতুন দার্শনিক তত্ত¡ নিয়ে আসে। একই সাথে ভাববাদী দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন পরষ্পর বিপরীত ও বৈরী হয়ে দেখা দেয়। বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তাশীলরা বিশ্বাস করেন কুসংষ্কারে আচ্ছাদিত, প্রগতিশীল বিজ্ঞান নির্ভর বস্তুবাদের বিরোধী এবং ভাববাদী দর্শন চিন্তাশীলরা পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে সাহায্য করে। ধর্মের সংরক্ষণে অথবা সমর্থনে। এখানেই বস্তুবাদ, ভাববাদ আর ধর্ম দর্শনের মধ্যে দ্ব›দ্ব প্রোথিত হয়। বস্তবাদী দার্শনিকরা মনে করেন, ভাববাদী আর ধর্ম দর্শন এই গুলো শোষকদের মোক্ষম হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের মাধ্যমে মানুষকে শোষণ করা খুব সহজ। ভাববাদী দার্শনিকরা সেই কাজটি করছেন। তাঁরা প্রজ্ঞাশীল প্রগতিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে শোষকদের হাতকে শক্তিশালী করে তুলছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম দর্শন। বস্তুবাদী দার্শনিকরা ধর্মকে আলাদা করে মানুষের আত্মিক বিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁরা মানতে রাজি নন যে, ধর্ম শুধু আত্মিক শুদ্ধি, ইহজগত এবং পরকালে ভালো থাকার একটি উত্তম পথ এবং ধর্ম সামাজিক অনুশাসন। সামাজতান্ত্রিক সাম্যবাদ সমাজ ব্যবস্থার প্রবক্তা কাল মার্কস, এঙ্গেলস এবং মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী নেতা ভলাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিন যাঁর মাধ্যমে রাশিয়ায় কার্ল মার্কসের দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক নতুন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি মার্কসের দ্যা ক্যাপিটাল গ্রন্থের মূল বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্যবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেন।
‘‘মার্কসবাদের বিকাশে নতুন পর্যায় সূচিত হয় ১৯১৬ সালে প্রকাশিত লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে। এতে তিনি সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক মর্মার্থ, তার বিরোধসমূহ এবং ধ্বংসের অনিবার্যতা উদ্ঘাটিত করেন এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে সাম্রাজ্যবাদ হলও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাককাল।” যা লেনিনবাদ নামে পরিচিত।
লেনিনবাদ এই দর্শনও বস্তুবাদ দর্শন। এই দর্শনগুলো ধর্মকে দূরে সরিয়ে রাখে। স্মর্তব্য, জার্মানীর বাসিন্দা কাল মার্কসের নিজ দেশে সমাজতন্ত্র এসেছে রাশিয়ায় সামজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে। তাও অর্ধেক অংশে। এই শাসন ব্যবস্থার দর্শন বেশি দিন টেকসই হয়নি জার্মানীতে। সোভিয়েট রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ অবকাঠামো ভেঙ্গে সেখানে এখন পুঁজিবাদী দর্শনের আদলে রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু সমাজতন্ত্রের আবরণটা আছে। যে কারণে কয়েকজন পলিটব্যুরোর সদস্যরা মিলে একজনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে পারেন। চীনে কমরেড মাও সেতুং এর মার্কসীয় ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক দর্শনও টিকে নেই।

সমাজতন্ত্রের সাথে ভাববাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় দর্শনের দ্ব›দ্ব আছে। সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র আসলে আলাদা দুটি শাসন ব্যবস্থার নাম। ধর্ম মানুষের বিশ্বাস, সামাজিক অনুশাসন এবং ধর্ম দর্শনেও রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে ইসলামী দর্শনে শাসন কার্য পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে।

কোন দর্শন যদি ধর্মের বিপরীতে যায় তাহলে ধর্মানুসারীরা সেটা মানেন না। আবার কোন দর্শন যদি শাসন কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে মানুষের যে কোনো ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশ্বাসকে নসাৎ করতে চায় তাহলে সে দর্শনের সাথে ধর্ম দর্শনের দ্ব›দ্ব প্রকট হয়ে উঠতে পারে বা প্রকট হয়ে ওঠে। দেখা যায়; বস্তুবাদের সাথে ভাববাদের, গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্রের, আবার ধর্মের সাথে আর এক ধর্মের পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু; দর্শন মতবাদে ভিন্নতা আছে সেই কারণে দ্ব›দ্ব আছে। দ্বান্দ্বিক অবস্থা থাকার ফলে এক দর্শনের সাথে আর এক দর্শনের দ্ব›দ্ব প্রকট হয়ে উঠতে পারে এবং প্রকট হয়ে ওঠে। এক সময় এসে পূর্বের দর্শনের স্থলে অন্য দর্শন জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক দর্শন ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই দর্শনের উপর শাসন কার্য পরিচালনা করছে।

দর্শনের সাথে পুঁজির একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থ-বিত্ত ছাড়া রাষ্ট্র, মানুষ অচল। পুঁজির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থলে অন্য কোনো ভালো দর্শন-মতবাদ ভবিষতে আসে তাহলেও অর্থ-বিত্তের প্রয়োজন হবে এবং দ্ব›দ্বও থাকবে। #
লেখক : সাহিত্যের সেবক, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ । ফ্লোরিডা, ইউএস প্রবাসী।