ফরিদ আহমেদ : পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ পদত্যাগপত্রটা যিনি লিখেছিলেন, তিনি একজন বাঙালি। আমাদের এই পূর্ব বঙ্গেরই মানুষ তিনি। দেবেশ রায় তাঁর উপন্যাসে তাঁকে উল্লেখ করেছেন ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’ বলে। দেবেশ রায় তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেও, তিনি উপন্যাসের কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। জ্যান্ত একজন মানুষ ছিলেন। আমাদের পূর্ব বঙ্গের মানুষ হলেও তাঁকে নিয়ে গর্ব করার উপায় আমাদের নেই। কারণ, আমাদের এখান থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিলো তাঁকে চরম সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে।
বরিশালে জন্মেছিলেন যোগেন মণ্ডল। যৌবনে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। শুরুতে কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য থাকলেও পরে তিনি দলিত নমশূদ্রদের নেতাতে পরিণত হন। বরিশালে তখন বিপুল সংখ্যক নমশূদ্র বা তফসিলি সম্প্রদায়ের বাস। এদেরকে সংগঠিত করতে থাকেন তিনি। ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে বাকেরগঞ্জ-ভোলা থেকে অশ্বিনী কুমারের ভাতিজা সরল কুমার দত্তকে হারিয়ে দেন তিনি। দেশ ভাগের আগ দিয়ে তিনি মুসলিম লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন। অখণ্ড ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তান সৃষ্টি এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ করায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। গোপনে মুসলিম লীগের সহযোগী সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। যোগেন মণ্ডল একমাত্র হিন্দু, যিনি পাকিস্তানের অর্থ করেছিলেন ‘পবিত্র-ভূমি’। এই ‘পবিত্র ভূমি’-তে তিনি তফসিলি সম্প্রদায়ের আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যত এর স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে বেশি দিন সময় লাগেনি অবশ্য।
১৯৪৬ সালেও তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন। ইতিমধ্যে তিনি বাংলা প্রদেশে নাজিমউদ্দিন মন্ত্রীসভায় সমবায়মন্ত্রী হন এবং পরে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভায়ও বিচারমন্ত্রী ছিলেন। এ সময়গুলোয় যোগেন মণ্ডল জিন্নাহর প্রধান এক রাজনৈতিক সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাকিস্তানের সব নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করবে। তিনি যাদের নেতা, সেই দলিত সম্প্রদায় সুখে শান্তিতে মুসলমানদের সাথে সহাবস্থান করে দিন কাটাতে পারবে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এটা তখন আসামের অংশ ছিলো। গণভোটের বিষয় ছিলো এটা আসামের অংশ হিসাবে ভারতে থেকে যাবে নাকি পূর্ব বঙ্গের সাথে যুক্ত হয়ে পাকিস্তানের অংশ হবে। জিন্নাহ তাঁর বিশ্বস্ত সহচর হিসাবে নির্বাচনের আগে যোগেন মণ্ডলকে সিলেটে পাঠান কাজ করার জন্য। দিনের পর দিন সেখানে তিনি কাজ করেন, মানুষকে বোঝান যাতে করে তারা সিলেটকে পূর্ব বঙ্গের অংশ করার পক্ষে ভোট দেয়।
জিন্নাহ-র প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা এবং পাকিস্তানের প্রতি ভালবাসার কারণে দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রীও হন যোগেন মণ্ডল। জিন্নাহর অঙ্গীকারে যোগেনের প্রবল আস্থা ছিল। সেই আস্থাটাই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তফসিলিদের মাঝে। যে কারণে পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ নমশূদ্র ও দলিত ভারতে পাড়ি জমায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল তারা।
জিন্নাহ-র মৃত্যুর পরে এই পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে। হিন্দুদের উপর নেমে আসতে থাকে চরম অত্যাচার। একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতে থাকে পাকিস্তান। তিনি নিজেও হয়ে পড়েন কোণঠাসা। এই অবস্থায় হতাশ এবং বিক্ষুব্ধ যোগেন মন্ডল ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে কোলকাতায় চলে যান। সেখান থেকে আট হাজার শব্দের দীর্ঘ এক পদত্যাগ পত্র লেখেন তিনি। সেই পদত্যাগপত্রে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন এবং বৈষম্য সংঘটিত হচ্ছে তার এক করুণ এবং মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন তিনি। সেই চিঠির এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন,
“উদ্বিগ্নভাবে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা ভাবনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, পাকিস্তান হিন্দুদের জন্য নয়। এবং তাদের ভবিষ্যত ধর্মান্তরকরণ বা বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো অশুভ সম্ভাবনা দ্বারা আচ্ছন্ন। বিরাট সংখ্যক বর্ণ হিন্দু এবং রাজনীতি সচেতন তফসিলি পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেছেন। এই ভেবে আমি ভীত যে, এই অভিশপ্ত প্রদেশে এবং পাকিস্তানে যে সকল হিন্দুরা বসবাস করতে বাধ্য হবেন, তাদেরকে ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিতভাবে হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হবে, নয়তো সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে।”
কোলকাতাতে থেকেও নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। পূর্ব বঙ্গ থেকে যে সমস্ত হিন্দু নির্যাতিত হয়ে দেশত্যাগ করে ওখানে যেতো, তাদের দেখভাল করতেন তিনি। ওখানে অবস্থানটাও তাঁর সুখকর হয়নি। ভারতের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু, ওখানকার হিন্দুরা দেশভাগের আগে তাঁর পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়াটাকে ভোলে নাই। ফলে, তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিতে কার্পণ্য ছিলো তাঁদের। ১৯৬৭ সালে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তখন তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করা হয়েছে। যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের পরিবর্তে যোগেন আলী মোল্লা বলে ডাকা হতো তাঁকে। নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তিনি।
এইসব অপমান, বিদ্রূপ আর লজ্জার কারণেই কিনা কে জানে, পরের বছরই মারা যান তিনি।