ভজন সরকার : বঙ্গবন্ধু গান ভালোবাসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে আন্দোলন সংগ্রামে জনমত সংগঠিত করতে তিনি বিখ্যাত সংগীত শিল্পীদের সাথে নিতেন। এ কথাগুলো আমরা তাঁর লেখাতেই পাই।
বঙ্গবন্ধু রচিত এ পর্যন্ত প্রকাশিত দু’টো বই। বলাই বাহুল্য দু’টো বই-ই জেলেখানায় বসে লেখা ডাইরি থেকে সঙ্কলিত। প্রথম বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনার সময় দেশভাগ অর্থাৎ ১৯৪৬ থেকে ভাষা আন্দোলন অর্থাৎ ১৯৫২ সন পর্যন্ত। ২য় বই ‘কারাগারের রোজনামচা’, যার রচনাকাল ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ অর্থাৎ ছয় দফা আন্দোলন পর্যন্ত।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বঙ্গবন্ধু অনেকবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন। সংগীত বিশেষকরে মানুষ ও মাটির গন্ধভরা দেশের গান বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে টানতো সে কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু দেশভাগের পরপরই বুঝেছিলেন পাকিস্তানীদের সাথে বেশী দিন থাকা সম্ভব নয়। বাঙালিকে একটি ভূখন্ড এবং ভাষার জন্য লড়াই করতে হবে। ১৯৪৮ সালেই তার প্রমাণ মিলল উর্দুকে যখন রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা এলো। সে সময় বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন জনমত সংগঠিত করতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহুকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরের এক হাইস্কুল উদ্বোধনে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন মরমী গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমদ এবং তাঁর দুই শিষ্য সোহরাব হোসেন এবং বেদার উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে অনেক রাত পর্যন্ত গান হলো। রাতে যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা সেখানেও গান হলো। পরের দিন নদী পথে ঢাকা ফিরছেন তাঁরা। সে নদী পথে বঙ্গবন্ধুর সাথে শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কথা হয় গান নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সে সব কথা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’- তে লিখেছেন এভাবে,
“নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। “আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।” (১১১ নম্বর পৃষ্ঠা, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
ইতিহাসও বলে আব্বাসউদ্দিনের “মুজিব” কথা রেখেছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য জেল খেটেছিলেন। বাইরে থেকেও কাজ করেছিলেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন। সমগ্র বিশ্ব রবীন্দ্রনাথকে সম্মানের আসনে দেখে, বঙ্গবন্ধু নিজে সেটি বিশ্বাস করতেন। তাই ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি চিনে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন তখন তিনিই একমাত্র ডেলিগেট যিনি বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য থেকে উদ্দৃতিও দিয়েছিলেন। এর প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে পাই। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,
“পূর্ব পাকিস্তানী থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না?… পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।” (পৃষ্ঠা নম্বর ২২৮, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’)।
বাংলা ভাষার প্রতি এমন দরদ ও ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু হয়ত পেয়েছিলেন তাঁর দেশাত্মবোধ ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা থেকে। তাই তো যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা এবং বাংলা গান-সাহিত্যকে তুলে ধরেছেন। চিন শান্তিসম্মেলনে তার প্রমান পাই। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,
“আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু (পশ্চিমবঙ্গ) ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।
বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশবাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব।” (পৃষ্ঠা নম্বর ২২৮-২২৯, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’)।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল। বঙ্গবন্ধুও সারা দেশ ঘুরে ঘুরে জনমত সংগঠিত করছেন। সেই সাথে আইনি লড়াইও করছেন। করাচিতে গিয়ে তিনি আইনী লড়াইও করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল যে ভাষার কবি সে ভাষা কেনো রাষ্ট্রভাষা হবে না; কিছু এডভোকেট নিয়োগ করে তিনি সেটা বুঝিয়েছিলেন। এ প্রসংগে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আরো একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যায়,
“আমার কাছে তাঁরা (আইনজীবিরা) নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’- আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। কবিগুরুর কবিতার ইংরেজি তরজমা দু’একজন পড়েছেন বললেন।” ( পৃষ্ঠা নম্বর ২১৭ ‘ অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ )। (অসমাপ্ত)
(ভজন সরকারঃ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )