Home কলাম বঙ্গবন্ধুর নামে ভাস্কর্য ও নামকরণ

বঙ্গবন্ধুর নামে ভাস্কর্য ও নামকরণ

আকতার হোসেন : মনে পড়ে যাচ্ছে বিখ্যাত সেই গানের কলি ‘হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে’।

বঙ্গবন্ধুর নামে কতগুলো স্থাপনা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে সে তথ্য সরকারের কাছে আছে কিনা জানি না। তবে আমার জানা মতে বঙ্গবন্ধুর নামে স্কুল কলেজ রাস্তাঘাটের নামকরণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। সরকারি সিদ্ধান্তেও বঙ্গবন্ধুর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে একাধিকবার। অনেক আগে একবার লক্ষ্য করেছিলাম ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে, বঙ্গবন্ধু ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা তাঁর নামে স্থাপনার নাম হতেই পারে। তাঁকে নিয়ে কোন শিল্পী ভাস্কর্য গড়তেই পারেন। তাই বলে যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেন? বঙ্গবন্ধু হলেন বাংলার সব শ্রেষ্ঠ সন্তানের অন্যতম। তিনি আমাদের জন্য মহান আদর্শ রেখে গেছেন। বাঙালি জাতি আজীবন তাঁর কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’ এই বিশ্বাসে আমাদের কাজ করে যেতে হবে যাতে পাকিস্তান এবং তাদের দালালেরা নতুন কোন প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র করতে না পারে। পাকিস্তানের পরাজয় এখনো যারা মেনে নেয়নি তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিহীন উৎপাদন করে যাচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে শহরে প্রবাসে তাদের কমতি নেই। এদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের শক্তির উৎস খুঁজতে হয়। নেতা হিসেবে তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে পাহাড় সমান ভরসা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। কাজেই তাঁকে অবয়বেও যেমন বাঁচিয়ে রাখতে হবে তেমনি তাঁর সফলতা ও সংগ্রামের প্রতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। একই সাথে আমাদের অন্যান্য সম্মানী ব্যক্তি ও বীরদের সাথেও পরিচয় সূত্র তৈরি করতে দিতে হবে। কিন্তু সবকিছু হতে হবে সীমার মধ্যে। যেদিন শুনেছিলাম যমুনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ নামকরণ করা হয়েছে সেদিন বলেছিলাম এটা ঠিক হয়নি। একদিন যমুনা সেতু থেকেও বড় সেতু হবে দেশে। তখন নতুন সেতু যদি কোন ব্যক্তির নামে করতে হয় তবে কার নামে সেটা হবে? এই প্রতিযোগিতা থেকে বঙ্গবন্ধুকে দূরে রাখা প্রয়োজন। যেমন ধরুন আজ যদি ভোলা দ্বীপের ওপর একটি সেতু করা হয় স্বভাবতই ভোলা সেতুটির নামকরণ করার জন্য তোফায়েল আহমেদ বা অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তির নাম উত্থাপিত হবে। যদি আয়তনে বা বৈশিষ্ট্যে ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ থেকে ভোলা সেতু বড় হয় তখনও কি সেটা অন্য ব্যক্তির নামে করা হবে? হলে তো ভাল, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় না সেটা সম্ভব। নামকরণ হতে হবে যার নাম মানুষ একদিন ভুলে যেতে পারে বা যিনি বিশেষ কোন ক্ষেত্রে যেমন শিল্প কলা সাহিত্য শিক্ষা সমাজসেবা ধর্মপ্রচার শাসনকর্তা হিসেবে বিশেষ অবদান রেখেছেন, সেরকম কোন ব্যক্তির নামে। উদ্দেশ্য, অতীতের এই ব্যক্তির কর্ম অন্য কাউকে উদ্বুদ্ধ করবে। এভাবেই সমাজ চিত্র বদলায়।

বঙ্গবন্ধুর সীমা অতিক্রম করে অচিরেই অন্য কোন রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশে আসবে বলে মনে হয় না। কেননা তাঁর মাপের নেতারা প্রতি বছর জন্ম নেয় না। এমন ব্যক্তিরা ক্ষণজন্মা। এদের জন্য জাতিকে যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হয়। আমদের দেশে অনেক সুশাসক আসবেন, অনেক নেতা আসবেন, অনেক পরিত্রাণকারী আসবেন কিন্তু আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর যখন আসার প্রয়োজন ছিল আমাদের সৌভাগ্য তিনি এসেছিলেন ঠিক সময়ে এবং চলে গেছেন সর্ব শ্রেষ্ঠ কাজটি সম্পূর্ণ করে। সেকারণে তিনি বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে দিনদিন প্রসারিত হচ্ছেন। এমন লোকের ভাস্কর্য চৌরাস্তার মোড়ে যানবাহনের ধূলিকণা আর হর্নের মধ্যে গিয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে কে দেখবে? একবার এক বেবিট্যাক্সির পেছনে লেখা দেখেছিলাম ‘বঙ্গবন্ধু পরিবহন’। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম সেটা দেখে। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে কোন স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা কিংবা ভাস্কর্য গড়ার অনুমোদন দিতে একটি কেন্দ্রীয় অনুমোদন কমিটি গঠন করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। যেমন তেমন ভাস্কর্য কিংবা নামকরণের অনুমোদন না দেওয়াই ভাল। ইট সিমেন্ট পেলে একজন রাজ মিস্ত্রীও বাড়ির সামনে একটা ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলতে পারে। তেমনি একটি ভাস্কর্য দেখেছিলাম সাগরদাঁড়ি গ্রামে গিয়ে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি বেঁচে থাকতেন তবে তিনি সাদা চুন আর কালো রঙে গড়া তাঁর ভাস্কর্য দেখে দৌড়ে পালাতেন। জানি না সেই ভাস্কর্যটি এখনো টিকে আছে কিনা? দেশের বেশিরভাগ ভাস্কর্য নান্দনিক তা বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর নামে পুরো দেশে প্রতিযোগিতা দিয়ে ভাস্কর্য করার কোন প্রয়োজন আছে তাও মনে করি না। আগ্রহকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তীর্থ স্থানে যেতে হয়, তীর্থ স্থান গড়াতে হয় না। অমুক জেলার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের চেয়ে আমাদের জেলারটা বড় এই প্রতিযোগিতায় যেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেউ কাড়াকাড়ি না করে। এতে প্রতিযোগিতায় জড়িত ব্যক্তিরা শুধু আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারবে কিন্তু মহান ব্যক্তির কোন উপকার হবে না। তাই বলছি, রুচিসম্মত দুই একটা থাকলে সেটাই বরং ভালো। রাস্তার মোড়ে ফুটপাথের কোনায় অবহেলা অযতেœ বঙ্গবন্ধু উপস্থিতি শোভনীয় নয়। হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবন্ধুকে দেখা আর হেঁটে এসে তাঁকে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য।

Exit mobile version