মুন্সী বশীর : ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিবৃত্তে একটি ভ্রমাত্মক অকল্পনীয় প্রবল যোজনা ও বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫-সালের এ দিনে মুজিব মন্ত্রীপরীষদের বাণিজ্য মন্ত্রী ও সাবেক স্বঘোষিত রাষ্ট্র প্রধান বহু নিন্দিত খন্দকার মোশতাক আহমদের মহা পরিকল্পনায় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারবর্গসহ এক ভয়াবহ দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হন।
১৯৭১-সালে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাবস্থায় মুজিবনগর সরকারের অজ্ঞাতে চক্রান্তকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ মার্কিন মধ্যস্থতার মাধ্যমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি আপোষ রফার মাধ্যমে কনফেডারশন গঠন করার গোপন পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরও খন্দকার মোশতাক আহমেদ শেখ মুজিব বিরোধী ষড়যন্ত্র অতীব গোপনে অব্যর্থ রেখেছিলেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন উক্ত বিদ্রোহের অন্যতম মুখ্য নকশাদার ও মূল অধ্যক্ষ। জাতির অবিসাংবাদিত নেতার হত্যাযজ্ঞে তিঁনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের চেয়েও ভীষণ মারাত্মক ও একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পোষণ করেছিলেন। হত্যাকাণ্ড নির্ধারণ করার প্রকৃত অভিপ্রায়ে খুনীচক্রের মধ্যে কর্নেল সৈয়দ ফারুক এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের সাথে একান্তভাবে সাক্ষাত করতেন।
জিয়াউর রহমান খুনীগোষ্ঠির প্রতিক‚লে কোন প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং পরিকল্পনা মাফিক তাদেরকে মদদ দিয়ে নানাপ্রকার সহায়তা প্রদান করেন এবং জিয়াউর রহমান মাহাবুব আলম চাষীর মাধ্যমেও বিশ্বাসঘাতক মোশতাক চক্রের সাথে সর্বক্ষণ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা, এস এইচ এম বি নূর চৌধরী এবং রাশেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন।
বিদেশি গোয়েন্দা ও মোশতাক আহমেদ চক্র থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করার প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা করেন।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল বিশ্বাস ঘাতকগোষ্ঠীকে বিদ্রোহটি সংঘটিত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেন।
১২-জন বিপথগামী সামরিক অফিসার ও ১৬০ থেকে প্রায় ৭০০ শত জন সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক ১৫ই আগস্ট গভীর রাতে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রমন করেন এবং স্বাধীনতার কান্ডারি বাংলার নিবেদিত প্রাণ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২ এর নিজ বাসভবনে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর চক্রান্তকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ সংবিধান বর্হিভূতভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং অতীব ঘৃণিত ও নিন্দুক বিষয় হচ্ছে যে, মোশতাক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দলকে “জাতির সূর্যসন্তান” বলে উপাধি দিয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার পরিকল্পনা মাফিক ২৫-শে আগস্ট জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ আর্মি ষ্টাফ হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন।
তিনি শেখ মুজিব ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য নিন্দিত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ প্রবর্তিত করেন, এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং-৫০ নামে সজ্ঞাবিশিষ্ট ছিল।
পরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধ্যবসায় ১৯৭৯-সালের ৯-ই জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে উক্ত নিষ্ঠুরতম কালো কানুনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে সম্মতিদান করে এখানেই তিনি ক্ষান্ত বা নিশ্চল থাকেননি! বঙ্গবন্ধুর ষড়যন্ত্রকারী গর্হিত খুনীদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড এবং দেশের ভিতরে বিদ্রোহের চেষ্টার সাথে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া সত্তে¡ও তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ না করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অভিযুক্ত ঘাতকগোষ্ঠীর অধিকাংশ ব্যক্তিকে দেশের বাহিরে অর্থ্যাৎ বিদেশের দূতাবাসগুলোতে সম্মানজনক চাকুরী প্রদান করেন।
তৎমধ্যে লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমকে চীন রাষ্ট্রে প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, লে. কর্নেল খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. কর্নেল আব্দুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ছিলেন।
অবশেষে তারা সবাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিনিষ্টার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন, এমন কি কয়েকজনকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পদোন্নতি দেন।
এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পর উক্ত কুখ্যাত খুনীদের সহায়তার ধারা ক্রমান্বয়ে অব্যাহত রেখেছিলেন এবং হুসেইন মো: এরশাদ ঘাতকবৃন্দের দেশে ফিরে একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। এমন কি তাদেরকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে, সংসদে প্রবেশ করার জন্য সংসদের দরজা উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
নব্বইয়ের পর বেগম খালেদা জিয়া সরকারের শাসনামলেও উল্লেখিত ঘাতক স¤প্রদায়দের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা অবাধ অপ্রতিবদ্ধ রেখেছিলেন। কেবল তাই নয় তিনি খুনী চক্রের প্রধান রশিদকে ১৫-ই ফেব্রæয়ারী ১৯৯৬-সালের ভোটার বিহীন তথাকথিত নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ আসনে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার সদুপায় সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন।
১৯৯৬-সালের ২৩-শে জুন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১৪-ই নভেম্বর সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের অভিপ্রায়ে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি কালো আইনটি পরিতাক্ত করে বিচারের পথ উম্মুক্ত করেন।
১৯৯৭-সালের ১২-ই মার্চ ছয়জন অভিযুক্ত আসামীকে বিচারালয়ে হাজির করে বিচার কার্য আরম্ভ করা হয় এবং ১৯-শে জুন লিগাইৎ বিচারকবৃন্দ বিব্রত হওয়ার দরুন বিভিন্ন নিমিত্তে প্রায়িক আট বার হত্যাকারীদের বিচার কার্যক্রম নিবতির্ত হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদী বিচার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে আদালতের বিচার ফল জনাব কাজী গোলাম রসুল ঘাতকদের পনের জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
১০-ই অক্টোবর ২০০১ বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহন করার পর উক্ত খুনীদের বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০০৭- সালের ২৩-ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তিন সদস্যের বিচারকবৃন্দ শুনানি সমাপ্তে পাঁচজন আসামীকে আপিল করার সম্মতি দান করেন।
১২-ই নভেম্বর ২০০৯ইং আদালতে বিচারকগণ ২৯-দিনের বাদী-প্রতিবাদীর বক্তব্য শ্রবন করে মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ ১৯-শে নভেম্বর চুড়ান্ত রায় প্রদানের তারিখ নির্ণয় করেন এবং ১৯-শে নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায়কে বহাল রেখে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পাঁচ জনের আপিল প্রার্থনা বাতিল করে দেন।
১৯-শে জানুয়ারী ২০১০ইং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারকবৃন্দ আপিলের রায়ের প্রতিক‚লে আসামী পক্ষের রিভিও খারিজ করে দেন এবং আসামীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন।
২০১০-সালের ২৮-শে জানুয়ারী বুধবার গভীর রাতে লে. কির্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত দন্ডপ্রাপ্ত উপলিপ্ত খুনীদের ক্রমান্বয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
২০২০-সালের ১২-ই এপ্রিল রোজ বুধবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আর একজন সাজাপ্রাপ্ত খুনী ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়, প্রকাশ থাকে যে ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ জেলের ভিতরে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাÐের সাথেও স্বয়ং জড়িত ছিলেন।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত মূল আসামীদের ১২-জনের মধ্যে কেবল ছয় জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। অবশিষ্ট মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ৬-জন আসামীর মধ্যে লে. কর্নেল আজিজ পাশা ২০০২-সালে পলাতকবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মৃত্যুবরণ করেন এবং অন্যন্য ঘাতকবৃন্দ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু প্রাণনাশের ঘটনা অতিশয?িত মনস্তাপের বিষয়, ঘাতকদের নিষ্ঠুরতা বন্যজন্তুকেও পরাস্ত করেছে। ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবুঝ পাপশূন্য শিশু শেখ রাসেল কে ও রেহাই করেননি। উক্ত হত্যাকাÐটি জাতির ইতিহাসে এক হন্দহীন জঘন্য অপরাধ, গর্হিত ঘাতকদের এমন নিষ্ঠুরতম অমানবিক দন্ডার্হ কর্মের প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই ইহজগতে ভোগ করা উচিত নতুবা এমনতর বিদ্রোহ কার্যক্রম ভবিষ্যতে প্রবলভাবে সংঘটিত হবে। আগস্টের এই শোকাবহ মাসে জাতির জনকের হত্যাকারীদের এহেন অপকর্ম ও নিষ্ঠুরতম ঘটনার কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর আত্মার উপশম কামনা করছি এবং বঙ্গবন্ধুর অবশিষ্ট গর্হিত খুনীদের শাস্তি বাস্তবায়ন না হলে এহেন নিন্দীত হত্যাযজ্ঞের বিচার অসম্পূর্ণ থাকবে।
লেখক: মুন্সী বশীর; কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ; মন্ট্রিয়াল, কানাডা। ১৫ই আগস্ট ২০২১ইং